স্টেডিয়াম ভর্তি মানুষ। বাংলাদেশের মাটিতে পাকিস্থানের সাথে অন্য একটি দলের খেলা চলছে। স্টেডিয়ামের বিভিন্ন স্থানে ঊড়ছে চন্দ্র তারকাখচিত সাদা সবুজ পতাকা। যাদের হাতে এ পতাকা শোভা পাচ্ছে তারা অধিকাংশই বাংলাদেশী। টিভি সাক্ষাৎকারে দর্শকরা পাকিস্তানের পক্ষে বাঁধভাংগা উল্লাস ও শুভ কামনা প্রকাশ করছে। এরই মধ্যে স্যোসাল নেটওয়ার্কিং সাইটগুলোতে চলছে বাংলাদেশি পাকিস্তানের দর্শকদের চোদ্দ গুষ্ঠি উদ্ধার।জিনিসটাকে স্বাধীনতা যুদ্ধের পক্ষে বা বিপক্ষে যেভাবেই ব্যাখ্যা করতে চাননা কেন, যারা এ পতাকার ঊড়ানোর বিপক্ষে তাদের সম্পর্কে আমি এক দিক থেকে কিছুট পজিটিভ ধারনা রাখি। সে সূত্র ধরেই বলছি ঘৃনা নয় বরং ব্যাপারটিতে আত্মসম্মানের বিষয় রয়েছে বলেই আমার মনে হয়। তাই আমি তাদের এ আত্মসম্মান প্রকাশকে সম্মান করি। কোনটা ঠিক আর কোনটা ঠিক না এ রকম জটিল বিতর্কে আমি যেতে চাচ্ছি না। ঠিক তেমনি কেউ যদি ফেলানীর লাশের উপর ভর দিয়ে মিষ্টি হেসে হত্যাকারীদের সাথে ডিনারে অংশগ্রহন করে তখন দেশের প্রতি তার দরদ ও আত্মসম্মান নিয়ে আমার প্রশ্ন আছে।
২
আরবজাতি একটি যুদ্ধবাজ জাতি। ঘোড় দৌড় প্রতিযোগিতায় একগোত্রের ঘোড়া আরেক গোত্রের আগে যাওয়ার মত ঠুনকো বিষয়কে কেন্দ্র করে তাদের মধ্যে যুদ্ধ লেগে যেত। কোন কোন সময় তো কোন গোত্রের আগে কোন গোত্রের ঘোড়া পানি খাবে এ বিষয়কে কেন্দ্র করেই তাদের মধ্যে লেগে যেত মারাত্মক সংঘর্ষ। মদীনার আওস ও খাজরাজ গোত্রের মধ্যে দীর্ঘকাল ব্যাপী চলা বুয়াস যুদ্ধ এ রকম ঠুনকো বিষয়কে কেন্দ্র করে হয়েছিল। ব্যাপারটা অবশ্যই নীতিবিরুদ্ধ কাজ। তবে নিজেদের শ্রেষ্ট মনে করে আত্মসম্মান বজায় রাখার যে মানসিকতা তা সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য বলে আমার মনে হয়। ইসলাম আসার পর তাদের আত্মসম্মানের প্রানশক্তিটা অটুট রাখলেও দিকটা পরিবর্তন করে দেয়।
৩
ইসলাম মুসলিমদের মাঝে কেমন আত্মসম্মানের সৃষ্টি করেছিল তা বুঝানোর জন্য হাদীস থেকে একটি ঘটনা উল্লেখ করছি। ঘটনাটি মুসতাদারাক আলহাকীমের ৩ নং ভলিউমের ৪৮৫ নং হাদীসে উল্লেখ আছে। হাকীম ইবনে হিশাম রাঃ (তখনো তিনি ইসলাম গ্রহন করেননি) মুহাম্মদ (সঃ) কে ইয়ামেনের রাজা যিয়াজানের গাউন উপহার হিসেবে দিলেন। মহানবী (সঃ) উপহারটি গ্রহন করছিলেন এবং সেটা পড়ে খুতবা দিয়েছিলেন। হাকীম ইবনে হিশাম বলছেন যে “এ গাউনে তিনি মহানবী (সঃ) এর মত সুন্দর এবং স্মার্ট আর কাউকে দেখেননি”। পরদিন ইবনে হিশাম মদিনার রাস্তায় দেখলেন গাউনটি উসামা বিন যায়েদ(রাঃ)পড়ে আছে। সবাই জানেন উসামা ছিলেন মহানবী (সঃ) এর দাস যায়েদ বিন হারিসা (রাঃ) এর সন্তান। সীরাতে উল্লেখ আছে উসামা বিন যায়েদ (রাঃ) ছিলেন কালো,চ্যাপ্টা নাকের,চিকন ঠোঁটের খুব অসুন্দর চেহারার মানুষ। উসামা বিন যায়েদকে তিনি প্রশ্ন করলেন “আনতা ইয়া উসামা?
তুমি উসামা? তুমি সেই গাউন পড়ে আছ যে গাউন ছিল ইয়ামানের রাজা যিয়াজানের!!?”
কি ভাবছেন? ওসামা বিন যায়েদ বলেছিল-আমার ভুল হয়ে গেছে, দুঃখিত?
আমি আজই মহানবী (সঃ)কে গাউনটি ফেরত দেব।
দুঃখিত,আসলে মহানবী (সঃ) দিয়েছেন তাই পড়েছি। এ রকম কিছু কি ভাবছেন?
নাহ! এরকম কিছুই তিনি বলেননি।তিনি বলেছিলেন “ও আল্লাহি আনা খাইরুম মিন যিয়াজান”
আল্লাহর কসম, আমি যিয়াজানের চেয়ে শ্রেষ্ঠ,
আমার পিতা, যিয়াজানের পিতার চেয়ে শ্রেষ্ঠ
আমার মা যিয়াজানের মাতার চেয়ে শ্রেষ্ঠ
কারন আমি, আমার পিতা,আমার মাতা পড়েছি “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ”
ইসলাম মানুষের মনে এমনই আত্মসম্মানের সৃষ্টি করেছিল। মূল ভিত্তি তাওহীদের উপর নির্মিত কোরআন আর রাসুল (সঃ) এর নবুওয়াতই ছিল তাদের আত্মসম্মানের মূল প্রেরনা।
৪
বিশ্বকাপ ক্রিকেট-২০১১ উদ্বোধনী অনুষ্ঠান হয় বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে। উদ্ধোধনী অনুষ্ঠা্নের নাচে,গানে যেন কোন সমস্যা না হয় এবং অনুষ্ঠানের সৌন্দর্য যেন বিঘ্নিত না হয় সেজন্য বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদের একপাশের দুই ওয়াক্তের আযান বন্ধ রাখা হয়। কোন কোন তথ্য অনুযায়ী পুরো মসজিদের আযানই পুরোপুরি বন্ধ রাখা হয়। যেটাই হোক না কেন, জিনিসটাকে যত তুচ্ছই মনে হোক না কেন ৮৭% মুসলমানের এ দেশের জাতীয় মসজিদের মিনার থেকে তাওহীদের ডাক আসবে না,আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্বের বানী আসবে না,মহানবী (সঃ) এর নবুওয়াতের কথা উচ্চারিত হবে না,এটা আত্মসম্মানসম্পন্ন কোন মুসলিম মেনে নিতে পারবেন বলে আমার দিমাগে আসে না।
৫
আরবজাতির মত জাতিকে আল্লাহ সম্মানিত করেছেন যে জিনিসটি দিয়ে সেটা ছিল কোরাআন। মানবজাতির সংবিধান। মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার সর্বশ্রেষ্ঠ ধারাগুলো যেখানে সন্নিবেশিত। ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার সুস্পষ্ট ইশতেহার যেখানে ঘোষিত হয়েছে। কিন্তু আজ আমাদের মনমানসিকতা এমন হয়ে গেছে আমরা কুরআনের অনুসারী এ কথা ঘোষনা করতেও আমরা কুন্ঠাবোধ করি। আমাদের মন মানসিকতায় সেট হয়ে গেছে কোরআন ১৪০০ বছর আগের জন্য ছিল। এখনকার সমাজে এর কোন আবেদন নেই। কোরআনের আইন ১৪০০ বছর আগের জন্য ছিল,আজকের সমাজে এর কোন প্রয়োজন নেই। তারা ভুলে গেছে আমাদের এ উপমহাদেশে ২০০ বছর আগেও কোরআনের আইন ছিল। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী গ্ল্যাডস্টোন সংসদে দাঁড়িয়ে যখন বলেছিলেন “এ কোরআন যতদিন মিসরীয়দের মধ্যে থাকবে ততদিন আমরা কিছুই করতে পারব না”। এমন চিন্তা আমাদের মধ্যে সৃষ্টি না হওয়ার কারন আমাদেরকে অনুসন্ধান করতে হবে। কোরআন এখনো তাঁর জ্যোতি ছড়ানোর জন্য প্রস্তুত। শুধু দরকার আমাদের মানসিকতার পরিবর্তন। কোরআন আজ আমাদের জন্য কষ্টের কারন হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথচ এ কোরআন আমাদেরকে দেয়া হয়েছে সঠিক পথের দিশা পাওয়ার জন্য।মুমিনদের জন্য এ কোরআন এসেছে নিরাময় স্বরূপ,এ যে এক আল্লাহর বিশাল রহমত যে তিনি মুসলমানদের এ কোরআনের দায়িত্বভার অর্পন করেছেন। তাইতো এ কোরান নিয়ে আমাদের আনন্দিত হওয়া উচিত।সে জিনিসটাই আল্লাহ ঘোষনা দিচ্ছেন এভাবে-
“হে মানবকুল, তোমাদের কাছে উপদেশবানী এসেছে তোমাদের পরওয়ারদেগারের পক্ষ থেকে এবং অন্তরের রোগের নিরাময়, হেদায়েত ও রহমত মুসলমানদের জন্য।
তুমি বলে দাও আল্লাহর এ দান ও রহমতের প্রতি সকলেরই আনন্দিত হওয়া উচিত।তা এটা হতে বহুগুনে উত্তম যা তারা সঞ্চয় করছে”। (সুরা ইউনুস: ৫৭-৫৮)
আজ কোরাআন আমাদের মধ্যে সেই আবেদন সৃষ্টি করছে না কেন?কোরআন আমাদের আত্মসম্মানের প্রকৃত উৎস।কিন্তু এ কোরানের প্রতি আমাদের এত অবজ্ঞা কেন?কোরআনের আইনের প্রতি আমাদের এত অবজ্ঞা কেন?
আমাদের আত্মসম্মান এত সহজে উবে গেল কেন?
আজকে মুসলিমদের যখন মুসলিম হওয়ার জন্যই অপমান করা হয় তখন কোথায় থাকে আমাদের আত্মসম্মান?
আল্লাহ নবীকে এ পৃথিবীতে রহমত স্বরূপ প্রেরন করেছেন। আজ যখন স্কুলের মত বিদ্যা অর্জনের জায়গায় বসে সেই নবীকে গালাগাল দেয়া হয়, তখন আমাদের ঈমান কোথায় যায়? তখন আমাদের আত্মসম্মান কোথায় যায়?খোবাইব, যায়েদ বিন দাসানা,যিয়াদ বিন সাক্কান,সাদ বিন রাবী (রাঃ) দের মত ঈমানের জ্যোতি আমরা দেখাতে পারছি না কেন?
ওসামা বিন যায়েদের যে আত্মসম্মানের বড়াই ছিল আমাদের তা নেই কেন?
মুসলিম হিসেবে আমাদের আত্মসম্মানের এমন দুমড়ে মুছড়ে যাওয়া আর কতকাল দেখতে হবে?
ও মুসলিম!! আল্লাহ কি বলছেন শোন-
“তোমরাই হলে সর্বোত্তম উম্মত, মানবজাতির কল্যানের জন্যেই তোমাদের উদ্ভব ঘটানো হয়েছে। তোমরা সৎকাজের নির্দেশ দান করবে ও অন্যায় কাজে বাধা দেবে এবং আল্লাহর প্রতি ঈমান আনবে”। (সূরা আলে ইমরান-১১০)
যতদিন পর্যন্ত আল্লাহর দেয়া দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে শ্রেষ্ঠত্বের মানসিকতার আমদের মধ্যে তৈরি হবে না,যতদিন পর্যন্ত মানসিক দাসবৃত্তি আমাদের মধ্যে থেকে চলে যাবে না,যতদিন পর্যন্ত মুসলিম হওয়ার গৌরব ও সম্মান আমাদের মনমানসিকতায় স্থান দখল না করবে ততদিন মুসলিম জাতি এ পৃথিবীর নেতৃত্ব দেয়া থেকে যোজন যোজন দূরে থাকবে।