মদীনায় আমাদের দিন ঘনিয়ে আসছে। একইসাথে বেদনার ও আনন্দের একটি অনুভূতি। বেদনার কারণ… তা কি আর বলা লাগবে? যারাই কখনও না কখনও মদীনায় এসেছেন তারাই বুঝবেন কেবল কী এর আকর্ষণ! কী এক মায়া! কী এক দুনির্বার ভালোবাসা! মসজিদে নববীর উঁচু মিনার দূর থেকে চোখে পড়লেই সমস্ত শরীরে যেন একটা শিহরণ বয়ে যায়। আহ মদীনা! আমার মদীনা!
কিন্তু ওদিকে হজের দিনও কাছিয়ে আসছে! আমাদেরকে দ্রুত ফিরে যেতে হবে মক্কায়- আযিযিয়াতে। তাই যাওয়ার আগে দ্রুত কিছু কেনাকাটা করে নেওয়ার জন্য গেলাম মদীনার একটি মার্কেটে। মদীনা যে নবীজির পুণ্যভূমি-তা আজও টের পাওয়া যায় অনেকটাই। আমাদের দেশে মার্কেটগুলো যেমন নারী ও মিউজিকের আখড়া, ওদের তেমন নয় মোটেও। হ্যাঁ, হজের মৌসুমে সারা দুনিয়া থেকে আসা মহিলা হুজ্জাজরাও বাজাড়ে ভীড় করে ঠিক তবে ওদের মার্কেটগুলো গান-বাজনা থেকে মুক্ত। বরং যিলহজ শুরু হলেই বিভিন্ন মার্কেটে মাইকে তাকবির ও আযকার শুনতে পাওয়া যায়। আবার শুধু মার্কেট নয়- ওদের ট্যাক্সি চড়েও আমাদের দেশের চাইতে ভিন্ন অভিজ্ঞতা হল। মেজরিটি ট্যাক্সি ড্রাইভারই রেডিও/ক্যাসেটে কুরআন তিলাওয়াত শোনে। অনেকে আবার শায়খদের লেকচার শোনে। ভাঙ্গাচোরা আরবি জ্ঞানে যতটুকু বুঝি-বেশ লাগে।
যা বলছিলাম, মার্কেট থেকে হোটেলে ফেরার পথে আমাদের ট্যাক্সি ড্রাইভার পুরোটা মুখ গম্ভীর করে রেখেছিল, কিছু জিজ্ঞেস করলেও ঠিকমত উত্তর দেয় না। আবার ৩টা প্রশ্ন করলে একটার উত্তর দেয়-এমন অবস্থা। সত্য বলতে, খুব বিরক্ত হচ্ছিলাম মনে মনে! আরবদেরকে যেমন রেসিস্ট বলা হয় তেমনই কি তাহলে সত্য? আমরা বাঙ্গালী বুঝেই কি আমাদের সাথে কথা বলতে ওদের বাধছে? এমন উদ্ভট চিন্তাও মুহূর্তের জন্য মাথায় ভর করল। তাই পুরোটা রাস্তা তার সাথে কথা বলার চিন্তা বাদ দিয়ে রেডিওতে এক শায়খের লেকচার চলছিল- হজের বিধান নিয়ে, তাতে মনোযোগ দিলাম। হোটেলে পৌঁছে বিল পরিশোধ করে নামব- এমন সময় মনে হল, আরে! আমি কি একজন আহলুল মদীনার সাথে বিরক্তি নিয়ে বিদায় নিচ্ছি? এরাই কি সেই আনসারী সাহাবীদের উত্তরসূরি নয়, যারা নিজের জীবন বাজি রেখে আমার নবীজিকে নিয়ে গিয়েছিলেন, আকাবার শপথের সময় দৃঢ় কণ্ঠে ঘোষণা দিয়েছিলেন- ‘অস্ত্র আমাদের কাছে খেলনা! আমরা আপনাকে সেভাবেই রক্ষা করব যেভাবে আমরা আমাদের স্ত্রী ও সন্তানদের রক্ষা করি’… রাহিমাহুল্লাহ।
ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করলাম- আনতা আহলুল মাদীনাহ?
এতক্ষণ বিরস বদনে বসে থাকা ড্রাইভার একইরকম বিরস কণ্ঠে জবাব দিল- না’আম।
আমি কিছুটা উত্তেজিত হয়েও তা তৎক্ষণাৎ চাপা দিয়ে বললাম- ‘আহলুল মাদীনা আহলুল আনসার, আনসারু রাসুলিল্লাহ, নুহিব্বুকুম ফীল্লাহ’।
সাথে সাথে আপাতভাবে নিরস ও বিরস মনে হওয়া ড্রাইভার সাহেব একগাল হেসে ফেললেন এবং বারংবার ‘শুকরান শুকরান’ বলে ধন্যবাদ জানালেন। তিনি আমাদের মাকবুল হজের জন্যও দূয়া করলেন। সালাম দিয়ে বিদায় দেওয়ার পর এতক্ষণ ধরে মনের ভেতর চেপে রাখা ভাপটা যেন ঐ এক ‘নুহিব্বুকুম’ শব্দের সাথেই বের হয়ে গেল আর সাথে সাথে মনটা কেমন যেন খুব প্রফুল্ল হয়ে উঠল। এটাই বুঝি আহলুল মাদীনার বরকত, তাদের প্রতি ভালোবাসার প্রতিফল।
আহলুল মাদীনাদের নিয়ে আরেকটি সুখস্মৃতি রয়েছে। আমাদের দেশের বাজারগুলোতে দেখা যায় সালাতের সময় বেশিরভাগ বিক্রেতা সালাতের ব্যাপারে গাফেল থাকে। অনেকেই হয়ত দোকান বন্ধ থাকলে বা বাসায় থাকলে সালাত পড়ে কিন্তু দোকান খোলা থাকলে অথবা দোকানে কাস্টোমার থাকলেই সালাতের কথা বেমালুম ভুলে যায়। তারা আসলে ভুলেই যায় যে বরকত আসে আল্লাহর আনুগত্যের ফলে, আসবাবের মাধ্যমে নয়। অথচ আহলুল মাদীনারা এখনও এই বিশ্বাস দৃঢ়ভাবে ধারণ করে যে- রিযিকে বরকত আল্লাহর পক্ষ থেকেই আসে।
আমরা একটি দোকানে ঢুকছিলাম- জুব্বা দেখব বলে। মাত্র আযান দিয়েছে তখন, জামাত শুরু হতে আরও মিনিট পনেরো বাকি- এই চিন্তা করে ভাবলাম এই দোকানটা দেখে সালাতে যাব। কিন্তু দোকানদার দেখি তড়িঘড়ি করে কাপড় গুছাচ্ছে। আমি জুব্বা দেখব তা বলামাত্রই আগের মত হন্তদন্ত করে বলে উঠল- ‘বা’দাস সালাহ, বা’দাস সালাহ’। সুবহানাল্লাহ! আযানের পর থেকেই সালাতের ব্যাপারে উনি এতটাই সিরিয়াস যে কাস্টমারকে অবলীলায় ঘুরিয়ে দিচ্ছেন- অথচ আমাকে কাপড় দেখিয়েও উনি সহজেই সালাত ধরতে পারতেন। আমাদের দেশের অনেক মুসলিম ব্যবসায়ীদের মধ্যেও সালাতের ব্যাপারে এতটা সিরিয়াসনেস দেখা যায় না। এই দুটি ঘটনার পর আহলুল মাদীনার প্রতি আমাদের ভালোবাসা অনেক অনেকগুণ বেড়ে গেল। তাই আপনারাও যতদিন মদীনায় থাকবেন ততদিন আহলুল মাদীনার প্রতি বিরূপ আচরণ করবেন না, তাদের প্রতি সহনশীল হবেন, তাদেরকে ভালোবাসবেন এবং এই ভালোবাসার কথা জানিয়ে দিবেন। আহলুল আনসারদের প্রতি ভালোবাসা রাখা মুমিনদের দায়িত্ব এবং ঈমানের পরিচায়ক। এই আহলুল আনসারগণ তো সেই আনসারদেরই পরবর্তী বংশধর যাদের ব্যাপারে নবীজি সা: বলেছেন, “…সেই সত্তার কসম, যার হাতে রয়েছে আমার জীবন, যদি হিজরতের বিধান না হতো তবে আমিও আনসারদের মধ্যকার একজন হতাম। যদি অন্যান্য লোকেরা এক পথে চলে এবং আনসাররা অন্য পথে চলে তাহলে আমি আনসারদের পথে চলবো।…”