মানুষ সত্ত্বাগতভাবে অনেকবেশী ইনক্লুসিভ হলেও নানা রকম মত,পথ এবং চিন্তার মিশ্রণ মানুষকে অনেকসময় সংশয়েও ফেলে দেয়। আর সেসবের মধ্যে যদি ঐকতান না থাকে, যোগসূত্র না থাকে তাহলে মানুষ হয়ে পড়ে বিশৃঙ্খল, এলোমেলো।  আজকের যুগের বাস্তবতায়  ধর্ম ব্যক্তিজীবনের সাথে নিছক লেজুড়বৃত্তীয়ভাবে আছে। একটা ছেলে যদি এক ধর্মহীন সেক্যুলার বাস্তবতায়  বড় হয় আর পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের সময় ধর্মীয় বাস্তবতার মুখোমুখি হয় তাহলে তার মনে স্বাভাবিকভাবে নান কিসিমের প্রশ্ন ঘুরপাক খাবে। নিজেকে নিয়ে সন্দিহান হবে। আসলে উদ্দেশ্যের অনুপস্থিতি চিন্তার অরাজক পরস্থিতি তাঁর মূল স্থিতিকে বিঘ্নিত করবে। এমতাবস্থায় নিজের সম্পর্কে, নিজের মৌলিক উপাদান এবং কেন্দ্রী উদ্দেশ্যের গভীরে যাওয়া ছাড়া সরল পথে চলা মুশকিল। মসনবীতে উল্লেখিত মাওলান রুমীর’র  একটা গল্প বলি-

এক হাঁস তাঁর কয়েকটা ডিম লেকের পাশের এক গাছের গোড়ায় সুন্দরভাবে বাসা বেঁধে সংরক্ষণ করছিল। হঠাৎ ঐ এলাকায় প্রচন্ড ঝড়ের কারণে পানিতে বাসাসহ ডিমগুলো ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল।  একটা ডিম পড়ে গেল এবং একটা গাছের ডালে আঘাত পেয়ে কিছুটা ফেটে গেল  এবং তার মধ্য থেকে একটা ছোট হাঁসের বাচ্চা বের হয়ে এল। সে লেকের পাশে আশ্রয় নিল।  পরদিন একটা মুরগি তাঁর বাচ্চাসহ লেকের পাড়ে খাবার খাচ্ছিল। হাঁসের বাচ্চাটিকে দেখে তার মায়া হল। সে বাচ্চাটিকে তার অন্যান্য বাচ্চাদের সাথে বড় করতে শুরু করল। একসময় হাঁসটি বড় হল। এদিকে সেদিক ঘুরে আপন খাবার দাবার সংগ্রহ করতে লাগল। কিন্তু তার মনের মধ্যে অস্থিরতা। সে যদিও স্থলভাগে ঘুরতে অভ্যস্ত কিন্তু তার মন চায় পানিতে ভাসতে, সাঁতার কাটতে, মাছ শিকার করতে।

হাঁসটি নিজের মধ্যে এক দ্বিমুখী টান অনুভব করা শুরু করলো। তাঁর বেড়ে উঠা তাকে একদিকে টানে অপরদিকে তার প্রকৃতি টানছে তাকে ভিন্ন দিকে। হাঁসটি এখন কি করবে?

এমন দোদ্যুলমানতার জন্য আগে তাকে নিজের অস্তিত্বের এবং পরিচয় সন্ধান করতে হবে। তার আদত প্রকৃতিকে চিহ্নিত এবং ধারণ করতে হবে। 

আমাদের মধ্যেও এমন এক দ্বিমুখী চাপ লক্ষ্যনীয়। একদিকে দুনিয়ার টান অপরদিকে ধর্মের শান-মান আমাদের চিন্তার জগতকে অস্বচ্ছন্দ করে তুলছে। 

মাওলানার গল্পের আলোকে বিষয়টা আরেকটু বড় স্পেকট্রামে দেখলে এমন দাঁড়ায়,

আত্মা এবং দেহের সমন্বয়ে গঠিত এ জীবন।মানুষ সারাজীবন দেখে শুধু দেহের ফিকির কিন্তু আত্মার জিকির উপলব্ধি করতে পারে না। দেহসর্বস্ব এই বস্তুকেন্দ্রিক জীবনদর্শনে সে বেড়ে উঠে। অস্থি মাংসে তৈরি আরেকটু বৈজ্ঞানিকভাবে বলতে গেলে পটাশিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম, লোহা ইত্যাদি ধাতব উপাদানে তৈরি এই দেহের শক্তি এবং চাহিদা জোগাতেই মানুষের যতদৌড়। দেহকে সাজাতেই তাবৎ মেহনত।

কিন্তু মানুষ কোন না কোন বাঁকে আত্মার হাহাকার শুনতে পায়। অপার্থিব এ আত্মচিৎকার শোনার পর মানুষ আর থিতু থাকতে পারে না। দুইটানকে  একসাথে উপস্থিতি জানান দেয়া সম্ভব না হওয়ায় মানুষ সংশয়ে পড়ে যায়। এক্ষণে মানুষ তার প্রকৃত পরিচয়ের খোঁজে আত্মনিয়োগ করতেই হবে। কে আমি? কোথায় থেকে আসলাম? পরণতিইবা কি?

এ প্রশ্নগুলোর উত্তরেই আছে মানুষের স্থায়িত্ব। মানুষ আত্মপরিচয়ের পর্দা উন্মোচন করার পর আসে দ্বিতীয় চ্যালেঞ্জ। কিভাবে আত্মার ডাকে সাড়া দেব?

মানুষের আত্মা অপার্থিব ঊর্ধ্বস্থ উপাদানে তৈরি আর মানুষের দেহ পার্থিব উপাদানে। প্রত্যেকটি জিনিস তাঁর মূল অবস্থানে ফিরে যেতে চায়। আত্মা চায় উপরে উঠতে আর দেহ চায় নিচে নামতে। আত্মা এবং দেহের বেঁচে থাকার রসদপাতিও তাদের স্ব স্ব উৎস থেকে সংগ্রহ করে। দেহের পুষ্টির জন্য দরকার পার্থিব ফসল-ফলফলাদি আর আত্মিক পুষ্টির জন্য দরকার ওহীর নির্যাস।

আত্মা এবং দেহের এই উর্ধ এবং নিম্নমুখী টানের মধ্যে যার টানের শক্তি বেশী থাকবে মানুষ সেই দিকে যাবে। তাই আত্মাকে শক্তিশালী এবং আরো বেশি বলবান করার জন্য ওহীর জ্ঞান থাকা এবং মানা চাই।  ওহীর মানদন্ডে জীবন এবং জগতকে দেখতে পারলে মানুষের মনোজগতে আর  কোন বৈপরীত্যের চিহ্ন থাকবে না। তার পুরো জীবনজুড়ে সুরেলা ধ্বনি বাজবে। জীবন হবে সামঞ্জস্যপূর্ণ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *