আমার আরবী শেখা শুরুর সময়টা দ্বীনের বুঝ আসার প্রায় কাছাকাছি। অর্থাৎ দ্বীনের বুঝ আসতে শুরু করার পরপরই আমার মনে হয়েছিল আরবী শেখা দরকার। তখন আরবী শেখার প্রয়োজন বোধ করেছিলাম শুধু এজন্যই যে- ‘কুরআন বুঝতে চাই আরবীতে’, যদিও পরবর্তীতে কাল পরিক্রমায় আরবী শেখার আরও নতুন নতুন উদ্দেশ্য আমার জীবনে যুক্ত হয়েছে।
আমার আরবী শেখার প্রথম যাত্রা শুরু হয়েছিল ২০১২ এর শুরুর দিকে-আইসিডিতে। তখন প্রতি শুক্রবার জুম’আর পর আইসিডিতে উস্তায আব্দুল মতিন দুটি ব্যাচ পড়াতেন। পাঠ্য বই ছিল- মদীনা এরাবিক। সেখানেই আমাদের আগের ব্যাচে বর্তমান সময়ের আরবী ভাষার একজন জনপ্রিয় উস্তায এস.এম. নাহিদ হাসান পড়তেন। যাই হোক। সারাটা সপ্তাহ মুখিয়ে থাকতাম কখন শুক্রবার আসবে। সেটা যতটা না আরবী ক্লাশের জন্য তার চেয়ে বেশী দ্বীনি ভাইরা মিলে আড্ডা দেওয়ার জন্য। তখন আমাদের শুক্রবারের রুটিন ছিল এমন- আল আমিন মসজিদে জুম’আর নামায পড়ার জন্য সকাল ১০:৩০ এর দিকে বুয়েটের হল থেকে রওনা দিতাম (কারণ, ১১:৩০ এর মধ্যেই আল-আমিন মসজিদের নীচতলায় আর বসার জায়গা থাকত না), এরপর জুম’আর নামাযের পর আল-আমিন হোটেলে (কাকতালীয়ভাবে হোটেলের নামটাও আল-আমিন ছিল!) আইসিডির আরবী ব্যাচের ভাইয়েরা কয়েকজন একসাথে দুপুরের লাঞ্চ করে আইসিডিতে চলে যেতাম। আমাদের ব্যাচটা ছিল ৩ টা থেকে, তাই ক্লাশের আগে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিতাম আর সাথে আড্ডা। এভাবে ক্লাশ চলতে লাগল। শুরুর দিকে কয়েকদিন খুব ভাল চলল, কিন্তু বিপত্তিটা বাধল ফে’ল শুরু হলে। যদিও মদিনা এরাবিকের প্রথম খণ্ডে ফে’ল ছিল না তবুও উস্তায একদিন হঠাৎ করে ৪৩ টি ফে’ল এর একটি চার্ট নিয়ে ক্লাশে হাজির হলেন। বললেন এই ৪৩টি ফে’ল এর প্রতিটির ১৪ টি করে সিগাহ মুখস্থ করতে হবে। শুনেতো আমার মাথায় হাত! ক্যাম্নে সম্ভব? কেবলই না কত আশা নিয়ে আরবী শেখা শুরু করলাম আর শুরুতেই এই পাহাড় বাইতে হবে? উস্তায বললেন, আগামী ক্লাশে নাসারা-ইয়ানসুরুর ১৪ টি করে ২৮টি সিগাহ এক নিঃশ্বাসে মুখস্থ বলতে হবে। এক নিঃশ্বাস মানে আসলেই এক নিঃশ্বাস, দুই নিঃশ্বাস হলে বাদ আর যতদিন এক নিঃশ্বাসে হবে না ততদিন পরের পড়ায় যাওয়া হবে না। এক সপ্তাহ পর অনেক চেষ্টা করেও শুধু আনসুরু-নানসুরু এই দুইটা মনে রাখতে পেরেছিলাম। যাই হোক, এভাবে টেনে-হিঁচড়ে মদিনা এরাবিক-১ম খণ্ডের ৬৮ পৃষ্ঠা পর্যন্ত পড়ার পর সেখান থেকে ড্রপ আউট হয়ে গেলাম। আরবী শেখাও কিছুদিনের জন্য বন্ধ থাকল।
এর প্রায় মাস খানেক পর Islamic Online University (IOU) এর BA in Islamic Studies (BAIS) কোর্সে এডমিশন নিলাম। সেখানে প্রতিটি সেমিস্টারে অন্যান্য কোর্সের পাশাপাশি একটি করে আরবী কোর্স থাকত। আমাদের সময় (২০১৩ সালে) প্রথম সেমিস্টারের পাঠ্যবই ছিল ডঃ বিলাল ফিলিপ্স এর লিখা Arabic Grammar Made Easy এবং দ্বিতীয় সেমিস্টারে এই বইটির পাশাপাশি ডঃ বিলালের বানানো নিজস্ব কিছু PPT পড়ানো হত। সত্যি কথা বলতে, আমি আজ আরবীর বেসিক যতটুকুই জানি তার ৯০% শিখেছি ঐ প্রথম দুই সেমিস্টারের ক্লাশ থেকে। একেবারে বিগিনারদের জন্য ০ থেকে শুরু করতে চাইলে Arabic Grammar Made Easy একটি যুগান্তকারী বই-আমার বিশ্বাস। মনে আছে, বইটির প্রতিটি লাইন মন দিয়ে পড়তাম, এরপর নোট নিতাম, এরপর ঐ অধ্যায়ের উপর ডঃ বিলালের দেওয়া ক্লাশ লেকচারগুলো শুনতাম। ক্লাশের মাঝখানে যেখানে উনি ভিডিও Pause করে কোন একটা কাজ দিতেন, সেখানে ভিডিও Pause করেই কাজটা করে আবার ভিডিও Resume করে মিলিয়ে নিতাম আমার উত্তরটা ঠিক আছে কিনা। খুব মজাও পেতাম ক্লাশ করে, আরবী যে এত সহজ আর এত আনন্দদায়ক তা আমি এতদিন কেন বুঝিনি? ভাবতাম আর অবাক হতাম আর তখনই এক ক্লাশে ডঃ বিলাল এর এক কথায় উত্তরটা পেয়ে গেলাম- “ফে’ল হচ্ছে আরবী গ্রামারের মহাসমুদ্র, তাই প্রথমেই ফে’ল না পড়ে ইসম সংক্রান্ত নিয়ম ও বাক্যগুলোর উপর জোর দেওয়া উচিৎ”। শুনে মনে হল, ‘আরে আমিতো এজন্যই আইসিডির ক্লাশ থেকে ছিটকে পড়লাম। ঐ যে সেই ৪৩X১৪ টা ফে’ল এর আতঙ্ক!’ এখনও যারা আরবী শিখতে চায় তাদের প্রতি আমার আন্তরিক একটা পরামর্শ থাকবে- শুরুতেই ফে’ল শিখতে যেও না, তাহলে আরবী ভাষার সৌন্দর্য হয়ত তুমি কখনও ধরতে পারবে না।
যাই হোক, এভাবে ১ বছর একমনে লেগে থেকে IOU এর আরবী কোর্স করতে থাকলাম (সাথে অবশ্য আরও ৩ টা করে কোর্স নিতাম প্রতি সেমিস্টারে)। ১ বছর পর দেখলাম, আমার আরবী গ্রামারের বেসিকে বেশ ভাল একটা অগ্রগতি হয়েছে। তখন মদিনা এরাবিক-১ম খণ্ডের বাকি অংশ (ঐ যে ৬৮ পৃষ্ঠা পর্যন্ত পড়ে ড্রপ আউট হয়ে গেলাম যে!) শেষ করার জন্য উস্তায নাহিদ হাসানের বাসায় গেলাম (ততদিনে তিনি আরেক জায়গায় মদীনা এরাবিক-১ম খণ্ড শেষ করে ব্যাচও পড়াতে শুরু করেছেন, আমি অবশ্য পার্সোনালি পড়তাম)। উস্তায কয়েকদিন ধরিয়ে দেওয়ার পর বাকিটা মোটামুটি নিজেই পড়ে শেষ করলাম, কোন সমস্যা হলে উস্তায নাহিদ হাসানকে ফোন দিয়ে জেনে নিতাম। পাশাপাশি চলতে লাগল IOU তে আরবী শেখা। IOU তে আমাদের ৪র্থ সেমিস্টারে মদিনা এরাবিক-২য় খণ্ড এবং ৫ম ও ৬ষ্ঠ সেমিস্টারে বইটির ৩য় খণ্ড পড়ানো হত (এখন সম্ভবত সিলেবাস পরিবর্তিত হয়েছে)। ক্লাশগুলো নিতেন উস্তায ফাযিল মাহমুদ। তবে সেই কোর্সগুলোতে IOU এর ক্লাশ লেকচারের চাইতে উস্তায নাহিদ হাসানের বানানো পূর্ণাংগ মদিনা এরাবিকের ক্লাশ নোটের উপরই মেহনত করতাম এবং ফলও পেতাম, আলহামদুলিল্লাহ। যেকোন সমস্যায় পড়লে যে কোন সময় উস্তাযকে ফোন দিয়ে কিংবা ম্যাসেজে প্রশ্ন করতাম, আর যেহেতু আমার নাহু সংক্রান্ত ভিতটুকু বেশ পাকা ছিল (আলহামদুলিল্লাহ) তাই পরবর্তীতে মদিনা এরাবিকের ২য় খণ্ড থেকে সরফ শুরু হলেও উস্তাযের ক্লাশ নোট আর টুকটাক ফোন কল যথেষ্ট হয়েছিল আমার এগিয়ে যাওয়ার জন্য। যেহেতু IOU তে প্রতিটি মডিউলের উপর পরীক্ষা দিতে হত তাই কতটুকু কী বুঝলাম তাও যাচাই হয়ে যেত। IOU তে আরবীর উপর আমাদের শেষ দুটি কোর্স ছিল বালাগাত ও কুরানের কিছু সূরার তরজমার উপর। এভাবেই IOU এর হাত ধরে আমার বেসিক আরবী শেখার সমাপ্তি ঘটে।
এরপর আমি অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম যে, আরবী তো শিখছি প্রায় ৫ বছর হয়ে গেল কিন্তু আরবী কিতাবাদি পড়ার কী হবে? সেদিকেও তো নজর দেওয়া দরকার। লক্ষ্য করলাম, আমার এতদিনের আরবী শেখাটা ছিল মূলত গ্রামার এপ্রোচে, কমিউনিকেটিভ এপ্রোচে নয়। তাই কুরান-হাদীসের বাইরে আরবী কিতাব পড়তে গেলে বেশ ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। এই ভোগান্তির মূল কারণ- প্রচুর পরিমাণে অজানা শব্দ। তাই এবার শুরু করলাম কাসাসুন নাবিয়্যিন, আল কিরাআতুর রাশিদাহ এগুলো পড়া। আলহামদুলিল্লাহ, লক্ষ্য করলাম ইবারত পড়ার জড়তা ধীরে ধীরে কেটে যাচ্ছে।
এখানে আমি নতুন আরবী শিখতে ইচ্ছুক ভাই-বোনদের একটা মূল্যবান পরামর্শ দিব, সেটা হল- আরবী গ্রামারের (বিশেষত নাহু) বেসিক কিছুদূর শেখা হলেই (প্রায় ৬ মাস) গ্রামারের পাশাপাশি প্রচুর পরিমাণে ইবারত (আরবী টেক্সট) পড়ার চেষ্টা শুরু করা। প্রথম প্রথম কষ্ট হবে এটা ঠিক, অনেক অজানা শব্দও থাকবে। কিন্তু এই পর্যায়ে প্রতিটি শব্দ অভিধান ঘেঁটে বের করার পরিবর্তে মনোযোগ দিতে হবে শুধু পড়ে যাওয়ার উপরে, যতটুকু বুঝা যায় তাই সই! কিন্তু তবুও পড়া চাই। এভাবে পড়তে পড়তেই এক সময় আরবী কিতাবাদি অধ্যায়নের অভ্যাস তৈরী হবে। আর প্রতিদিন ১টি হলেও নতুন শব্দার্থ মুখস্থ করা। বিশেষ করে যারা একাডেমিকভাবে ইসলাম নিয়ে পড়তে চায় কিংবা ইসলামের একাডেমিক কিতাবাদি পড়তে চায় তাদের জন্য এই কৌশল খুবই কার্যকরী।
যাই হোক, নিজের কথায় আসি। এরপরতো অতি সম্প্রতি ভর্তি হলাম মাদ্রাসায়, এখানে এসে শুরু হল আমার আরেক নতুন অভিযাত্রা যার একটি অংশ আরবীও। কিন্তু আরবীটা আগেই মোটামুটি শিখে আসায় এখানে আমাকে তেমন বেগ পোহাতে হচ্ছে না, আলহামদুলিল্লাহ। এখন লক্ষ্য, সামনে উস্তাযদের অধীনে আরবী একাডেমিক কিতাবাদী অধ্যায়নে পুরোদমে মনোনিবেশ করা।
এই তো ছিল আমার আরবী শেখার পথের সংক্ষিপ্ত যাত্রার অতি সংক্ষিপ্ত বর্ণনা। যারাই লিখাটি পড়েছেন তাদের সকলের কাছে দূয়ার দরখাস্ত রইল। জাযাকুমুল্লাহু খাইরান।