উঠবে যখন তারা সন্ধ্যা সাগরকূলে (৫)

দাম্পত্য রসায়নের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ Catalyst হল স্বামীর প্রতি স্ত্রীর শ্রদ্ধাবোধ। শুধুমাত্র এটুকু পড়ে আপনি নাক সিঁটকাতে পারেন যে, এই কথা কি স্ট্যাটাস দিয়ে বলা লাগে? আসলে আমি শ্রদ্ধাবোধ বলতে কী বুঝাচ্ছি সেটা খোলাসা করা দরকার। এই ‘শ্রদ্ধাবোধ’ এর অর্থ হল- স্বামীর সিদ্ধান্ত, পছন্দ ও জ্ঞানের উপর পূর্ণ আস্থা রাখা। বাস্তবতা এটাই যে আল্লাহ স্বামীদেরকে সংসারের কর্তা হিসেবে নির্ধারণ করেছেন এবং এই দায়িত্ব পালনের জন্য উপযুক্ত বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীন যোগ্যতার বীজ তাদের মাঝে বুনে দিয়েছেন। কেউ এই বীজকে মহীরুহে পরিণত করে আদর্শ স্বামী হতে পারে আবার কেউবা এই বীজকে অঙ্কুরেই বিনষ্ট করে স্বামীত্বের মর্যাদা হারিয়ে ফেলে। কিন্তু ঐ বীজের পরিণতি যাই হোক না কেন, আল্লাহ যে তাদেরকে Authority-র জন্য নির্ধারণ করেছেন এতো ধ্রুব সত্য।

বোনদেরকে বলি, “স্বামীর প্রতি শ্রদ্ধাবোধ” এর অন্তর্ভুক্ত হল- কথায় কথায় আপনার স্বামীর সিদ্ধান্তে/চিন্তায় ভুল ধরবেন না, তাকে পদে পদে সংশোধন করতে যাবেন না। যতক্ষণ সে শরীয়তের সীমারেখার মাঝে আছে এবং বড় কোন ক্ষতির ঝুঁকিতে না পড়ছে ততক্ষণ তাকে নিজের ভুল থেকে শুধরাতে দিন। আর স্বামীদের এই ক্ষেত্রে উচিৎ হল নিজের ভুল বুঝতে পারলে সাথে সাথে তা সংশোধন করে নেওয়া এবং ইগো-র বশে কিংবা স্ত্রীর কাছে “ছোট হওয়া”-র মত অহেতুক আশঙ্কা থেকে নিজের ভুলের উপর গোঁ ধরে বসে না থাকা। অনেক ভাইকে দেখেছি যারা নিজের ভুল জেনেও শুধুমাত্র স্ত্রীর কাছে ছোট হয়ে যাওয়ার ভয়ে চিল্লাপাল্লা করে নিজের মতকে প্রতিষ্ঠিত করতে চান। স্বামীদের এমন আচরণ কিন্তু তাদের আল্লাহ প্রদত্ত ঐ সম্ভাবনার বীজকে কুরে কুরে খেয়ে ফেলে।

স্বামীর প্রতি শ্রদ্ধাবোধ এর অর্থ এটাও যে আপনি সংসারে তার Authority কে চ্যালেঞ্জ করবেন না এবং এমন কিছু বলবেন না বা করবেন না যাতে আপনার স্বামীর মনে হতে পারে যে আপনি তার কর্তৃত্বের প্রতি আস্থাশীল নন। এখন বোনদের মনে প্রশ্ন আসতে পারে, “তাহলে কি ও যা ইচ্ছা করবে, বলবে আর আমি শুধু মুখ বুজে শুনব?” জ্বী না, আপনি মুখ বুঝে শুনবেন না বরং এক্ষেত্রে হিকমাহ-র সাথে আপনার স্বামীকে বোঝাতে চেষ্টা করুন। দৈনন্দিন জীবনের কথা-বার্তা, হাস্য-রসের আড়ালে আপনি তাকে বুঝতে দিন যে, তার Authority নিয়ে আপনি সন্তুষ্ট কিন্তু তার এই Authority আপনাদের পরিবারের জন্য আরও বেশি Fruitful হতে পারে যদি সে অমুক অমুক বিষয়গুলো এভাবে না ভেবে/করে ওভাবে ভাবে/করে। নিশ্চিত থাকুন, একেবারে কাণ্ডজ্ঞানহীন স্বামী ছাড়া আর কেউ এমন পরামর্শ উপেক্ষা করতে পারে না।

স্বামীর প্রতি শ্রদ্ধাবোধ বলতে এও বুঝায় যে, আপনার কিংবা আপনার স্বামীর বাবা-মা, আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী কিংবা বন্ধু-কলিগদের সামনে আপনার স্বামীকে ছোট করে কিছু বলবেন না, হোক তা আপনার স্বামীর সামনে বা পেছনে। অনেকে স্বামীর নামে টিটকারি দিয়ে বলে (কিংবা ভাবে)- “আরে এটাতো ভালোবাসার প্রকাশ!” আল্লাহর ওয়াস্তে ভালোবাসার প্রকাশ আপনারা অন্যভাবে করুন, স্বামীকে নিয়ে মজা করে (সত্যই হোক আর মিথ্যাই হোক) তথাকথিত ভালোবাসার প্রকাশ করবেন না। এই একই বিষয় স্বামীদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। আপনারাও আপনাদের স্ত্রীর শ্রদ্ধা অর্জন করতে চাইলে তার কিংবা আপনার বাবা-মা, আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী কিংবা বন্ধু-কলিগদের সামনে আপনার স্ত্রীকে ছোট করে কিছু বলবেন না, হোক সেটা তার সামনে বা পেছনে। মজার নামে স্পাউসকে নিয়ে ছোট করে কথা বলা কিংবা টিটকারি মারা ‘স্বামীত্ব’ এবং ‘স্ত্রীত্ব’ উভয়ের মর্যাদাই নষ্ট করে দিতে পারে চিরতরে।

পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ নিয়ে অনেক প্যাঁচাল পাড়লাম। ভবিষ্যতেও এই প্রসঙ্গে আবার কিছু মাথায় আসলে বলব ইনশাআল্লাহ। এই বিষয়টা আসলে এমন যে, স্বামী/স্ত্রী যেই শুনুক না কেন, মনের মধ্যে কোথায় যেন একটু চোট লাগে। কিন্তু সংসার জীবনকে রঙ্গিন করে সাজাতে হলে এই চোটটুকু নিতে ও সারাতে শিখতে হবে।

যাই হোক, এবার একটু ভিন্ন কথা বলে আজকের মত বিদায় নেব ইনশাআল্লাহ। অনেক সময় স্ত্রীগণ অভিযোগ করে থাকেন যে, তাদের স্বামীগণ অফিসে/কাজে এত বেশী ব্যস্ত থাকে যে বাসায় ফেরার পর স্ত্রী-সন্তানকে দেওয়ার মত সময় তার থাকে না কিংবা দিতে চায় না। এ নিয়ে বোনদের অভিযোগের অন্ত নেই! এটা ঠিক যে, অনেক ভাই (বিশেষত যারা পুরনো বিবাহিত) পেশাগত ব্যস্ততার পর বাড়ির চেয়ে বন্ধু মহলে আড্ডা দেওয়ার মাঝেই একটু প্রশান্তি খুঁজে পান (এর কারণও কিন্তু দাম্পত্য রসায়ন সম্পর্কে প্রয়োজনীয় জ্ঞান না থাকা) কিন্তু অনেক ভাই-ই আছেন যারা অফিসে থাকাকালীন সারাক্ষণ মুখিয়ে থাকেন কখন বাসায় ফিরে একটু বিশ্রাম নিবেন! হয়ত কাজের চাপে নির্ধারিত সময়ের চেয়ে অনেক দেরিতেই তিনি বাসায় ফিরেছেন কিন্তু তাই বলেতো বাসায় ফেরার প্রতি তার যে প্রবল আকাঙ্খা সেটাতো মিথ্যা নয়, সেখানে তো কোন খাদ নেই! তাহলে কীভাবে তার উপর এই অভিযোগ আরোপ করা যায় যে ‘স্ত্রী-সন্তানকে সে সময় দিতে চায় না’? আর স্বাভাবিকভাবেই কাজ শেষে বাড়ি ফেরার পর (বিশেষত ঢাকা শহরে) ছেলেরা এত ক্লান্ত থাকেন যে, বাড়ি ফিরেই স্ত্রীকে Hug দেওয়ার মত মানসিক অবস্থা তাদের থাকে না। তাই এই বিষয়টা স্ত্রীগণ খুব স্বাভাবিকভাবে নিবেন যে আপনার স্বামী কাজ থেকে বাসায় ফেরার পর একটু নিজের মত সময় কাটাতে চাইবে। এই সময়টার অধিকার শুধু তারই হাতে দিয়ে দিন আর আপনি যেটা করতে পারেন তা হল এই সময়ে এক গ্লাস ঠাণ্ডা পানি কিংবা ঘরের কাপড় এগিয়ে দিয়ে তার ভার কিছুটা লাঘব করুন। সে যত দ্রুত Relaxed হবে তত দ্রুতই আপনাকে Miss করা শুরু করবে! বিশ্বাস না হলে এর উপর নিজে আমল করেই দেখুন না! তাই স্বামী বাসায় ফেরার পর তার কাছে দ্রুত মনোযোগ পেতে হলে দ্রুত তার ভার লাঘব করার চেষ্টা করুন এবং বাসায় ঢোকার সাথে সাথেই তার কাছে নিজের জন্য সময় চাইবেন না কিংবা সাংসারিক, ব্যক্তিগত এবং পারিবারিক কোন ব্যাপারে অভিযোগ করবেন না।

স্ত্রীগণ মনে রাখবেন, প্রত্যেকটা সংসারের স্বামীদের মনে অন্যতম যে চিন্তা কাজ করে সেটা হল তার পরিবারের Financial Security. তার উপস্থিতিতে কিংবা অনুপস্থিতিতে তার স্ত্রী-সন্তানগণ কীভাবে চলবে এই চিন্তা প্রত্যেক স্বামীর মনে অহরহ ঘুরপাক খায়। আপনার স্বামী যে ভোর থেকে রাত পর্যন্ত গাধার খাটুনি খেটে বাসায় ফিরছে তা শুধুমাত্র এই চিন্তা থেকে নিষ্কৃতি লাভের জন্যই! তাহলে বলুন, তার এই ভোর-রাত পর্যন্ত কাজ করা নিয়ে অভিযোগ করা কি স্ত্রীদের সাজে? হ্যাঁ, আপনাদের মনে কষ্ট লাগে আর এই কষ্ট লাগাটাই স্বামীর প্রতি আপনাদের ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ কিন্তু এই ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ ভালোবাসা দিয়েই হতে হবে, বিরক্তি বা অভিমান দিয়ে নয়। তবেই আপনার স্বামী আপনার ভালোবাসা অনুধাবন করতে পারবে, অন্যথা শুধু ভুল বোঝাবুঝিই বাড়বে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *