সেদিন এক ছোটবোন জানতে চাইলো: আপু, ইন্টার্নীতে গিয়ে সবাই কেন স্টাইলিশ হয়ে যায়? যে আপুটা নিক্বাব করতো, উনি নিকাব ছেড়ে দিয়েছেন, যে আপুটা সবসময় হিজাব করতো, সেও দেখা যায় ঠোঁটে লিপস্টিক, চোখে কাজল লেপ্টে ডিউটিতে আসছে। এক আপুকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, উনি উত্তর দিলেন, সাজগোজ না করলে পাত্তা পাওয়া যায়না, তাই…. আসলেই কি তাই??
শুনে চমৎকৃত হলাম, কথায় কিঞ্চিৎ সত্যতা আছে বটে। বললেম: শোন, গতকাল নাইট ডিউটিতে যাওয়ার জন্য যখন বেরোই তখন ইলেক্ট্রিসিটি নেই, অন্ধকারে আবায়া উল্টো পরেই ডিউটিতে চলে গেলাম, যথারীতি হাসপাতাল এরিয়ায় প্রবেশের পর তা আরেক কলিগের দৃষ্টিগোচর হলো:
কি রে, বোরখা উল্টো পরেছিস, না ডিজাইনটাই এমন?
এবার নজরে এলো, বললাম: আপাতত এটাই নিউ ডিজাইন ধরে নে, বাকিটা পরে শুনিস।
ডিউটি রুমে ঢোকার পর মনে হলো, ধুর, রাত কাটতে আর কতক্ষণ? যা আছে তাই থাক, যে যা ভাবে ভাবুক….
মেডিসিনে ডিউটি করার সময় এক কলিগ ফান করে বলছিলো: তুই এমন বুড়া কালারের বোরখা পরিস কেন? অমুকের মত স্ট্যান্ডার্ড জিনিস পরতে পারিস না?
বলেছিলাম: স্ট্যান্ডার্ড সম্পর্কে আমার আইডিয়া নেই ভাবলে ভুল করবি, পরতে পারিনা তা না, বলতে পারিস, পরিনা, কেন পরিনা, সেটারও ব্যাখ্যা আছে। হিজাবের উদ্দেশ্যই আসলে….
সেদিন এক মিড লেভেলের ম্যাডাম আমার মলিনরঙা এপ্রোন দেখে বললেন: এপ্রনের বয়স কতদিন রে?
– অনেকদিনই হলো, চলছে চলুক।
– মজার ব্যাপার হচ্ছে, আমার মেডিকেলের পাচ বছরেই এপ্রন ছিলো ১২ টা, নিজে বানিয়েছি, গিফটও পেয়েছি।
নিরব রইলাম, মনে মনে ভাবছিলাম: আলহামদুলিল্লাহ, আমার তিনটা এপ্রনেই ছ’বছর কেটে যাচ্ছে, আপনার ১২ টি এপ্রনের গল্প অনেকের কাছে মুখরোচক হলেও আমার কাছে তা ‘অনর্থক বিলাসিতা’ ছাড়া আর কিছুই নয়….
তো যেটা বলছিলাম: পোশাকের স্বাতন্ত্র্য আপনার নিজের কাছে, কে কি ভাবছে তারচে বড় ব্যাপার আপনি নিজেকে কিভাবে উপস্থাপন করতে চান। শুনেছি এক স্যার ছিলেন, ঢাকার এক সরকারি মেডিকেলের নামকরা প্রফেসর, উনি সারাজীবন স্পঞ্জের স্যান্ডেল পরেই ক্লাস নিয়েছেন, কোনদিন অফিসিয়াল জুতা পরেননি, তাতে তার খ্যাতি কমেছে বলে শুনিনি, বরং এটাই ব্যতিক্রমী গল্প হয়ে আমাদের কান পর্যন্ত পৌঁছেছে। সুতরাং, আমি যখন আমার ডক্টর’স রুমে এসে বসেছি, তখন আমি দুই লেয়ারের মেকাপ মেখে এসেছি নাকি ছেড়া জুতা পরে এসেছি, এটা নিয়ে পেশেন্টের মাথাব্যথা হওয়ার কথা না, এই রুমে যে থাকে, সে ডক্টর, তার কাছে Rx এর প্রয়োজনেই আসতে হয়, এই বিষয়টা অশিক্ষিত মূর্খ রোগীও জানে…. প্রাইভেট মেডিকেলে জবের ব্যাপার হলে আলাদা কথা, ওরা হয়তো সৌন্দর্য কিংবা স্মার্টনেস দেখে নিয়োগ দিতে পারে, কিন্তু আমাদের এখানে অন্তত নয়।
আর যদি বলেন, ‘পাত্তা পাওয়া যায়না’, তবে প্রশ্ন আসবে: আপনি কোন ধরণের পাত্তা পেতে চান। আপনি যখন পোশাকে ইসলামিক এটিকেট মেইন্টেইন করে চলেন, তখন আপনার পুরুষ কলিগ কিংবা স্যারেরা আপনার সাথে লুতুপুতু আলোচনা করবেনা, আপনার পেছনে আপনাকে ‘মাল’ বলে মজা নেবেনা, ইয়াং পেশেন্ট কিংবা ইয়াং এটেন্ড্যান্ট একবারের জায়গায় তিনবার অযাচিত প্রব্লেম নিয়ে আপনার কাছে সল্যুশন চাইতে আসবেনা, ইভেন রাস্তায় কিংবা দোকানে গেলেও দোকানীরা আপনাকে দেখে আগ বাড়িয়ে হেল্প করতে আসবেনা, এটাই সত্য…. এখন এই ধাচের ‘এক্সট্রা খাতির’ যদি আপনার কাছে ‘পাত্তা’ মনে হয়, তবে আমি মনে করি, ঐ ‘পাত্তা’ আমরা কখনোই চাইনা, আলহামদুলিল্লাহ। ব্যক্তিত্ব বিকিয়ে দেয়ার জিনিস নয়, ধরে রাখার জিনিস, আর হিজাব তার পার্ফেক্ট ধারক। সবচে বড় কথা, হিজাবের উদ্দেশ্যই হচ্ছে: আল্লাহর সন্তুষ্টি, হিজাবের সংজ্ঞাই হচ্ছে নিজের সৌন্দর্যকে প্রকাশ না করে লুকিয়ে রাখা। এই কথাটা যে অনুভব করতে পারে, সে জানে এই সংজ্ঞা কিংবা উদ্দেশ্য স্থান-কাল ভেদে বদলে যায়না, অন্তত বেসিকটা বদলে না: কেউ ব্যাংকার হোক আর ইন্টার্ন ডক্টর হোক, পদবীর পরিবর্তনের সাথে হিজাবের নামে ঠোঁটে লিপস্টিক, মুখে ময়দা, চোখে কাজল লাগানোর বৈধতাও অর্জিত হয়ে যায়না….