উহুদ: এই সেই পাহাড় যা আমাদের ভালোবাসে, আমরা তাকে ভালোবাসি

মদীনায় আজ আমাদের যিয়ারাহ উহুদের প্রান্তর। আমার জন্য ২য় বার হলেও আমার স্ত্রীর জন্য এটাই প্রথম উহুদের সফর। আর তাই আমার তুলনায় তার উত্তেজনা কিছুটা হলেও বেশি। তবে হ্যাঁ, এবার উহুদের সফর নিয়ে আমি আগের চেয়ে অনেক বেশি এক্সাইটেড। কারণ, আগে যখন এসেছিলাম তখন উহুদের বিস্তারিত ইতিহাস এবং সীরাতের সাথে এর অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক খুব একটা জানতাম না। এছাড়াও এবার আমাদের কাফেলার সদস্যরা প্রত্যেকেই সচেতন এবং ইসলাম সম্পর্কে জানাশোনা মুসলিম। তাই এবারের সফরটা উপভোগ্য হবে এটা ধরেই নিয়েছিলাম।

সকাল সকাল বাস চলে আসল। তায়েফ ছিল রেগুলার প্যাকেজের বাইরের সফর আর তাই সেটার জন্য আলাদা মাইক্রোবাস নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু উহুদ সফর ছিল মদীনায় যিয়ারার অন্তর্ভুক্ত এবং রেগুলার প্যাকেজের মধ্যে-তাই এবার আমাদের বাহন ছিল বাস। যাই হোক, বাস বোঝাই করে আমরা উঠে গেলাম এবং বাসের মধ্যেই শাইখ রফিকুল ইসলাম তাঁর স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে উহুদের ইতিহাস অতি সংক্ষেপে বয়ান করলেন।  

যথাসময়ে বাস এসে থামল উহুদ প্রান্তরে। আমরা বাস থেকে নেমে আসতেই দু’একজন সহযাত্রী ভাই সবার জন্য আইসক্রিম অর্ডার করে বসলেন। সেদিন তাপমাত্রা ছিল অত্যাধিক এবং রোদ ছিল কড়া। আমরা প্রচণ্ড গরমের আইস্ক্রিম খেতে খেতে উহুদের ময়দান ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলাম। পুরো ময়দান বর্তমানে পাকা করে ফেলা হয়েছে, নিশ্চয়ই নবীজির সময়ে তা ছিল না! শাইখ আমাদেরকে চেনাতে লাগলেন যুদ্ধের ঘটনাবলী ঠিক কোথায় কোথায় সংঘটিত হয়েছিল। এবার আমি আগের সফরের তুলনায় অনেক বেশি সবকিছু রিলেট করতে পারছিলাম যেহেতু ইতিহাসটা জানা আছে এবার। এক সাথে গ্রিল দিয়ে ঘেরা শহীদদের কবরস্থান-এখানেই শুয়ে রয়েছেন হামযা রা:, হানযালা রা:, আব্দুল্লাহ ইবনে জাহাশ রা:, আমর বিন জামুহ রা:, মুসআব বিন উমায়ের রা: এর মত মহান সাহাবীরা। গ্রিলে ঘেরা কবরস্থানের মধ্যে আবার পাশাপাশি দুটি কবর খুব অল্প উচ্চতার ইট দিয়ে ঘিরে রাখা আছে। শাইখ জানালেন- কথিত আছে এই দুটি কবর হামযা ও মুস’আব বিন উমায়ের রা: এর কবর, অবশ্য তা নিশ্চিত নয়। কেননা কোনো কবরের উপরেই নামফলক দেওয়া হয়নি এবং কবর আলাদাভাবে উঁচু ও পাকা করা হয়নি। এগুলো ইসলামের বিধান নয় বলেই শ্রেষ্ঠ এই মানুষগুলোর কবরও এমন সাদামাটা রেখে দেওয়া হয়েছে-এটাই ইসলামের শিক্ষা। অথচ ইসলামের শিক্ষা থেকে দূরে সরে আজ আমরা কবর নিয়ে কত কী করছি!

দেখা হল ‘জাবালে রুমাত’। এই সেই পাহাড় যার উপরে নবীজি ৫০ জন তীরন্দাজকে নিযুক্ত করেছিলেন এবং নির্দেশ দিয়েছিলেন তারা যেন কিছুতেই সেই পাহাড় ছেড়ে না যায় কেননা, সেই পাহাড়ের পাশ দিয়ে একটি সরু খালের মত আছে (এখন খাল হয়ে গিয়েছে, তখন হয়ত শুধু রাস্তা ছিল) যেখান দিয়ে শত্রুরা মুসলিমদের আক্রমণের সুযোগ খুঁজছিল। যুদ্ধের এক পর্যায়ে মুসলিমরা জেতার উপক্রম হলে তীরন্দাজরা গণীমতের সম্পদের জন্য সেই পাহাড় ছেড়ে চলে আসে এবং করে ফেলে একটি মারাত্মক ভুল। এই সুযোগে খালিদ বিন ওয়ালিদ রা: ঘোড়া ছুটিয়ে জাবালে রুমাতের পাশ দিয়ে সৈন্য নিয়ে ঢুকে পড়েন এবং মুসলিমদের পেছন থেকে অতির্কিত ও ভয়াবহতম আক্রমণ করে বসেন। সামনে ও পেছনে থেকে আক্রমণে মুসলিম বাহিনী হতবুদ্ধি হয়ে যায় এবং তারা দিশেহারা হয়ে পড়ে। যদিও শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ কোনো জয়-পরাজয় নির্ধারণ ছাড়াই শেষ হয় তবে মুসলিমদের নিশ্চিত জয় হাতছাড়া হয়ে যায় এই একটি ভুলের কারণে। এতসব ঘটনার সাক্ষী জাবালে রুমাত দেখে চোখ ফেরাতে মন চায় না। মাঝে মাঝে অবাক হয়ে ভাবি- আল্লাহ কি সত্যিই আমাকে এসব দেখাচ্ছেন? আমার মত গুনাহগারকে প্রিয় নবীর স্মৃতিবিজড়িত পুণ্যভূমিতে নিয়ে এসেছেন? এসবই কি সত্যি না ঘোর!

শাইখ জানালেন, জাবালে রুমাত একসময় অনেক উঁচু পাহাড় ছিল, কিন্তু মানুষ এখানে এসে অজ্ঞাত কারণে পাহাড়ের পাথর নিয়ে যেতে যেতে এখন পাহাড় অনেকটা ছোট হয়ে এসেছে। বর্তমান অবস্থা দেখলে সেটাকে পাহাড় ভাবা কঠিন হবে, বরং ‘একটু উঁচু’ টিলা মনে হওয়াই স্বাভাবিক। উহুদের প্রান্তর দেখা হল, শহীদগণের কবর যিয়ারত হল কিন্তু একটি জায়গা বাকি রয়ে গেল।

উহুদ যুদ্ধের একেবারে শেষ পর্যায়ে যুদ্ধ থেমে আসলে সাহাবীগণ রাসূল সা: কে নিয়ে পাহাড়ের একটি গর্তের মধ্যে আশ্রয় নিলেন, তখন বিধ্বস্ত মুশরিক বাহিনীর সর্দার আবু সুফিয়ান নবীজির খোঁজ করার জন্য বের হলেন এবং ঐ গর্তের খুব কাছাকাছি চলে আসলেন। সেখানে এসে সে বলল, ‘তোমাদের মধ্যে মুহাম্মাদ আছে কি?’ মুসলিমরা কোন উত্তর দিলেন না। সে বললো, ‘তোমাদের মধ্যে আবু কুহাফার পুত্র আবু বকর আছে কি?’ এবারও তারা কোন জবাব দিলেন না। সে পুনরায় প্রশ্ন করল, ‘তোমাদের মধ্যে উমর ইবনুল খাত্তাব আছে কি?’ সাহাবিগণ এবারও উত্তর দিলেন না কারণ রাসূল ﷺ তাদেরকে জবাব দিতে নিষেধ করেছিলেন। আবু সুফিয়ান এই তিনজন ছাড়া আর কারও কথা জিজ্ঞেস করলেন না কারণ সে ভালোভাবেই জানত ইসলামের প্রচার ও প্রসারে এই তিনজনের ভূমিকা কোন পর্যায়ের! যখন কোনো উত্তর পাওয়া গেল না তখন সে বলল, ‘চলো যাই, এই তিনজন হতে অবকাশ লাভ করা গেছে’।

একথা শুনে উমার ধৈর্য হারিয়ে ফেলেন এবং বললেন, ‘হে আল্লাহর শত্রু! যাদের তুই নাম নিয়েছিস তারা সবাই জীবিত আছেন এবং এখনও আল্লাহ তোকে লাঞ্চিত করতে বাকি রেখেছেন’। আবু সুফিয়ান বলল, ‘তোমাদের নিহতদের অঙ্গ-প্রতঙ্গ বিকৃত করা হয়েছে কিন্তু এরূপ করার কোনো হুকুম আমি করিনি তবে এটাকে খারাপও ভাবি না’। এরপর সে চিৎকার করে বলল, ‘হুবাল সুউচ্চ’! রাসূল ﷺ সাহাবিদেরকে বললেন, “তোমরা জবাব দাও”। তারা বলল, ‘হে আল্লাহর রাসূল! আমরা কী জবাব দেব?’ তিনি বললেন, “তোমরা বল, ‘আল্লাহ অতি সম্মানিত’”। আবু সুফিয়ান চিৎকার করে বলল, ‘আমাদের জন্য উযযা রয়েছে তোমাদের কোন উযযা নেই’। তখন নবী করিম ﷺ আবার সাহাবিদেরকে বললেন, “তোমরা উত্তর দিচ্ছ না কেন?” সাহাবাগণ বলল, ‘আমার কী উত্তর দেব?’ রাসূল ﷺ বললেন, “তোমরা বল, ‘আল্লাহ আমাদের মাওলা এবং তোমাদের কোনো মওলা নেই’”। তখন আবু সুফিয়ান বলল, ‘কতইনা ভাল কাজ হলো। আজকের দিনটি বদর যুদ্ধের প্রতিশোধ আর যুদ্ধ হচ্ছে বালতির ন্যায়’। অর্থাৎ বালতি যেমন একবার একজন টেনে তোলে আরেকবার অন্যজন ঠিক তেমনি যুদ্ধে কখনো একদল জয়যুক্ত হয় এবং কখনো অন্যদল। তখন উমার রা: বললেন, ‘সমান নয় কেননা আমাদের নিহতরা জান্নাতে আছেন আর তোমাদের নিহতরা জাহান্নামে আছে’।

আবু সুফিয়ান বলল, ‘আমার নিকট এস’। রাসূল ﷺ তাকে বললেন, “যাও, দেখো সে কী বলে!” উমার রা: উঠে গেলে আবু সুফিয়ান তাকে বলল, ‘আমি তোমাকে আল্লাহর নাম দিয়ে জিজ্ঞেস করছি, আমরা কি মুহাম্মদকে হত্যা করতে পেরেছি?’ উমার বললেন, ‘আল্লাহর কসম না! বরং এখন তিনি বসে বসে তোমাদের কথা শুনছেন!’ তখন আবু সুফিয়ান বললো, ‘তুমি আমার নিকট ইবনে কামিয়া হতে অধিক সত্যবাদী’। আবু সুফিয়ান ফিরে যাওয়ার সময় মুসলিমদেরকে বলল, ‘আগামী বছর আবার যুদ্ধের প্রতিজ্ঞা থাকল’। রাসূল ﷺ এক সাহাবিকে বলতে বললেন, “তুমি তাকে বলে দাও, ‘ঠিক আছে। এখন আমাদের ও তোমাদের মাঝে এই সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত হয়ে গেল’”।

শাইখ জানালেন উনি মদীনা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন সময়ে উহুদ পাহাড়ের ঐ স্থানটি দেখতে গিয়েছিলেন যেখানে আবু সুফিয়ানের সাথে সাহাবীদের এই কথা চালাচালি হয়। স্থানটি উহুদের মূল ময়দান থেকে বেশ খানিকটা দূরে এবং পাহাড়ের উপরে হওয়ার কারণে যাওয়া হল না। তবে প্রবল নিয়্যাত করলাম ভবিষ্যতে কখনও আল্লাহ নিয়ে আসলে সর্বোচ্চ চেষ্টা থাকবে স্থানটি খুঁজে বের করে দেখার।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *