কঠোরতা বনাম কোমলতা

আমাদের মা-বাবাদের কিংবা নানী-দাদীদের জেনারেশনের একটা কমন সমস্যা খেয়াল করেছি যে, উনারা সন্তানদেরকে বকাঝকা কিংবা মারপিট করার সময় একটা খোঁড়া লজিক দেখান: আমরাতো তোদের কিছুই বলিনা, আমাদের মা-বাবারা পান থেকে চুন খসলেই আমাদের মেরে বিছিয়ে ফেলতো, লাঠি নিয়ে বসে থাকতো, পিঠের ছাল তুলে ফেলতো, ব্লা ব্লা ব্লা…..

এই ধরণের লজিকের বিপরীতে যেটা বলা যায়, সেটা হচ্ছে: আপনাদের যুগে ঘরে ঘরে আবুলের মত বউ পেটানো স্বামী ছিলো, ছেলের বউকে কাজের মেয়ের মত সকাল সন্ধ্যে খাটানোর মত শাশুড়ি ছিলো, এটা যেমন খারাপ, তেমন বাবা-মায়েরাও কথায় কথায় সন্তানদের মারধর করতেন, এটাও খারাপ। আপনি নবী-রাসূলদের উদাহরণ দিতে পারেন, আসহাবে রাসূল কিংবা সালাফদের উদাহরণ টানতে পারেন, যারা ছিলেন সত্যিকারেই আদর্শ, কিন্তু পূর্বপুরুষের মন্দ কাজের রেফারেন্স টানার হেতু কী? আল্লাহর রাসূলের জীবনে আমি তো এমন কোন ছোট্ট ঘটনাও পাইনি, যেখানে তিনি স্ত্রীদের গায়ে হাত তুলেছেন কিংবা সন্তানদের গায়ে। বরং যে যুগে বাচ্চাদের মুখে চুমু খাওয়াকেও অশোভন মনে করা হত, তিনি সেই যুগেও তা করে দেখিয়েছেন, যে যুগে নারীকে/কন্যাসন্তানকে অভিশাপ মনে করা হতো, সেই যুগেই তিনি নারীর পদতলে সন্তানের জান্নাতের ঘোষণা দিয়ে গেছেন….

যুগের পালাবদলের হাওয়া খারাপ, তবে সব বদল কিন্তু একচেটিয়াভাবে খারাপ না। যেটা খারাপ সেটা বর্জন করা যেমন উচিৎ, যেটা উত্তম সেটা গ্রহণ করাও কর্তব্য বলে মনে করি। ভাবতে ভালো লাগে যে, এক জেনারেশন আগেও মা-খালাদের, চাচী-ফুপুদের এক জায়গায় বসলেই শ্বশুরবাড়ির নির্যাতনের বর্ণনা কিংবা স্বামীদের স্বামীসুলভ প্রভুত্বের বর্ণনা আর চোখের পানি দেখতে হতো, এ যুগে তা পুরো না গেলেও কিছুটা হলেও বদলেছে। এই আমরাও ৮/১০ টা বিবাহিত ফ্রেন্ড একসাথে গল্প করতে বসলে দেখি: ৬০% শাশুড়িই এখন ‘ভালো শাশুড়ি’, ৮০% স্বামীই এখন স্ত্রীর প্রতি সহানুভূতিশীল। যুগের এই বদল মন্দ কোথায়??

আগের যুগের স্ত্রীরা স্বামীর প্রতি যেমন অভিযোগপরায়ন ছিলো, স্বামীরাও তেমন প্রভুসুলভ ডমিনেইটিং, বাবা মায়েরাও তেমন মারমুখী; কারণ গুড স্পাউজিং, গুড প্যারেন্টিং সম্পর্কে কারো কোন ধারণাই ছিলোনা, তাই বেলা শেষে প্রত্যেক স্বামীর/প্রত্যেক স্ত্রীর কমন ডায়ালগ: আমি বলে তোমার সাথে সংসার করে গেলাম, আর কেউ হলে কবেই চলে যেতো। কিংবা জীবনের শেষপর্যায়ে এসেও কিছু সন্তানের মনে শৈশবের কষ্টটা থেকে যায়: ইস! আমার বাবা/মা যদি এমনটা না করতো! কিংবা ঘুমের ঘোরে স্বপ্নেও ছোটবেলার মত মা-বাবার বকা খেতে খেতে ঘুম ভেঙে যায়; ছোটবেলার কিছু নেগেটিভ স্মৃতির ইমপ্রিন্ট যে আজীবনেও মোছা যায়না…

ভালো লাগে যখন দেখি, বিয়ের আগেই এখন দ্বীনি ভাই বোনেরা ‘মারাইটাল লাইফ’ নিয়ে পড়াশুনা করছে, ইউটিউব থেকে লেকচার নামাচ্ছে। কিংবা বাবা মায়েরা সন্তানের পিতা মাতা হওয়ার আগেই ‘প্যারেন্টিং’ নিয়ে কিংবা ‘চাইল্ড সাইকোলজি’ নিয়ে পড়াশুনা করছে, শাশুড়িরাও ভাবছে: আমি যেভাবে কষ্ট পেয়েছি, আমার বউটাকে তেমন কষ্ট পেতে দেবোনা। ভালো লাগে শিবলী মেহেদী ভাইয়ের মত বাবাদের কিংবা ‘শিশু লালন পালন’ এর মত পেইজগুলো দেখে, আফরোজা হাসান আপুর মত লেখিকাদের শুদ্ধ অনুভূতির লেখাগুলো পড়ে….হু, যুগের এই পরিবর্তনটা কাঙ্ক্ষিতই।

বলছিনা, সন্তানকে শাসন করা যাবেনা, অবশ্যই করতে হবে, তবে সাইকোলজিটা বোঝাও জরুরী। যদি কোমলতা দিয়ে কাজ হয়, তবে কঠোরতা কেন? আল্লাহর রাসূল তো এটাই বলে গেছেন: নম্রতা, কোমলতা যা কিছুর সাথে থাকে, তাই তাকে সৌন্দর্যমণ্ডিত করে….

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *