ইসলামী শারীয়ায় রুকইয়ার বৈধ পন্থা

আর রহমান এবং আর রহিম আল্লাহর নামে।

ইসলাম একটি পরিপূর্ণ জীবন ব্যাবস্থা। এই জীবনব্যাবস্থা শুধু আমাদের আত্মিক উন্নয়নের শিক্ষা দিয়েই থেমে থাকেনি বরং শারীরিক ও আত্মিক উভয় প্রকার অসুস্থতা এমনকি ‘জীন ধরা’, যাদুটোনা ইত্যাদির কারণ, লক্ষণ ও চিকিৎসা সম্পর্কেও বিশদ শিক্ষা দিয়েছে। জীনের আসর এবং যাদুটোনার ইসলামি চিকিৎসা পদ্ধতিকে বলা হয় ‘রুকইয়া’। ইসলামি শরীয়াহতে রুকইয়া করার পদ্ধতি সম্বন্ধে সুস্পষ্ট নির্দেশনা দেওয়া আছে এবং এগুলোর বাইরে অন্যান্য সকল পদ্ধতিই ইসলামে নিষিদ্ধ কেননা ঐসমস্ত পদ্ধতি হয় শিরক অথবা কুফর কিংবা উভয়টির দোষে দুষ্ট। সুতরাং প্রত্যেক মুমিনের জন্য ঈমানের দাবি হচ্ছে রুকইয়ার সঠিক পদ্ধতি শিখে নেওয়া।

রুকইয়ার বৈধ পদ্ধতিসমূহঃ

(১) ‘যিকর’ এবং কুরআন তিলাওয়াতঃ

অসুস্থতা ও জীনের আসর থেকে রক্ষা পাওয়ার ক্ষেত্রে এটি সর্বশ্রেষ্ঠ পদ্ধতি। এ পদ্ধতির সমর্থনে অসংখ্য দলিল-প্রমাণও ইসলামী শরীয়াহতে রয়েছে। এক্ষেত্রে ‘আয়াতুল কুরসি’-র গুরুত্ব ও ফযীলত সহীহ হাদীসে পাওয়া যায় এবং বর্তমান ও অতীতকালের বহু ‘আলিম এই আয়াতের মাধ্যমে রুকইয়া করছেন এবং করেছেন। ইবনে তাইমিয়া(রাহিমাহুল্লাহ) বলেন,

“অসংখ্য ব্যাক্তি যারা এধরনের অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছে তারা সকলেই জীন তাড়ানো এবং যাদুর বিরুদ্ধে এ আয়াত(অর্থাত আয়াতুল কুরসির) এর কার্যকারিতার ব্যাপারে নিশ্চয়তা দিয়েছেন……” [“The World of the Jinn and Devils”, pp.207-208]

তাছাড়া কুরআনের বিভিন্ন জায়গায় যাদু সংক্রান্ত আয়াত যেমন সুরা আরাফ(৭ঃ ১০৬-১২২) সুরা ইউনুস (১০ঃ ৭৯-৮২) , সূরা ত্বহা(২০;৬৫-৬৯) সুরা আল কাফিরুন, সুরা ইখলাস  এবন  আল মু’আওয়াযাতাইন (প্রত্যেকটি তিনবার করে) আক্রান্ত ব্যাক্তির উপর তিলাওয়াত করা উচিৎ অথবা কোন পানিপূর্ণ পাত্রে উপর তিলাওয়াত করা উচিৎ। আরোগ্য লাভ এবং সুস্থতার জন্যে বেশী বেশী দোয়া করা আবশ্যক। দোয়ার ক্ষেত্রে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হতে বর্ণিত নিম্নের দোয়াটিকে প্রাধান্য দেওয়া উচিৎ-

“হে আল্লাহ, মানবজাতির রাব্ব, অনিষ্ট কে দূর করো এবং আরোগ্য দান করো কেননা তুমিই আরোগ্য দানকারী। তোমার দানকৃত আরোগ্য ছাড়া আর কোন আরোগ্য নেই, এমন আরোগ্য দান করো যার পরে আর কোন রোগ অবশিষ্ট থাকে না”।

কেউ চাইলে জিবরাইল (আ), রাসুল(সা) কে রুকইয়া করার সময় যে দূয়া পড়েছিলেন সেটিও বলতে পারে-

“আল্লাহর নামে আমি আপনার রুকইয়া করছি সেসমস্ত জিনিষ থেকে যেগুলো আপনার জন্যে ক্ষতিকর, সকল ক্ষতিকর প্রাণীর অনিষ্ট থেকে এবং সকল হিংসুকের বদনজর থেকে আল্লাহ আপনাকে আরোগ্য দান করুন। আল্লাহর নামে আমি আপনার রুকইয়া করছি।

এ দোয়াটিও “কুল হুয়া আল্লাহু আহাদ” এবং “আল মুওয়াওয়াযাতাইন” এর মত করে ৩ বার পড়তে হবে।

[রেফারেন্সঃ https://islamqa.info/en/12918]

(২) আদেশ প্রদান, আঘাত করা এবং অভিশাপ দেওয়াঃ

নাবি(সা) জীন তাড়ানোর জন্যে এই কাজগুলো করতেন। জ্বীন যদি শুধুমাত্র লালসার কারণে কিংবা নিছক কষ্ট দেওয়ার কারণে কোন মানুষের উপর ভর করে তবে সেই জীনকে কুরআন ও সুন্নাহর দলিল দিয়ে সুন্দরভাবে বোঝাতে হবে যে তার এই কাজটি অনুচিত এবং জঘন্য পাপের কাজ। আর যদি মানুষের দ্বারা কোন ক্ষতির সম্মুখীন হয়ে প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য জীন ভর করে তবে তাকে বোঝাতে হবে যে এই বিষয়টি সম্পূর্ণ অনিচ্ছাকৃত। আক্রান্ত ব্যক্তি যদি তার বাসস্থানে আক্রান্ত হন, তবে জীনকে উপদেশ দিতে হবে যেন মানুষের বাসস্থানে না আসে, কারণ মানুষ নিজের বাসস্থানে নিজের ইচ্ছামত থাকতে পারে। এভাবে উপদেশ এবং দলীল-প্রমাণে কাজ না হলে জীনকে শক্তভাবে আদেশ করতে হবে, তাতেও কাজ না হলে জীনকে আঘাত করা এবং অভিশাপ দেওয়াও যেতে পারে।

(৩) পানিতে কুরআন তিলাওয়াত করে সেই পানি ব্যাবহার করাঃ

কুরআনের আয়াত ও দু’আ পানিতে পড়া এবং সেই পানি পান করা জায়েজ আছে। তাছাড়া সেই পানি দিয়ে গোসল কিংবা গা মোছাও যায়। এটার অনুমোদন পাওয়া যায় নাবি(সা) এর জীবনের শেষ মূহুর্ত থেকে। আয়েশা (রা) থেকে বর্ণিত আছে যে- “নাবি(সা) তাঁর মৃত্যুকালীন অসুস্থতার সময় নিজ গায়ে ফু দিয়ে নিলেন এবং আল মু’আওয়াযাতাইন পাঠ করলেন। যখন তাঁর ব্যাথা চরমে পৌছল তখন আমি তাঁর উপর সূরাগুলো পাঠ করতাম এবং তাঁর হস্ত মুবারক দ্বারা তাঁর গা মুছে দিতাম যাতে এর বরকত পাওয়া যায়।“

[সাহিহ আল বুখারি (৫৭৩৫) এবং সাহিহ মুসলিম (২১৯২)]

(৪) যাদুকর কর্তৃক ব্যাবহৃত জিনিষগুলো ধ্বংস করাঃ

যদি যাদুকরের ব্যবহৃত জিনিষগুলোর হদিস পাওয়া যায়(যেমন চুল, তাবিজ, গাছের পাতা-শিকড়-ডাল, পুতুল ইত্যাদি) তবে এগুলো তৎক্ষণাৎ নষ্ট করে ফেলতে হবে বা পুড়িয়ে ফেলতে হবে। এর ফলে যাদু নষ্ট হয়ে যাবে এবং যাদুকরের ইচ্ছা ব্যার্থ হবে ইনশাআল্লাহ।

(৫) ছোট বাচ্চার ক্ষেত্রে রুকইয়াঃ

ছোট বাচ্চার ক্ষেত্রে রুকইয়ার সঠিক পন্থা হচ্ছে সেই পদ্ধতি যা রাসুল(সা) হাসান ও হুসাইন (রা) এর ক্ষেত্রে করতেন।

ইবনে আব্বাস(রা) বলেন, নাবি(সা) প্রায়শই আল হাসান ও আল হুসাইন এর জন্যে আল্লাহর কাছে আশ্রয় চেয়ে বলতেন তোমাদের পিতা [অর্থাৎ ইব্রাহিম(আ)] তাঁর সন্তান ইসমাইল ও ইসহাকের জন্যে আল্লাহর কাছে এভাবে আশ্রয় চাইতেনঃ

“আমি আল্লাহর সর্বশ্রেষ্ঠ শব্দাবলির কাছে আশ্রয় চাই প্রত্যেক শয়তান, ক্ষতিকারক বস্তু ও খারাপ দৃষ্টি থেকে”। (বুখারি ৩৩৭১)

বাচ্চাদের রুকইয়া করার সময় আল মুআউইযাতাইন (কুরআনের শেষ ২ টি সূরা) পাঠ করা এবং পাঠ করার সময় তাদের গা মুছে দেওয়া, অথবা হাতে তালুতে পাঠ করে ফু দেওয়া, হালকা থথু দেওয়া এবং যতটা সম্ভব গা মুছে দেওয়া ইত্যাদি কাজ মুস্তাহাব। অথবা পানিতে সুরা পাঠ করে তা দিয়ে ধুয়ে এবং মুছে দেওয়াও যেতে পারে।

[রেফারেন্সঃ https://islamqa.info/en/104454]

এগুলোই হল ইসলামী শরীয়াহতে প্রাপ্ত রুকইয়ার বৈধ পন্থা। কিন্তু এগুলো কেবল তখনই ফলপ্রসূ হবে যখন রুকইয়া করনেওয়ালা ব্যাক্তির ঈমান দৃঢ় হব এবং আল্লাহর সাথে তার মজবুত সম্পর্ক থাকবে। এছাড়াও তার এ দৃঢ় বিশ্বাস ও থাকতে হবে যে যিকর এবং কুরআন তিলাওয়াত অবশ্যই আক্রান্ত ব্যাক্তি ও জীনের উপর প্রভাব ফেলবে। যিনি রুকইয়া করছেন তিনি যদি ঈমান ও আমলে জীন থেকে শক্তিশালী হন তবে ভাল সম্ভাবনা রয়েছে যে দুষ্ট জীনটি আক্রান্ত ব্যাক্তিকে ছেড়ে চলে যাবে।

আল্লাহই সবচেয়ে ভাল জানেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *