অধিন্যস্ত কথন – ১
আল্লাহর রাসূলের গল্প পড়েছিলাম, খাদেমকে একটা কাজে পাঠিয়েছেন, বাচ্চা মানুষ, পথিমধ্যে খেলায় মত্ত হয়ে ভুলে গেছে। আল্লাহর রাসূল তাকে কি শাস্তি দিলেন? সামান্য একটু ধমকও দেননি, পেছন থেকে গিয়ে ধরলেন। বালক হতচকিত হয়ে পেছনে ফিরতেই রাসূলুল্লাহ মুচকি হেসে বললেন: কি আনাস, কাজটি কি করেছো?
– জ্বি, ইয়া রাসূলুল্লাহ, এইতো যাচ্ছি….
সেদিন টিভির পর্দায় খবর দেখতে গিয়ে চোখে পড়লো, তেমনই বয়সের এক খাদেমা(সাবিনা) ডিম হাফ বয়েল করতে গিয়ে কুসুম ভেঙে ফেলেছে, কি মারাত্মক অপরাধ! তাকে বেলন দিয়ে পিটিয়ে চোখ দুটো নীল বানিয়ে ফেলা হয়েছে, সমস্ত শরীরে খোনতা দিয়ে পোড়ানো আর ঝলসানোর দাগ….
আমি এসব দেখতে পারিনা, তাই নিউজের জগত থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখি: যে কল্পনায় আমি আল্লাহর রাসূল কিংবা আসহাবে রাসূলদের দেখতে পাই, সেই কল্পনা দিয়ে আমি কোন পশুসুলভ মানুষ কল্পনা করতে পারিনা: ইয়া রাহমানুর রাহীম! যে মানুষগুলো মানুষ হয়ে ইয়াতিম অনাথের গায়ে হাত তোলে, আগুন দিয়ে ঝলসে দেয়, তারা কি আপনার জাহান্নামের আগুনের কল্পনা কখনো করেছে, যার সামান্য স্পর্শেই হাড় মাংস ছাড়িয়ে অন্তর পর্যন্ত বিগলিত হয়ে যাবে??
আল্লাহর রাসূল মৃত্যুর পূর্ব মুহুর্তেও যে দুইটি বিষয়ে তার উম্মতকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে গেছেন, তার মধ্যে একটি হলো:
“তোমরা অধিন্যস্তদের ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় করো।”
আপনার তো অধিন্যস্তকে সামান্য একটু ঝাড়ি দিয়ে কথা বলতেও ভয়ে গা শিউরে ওঠা উচিৎ: যদি না আমি অজান্তেই যুলুম করে ফেলি, মহাবিচারকের বিচারশালায় কাল কিয়ামতের ময়দানে আমাকে যালিমের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে, আমার মুখ বন্ধ করে দেয়া হবে, মজলুমের কাছ থেকে, আমার হাত পা এর কাছ থেকে পর্যন্ত সাক্ষ্য নেয়া হবে: সেই বিচারশালায় মামু নেই খালু নেই, আল্লাহ যাল্লা শানুহুর হুকুম ছাড়া ‘টু’ শব্দটি করার সাধ্য কোন বনী আদমের নেই, এমনকি নবী রাসূলেরও নেই। আয় ইনসান! কাউকে অধিন্যস্ত পেয়ে একহাত দেখে নিতে পারো, কিন্তু আল্লাহ রাব্বুল ইয্যাহ যদি তোমাকে দেখে নেয়ার ইরাদা করেন, সারে কায়েনাতেরও ক্ষমতা নেই, তোমাকে আল্লাহর আযাব থেকে বাঁচাবে।
একবার আবূ আব্দুল্লাহ নাম্নী এক সাহাবী তার দাসকে কোন একটা অপরাধের কারণে বেত্রাঘাত করছিলেন, হঠাৎ পেছন থেকে ডাক শুনতে পেলেন: স্মরণ করো, হে আবু আব্দুল্লাহ!
তিনি রাগে এতটাই অন্ধ হয়ে ছিলেন যে শুনতে পাননি। অতঃপর আল্লাহর রাসূল কাছে এলে দেখতে পেয়ে তিনি হাত থেকে চাবুক ছুড়ে ফেলে আল্লাহর রাসূলের দিকে মনোযোগ দিলে রাসূলুল্লাহ বললেন:
“স্মরণ করো, ইয়া আবা আব্দুল্লাহ, স্মরণ করো! ওর উপর তোমার যতখানি ক্ষমতা, তোমার উপর আল্লাহর ক্ষমতা তারও চেয়ে বেশি।”
আবু আব্দুল্লাহ(রা:) বলেন: এরপরে আমি আর জীবনে কোন অধিন্যস্তের গায়ে হাত তুলিনি।
অধিন্যস্ত কথন – ২
দুপুরে খাদেমা খালা ঘর মুছছিলো, আহ্লাদি মেয়ে আমার আট দন্ত বের করে মায়ের মুখে একটু আদর আর চুমু দিয়ে গেলো। এরপর খালার কাছে গিয়ে খালার মুখ জড়িয়ে ধরলো, গাল দুইটা টেনে টেনে বলছে- টুনটুনি… পাখি….
দৃশ্যটা এত সুন্দর লাগলো, খুব ক্যাপচার করে রাখতে ইচ্ছে করলো- এই আমরা গায়ের চামড়া কিংবা বিত্তের পার্থক্য বুঝি, শিশুরা যে সত্যিই পবিত্র, এরচে বড় প্রমাণ আর হয়না! ছবিটা তুলে রেখেছি, শেয়ার দেয়া জায়েজ হলে দিতাম, পারিনি তাই মোবাইলেই রেখে দিলাম। আর মনে মনে ভাবছিলাম, আশেপাশে আমার কিছু বিশেষ আত্মীয় থাকলে ‘ছি! ছি! ওর মুখে ময়লা! বলে মেয়েটাকে তুলে আনতো। আমার মন সায় দেয়নি, আমাদের ভেতরের আত্মাটা পচে পচে যতটুকু কলুষিত হয়েছে, এই ছোট্ট পবিত্র মনে তা ঢুকিয়ে দেয়ার কী দরকার? থাকুক না আরো কিছুদিন নিষ্কলুষ! এই খাদেমাই যদি আমার আগে জান্নাতে চলে যায়, সেদিন তো ও আমার দিকে মুখ ঘুরিয়েও তাকাবেনা! মানুষে-মানুষে দুনিয়ার এই ভেদ তো মৃত্যু অবধিই, তারপর সব এক…..
খাদেমাদের সাথে এবসোল্যুট ভালো ব্যবহার করা মুশকিল, বাস্তবতার ধাক্কা খেয়ে আমিও বুঝেছি। এই আমিও খাদেমার কিছু কাজে বিরক্ত হয়ে ধমক না দিয়ে পারিনা। তবে আমি এটাকে বিবেচনা করি একজন ম্যানেজার/মালিক আর কর্মচারীর সম্পর্ক হিসেবে। সে শুধুই আমার আন্ডারে একজন বেতনভুক্ত কর্মচারী, আমি তার ম্যানেজার/মালিক। চাকরি করতে হলে কাজ করেই মাইনে পেতে হয়, জগতে বিনে পয়সায় কেউ কাউকে খাওয়ায় না। কাজে ভুল হলে তা শুধরে দেয়ার রাইটও মালিকের আছে। ম্যানেজার হিসেবে আমি শুধু এটুকুই খেয়াল রাখার চেষ্টা করি: “আমার ঝাড়ি কিংবা বকার পরিমাণ যেন তার ভুলের পরিমাণের অনুপাতে বেশি না হয়ে যায়।”
আখিরাতের হিসেবটা অন্যরকম, সেখানে মালিক কিংবা কর্মচারী দুজনেই সমান। কর্মচারী যদি মালিকের অবাধ্য হয়, কাজে ফাকি দেয়, তার জন্য নির্ধারিত শাস্তি আছে। আবার মালিক যদি সাধ্যের অতিরিক্ত বোঝা চাপায়, কাজ অনুপাতে বেতন কম দেয়, ভুলের অনুপাতে শাস্তি বেশি দিয়ে ফেলে; সেই শোধটুকু তার কাছ থেকেও নেয়া হবে পাই পাই হিসেব করে।
“ও আমার অধিন্যস্ত, তাই দু’কথা শুনিয়ে দিলাম, ও তো উত্তর দিতে পারবেনা। মনে চাইলেই দু’ঘা লাগিয়ে দিলাম, তা ন্যায্য হলে ঠিকাছে, অন্যায্য হলে কিন্তু ঐ দু’ঘা ঐপারে আমার জন্য জমা রইলো। মালিক, সাবধান!”
আল্লাহ আমাদেরকে অধিন্যস্তদের ব্যাপারে সচেতন হওয়ার তাওফীক্ব দিন। আল্লাহুম্মা আযিরনা মিনান্না-র, আল্লাহুম্মা আযিরনা মিনান্না-র…