কাজে মগজ এবং অন্তর ভিজে

আগের দিনে মানুষের একজায়গা থেকে আরেক জায়গায় যেতে বিস্তর সময় লেগে যেত। পথে পথে সরাইখানা ছিল। মানুষ লম্বা পথ পাড়ি দিয়ে সন্ধ্যায় সরাইখানাতে বিশ্রাম নিত এবং পরদিন আবার যাত্রা শুরু করত। সরাইখানাতে খাবার দাবারেরও ব্যবস্থা থাকত।  ইন্ডাস্ট্রিয়াল রেভ্যুলুশানের পর যন্ত্র আবিষ্কার মানুষের সফর এবং যাতায়াতগুলোকে আরামদায়ক করে দিয়েছে। যাইহোক, এক ব্যবসায়ী এরকম এক সরাইখানাতে বিশ্রাম নেয়ার জন্য যাত্রা বিরতি করল। তার সাথে ছিল মালামাল বোঝাই করা একটা গাধা। সাধারণ পোশাক আশাক আচ্ছাদিত এক মধ্যবয়সীও সেই সরাইখানা বিশ্রামের জন্য যাত্রাবিরতি করল। এক দস্তারখানে খেতে খেতে দুজনের মধ্যে বেশ খোশগল্প হল। ব্যবসায়ী নিজেকে সফল ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচয় দিয়ে বেশ তৃপ্তি বোধ করল। মধ্যবয়সী গাধার দু পাশে দুটো বস্থা দেখে জানতে চাইল, বস্তাগুলোতে কি আছে? ব্যবসায়ী খুশিমনে জবাব দিল- একটিতে কাপড় আছে, আর অপর বস্তায় আছে বালি। ‘বালি?’ হ্যাঁ। বালি। গাধাটা চলতে যেন যথাযথ ভারসাম্যতা পায় সেজন্য আরেকপাশে বালি দিয়ে যাত্রা করতে হয় এবং গত বিশ বছর ধরে আমি এই ভাবেই এক শহর থেকে আরেক শহরে পণ্য আনা নেওয়া করছি।

লোকটি বেশ আর্শবাযানবিত  হল। মুখে মিটিমিটি হাসি দিয়ে ব্যবসায়ীকে বলল- আপনি শুধু এই অবলা প্রাণীটিকে কষ্ট দিলেন। আপনি কাপড়ের বস্তাটাকে সমান দুইভাগ করলেই তো হত। গাধাটি দ্বিগুণ ভারও বইতে হতো না আর আপনাকে সফরে কষ্ট করতে হত না।

ব্যবসায়ীটি বেশ অবাক হলো। আরে! এই ছোট্ট চিন্তাটাতো গত বিশ বছর আমার মাথায় আসেনি। সত্যি আপনি বেশ বুদ্ধিমান। মনে হচ্ছে আপনি বেশ ভালো  একজন ব্যবসায়ীও বটে। আপনি কি অমুক শহরে ব্যবসা করেন? নাকি ঐ শহরে? নাকি আমার পাশের শহরে? এভাবে ব্যবসায়ীর বারবার প্রশ্নের উত্তরে লোকটি না’সূচক জবাব দিল। লোকটি বলল। আমি সাধারণ একজন মানুষ। বিভিন্নসময় লোকেরা দয়া করে যা দেয় তা দিয়েই আমার পেট চলে। এই শহর থেকে ঐ শহরে  ঘুরে বেড়াই। মসজিদ, খানকাহ, সরাইখানাতেই আমার জীবন কাটে।

এসব কথা শুনার সাথে সাথে ব্যবসায়ীর চেহারা পরিবর্তন হয়ে গেল। লোকটিকে ভৎসনা করে বলল-

তাহলে রাখেন আপনার জ্ঞান বিতরণ। এই জ্ঞান দিয়ে নিজে কিছু করতে পারেননি আবার আমাকে জ্ঞান দিতে আসছেন। আমি আমার মতই গাধার পিঠে বালিসহ মালামাল নিয়ে যাবো। এভাবে ব্যবসা করেই আমি সফল হয়েছি। কোন অসফল ব্যক্তির জ্ঞান-পরামর্শ আমার প্রয়োজন নেই।  

গল্পটি শুনতে কিছুটা বোকামানুষের গল্প মনে হতে পারে। আদৌ কি এত বোকা মানুষ হয়? মাওলানা রুমি তার একটি বইতে এই গল্পটি উল্লেখ করেছেন। তাই সত্যাসত্য নিয়ে খামোখা তক্কাতক্কি না করে এটার গূঢ় শিক্ষাটা বোঝা জরুরী।

আমাদের সমাজ শুধু নয়, প্রত্যেকটি সমাজেই মানুষ সফলদের শুনতে চায়। সফলদের নিয়ে নাচে, তাদের গুরুত্ব দেয়, চেয়ার এগিয়ে দেয়। আপনার অসফলতা দৃশ্যমান হলে মানুষ আপনাকে গ্রহণে অপারগতা প্রকাশ করে। আপনি যতই হক কথা বলেন,  সঠিক নির্দেশনা দেন, যথাযথ রাস্তা বাতলান, মানুষ আপনাকে গ্রহণ করবে না। মানুষ তার সফলতার বাটখারাতে আপনাকে দাঁড় করিয়ে যদি মনে হয় আপনিও তাকে তুষ্ট করতে পেরেছেন কেবল তখনই সে আপনাকে মেনে নেবে, মনে নেবে। অন্যথায় যৌক্তিকতা এবং সঠিকতার বিচারে আপনাকে মেনে নিলেও মনে নেবে না।

আমরা যখন ইসলাম নামক জীবন দর্শন এবং ব্যবস্থা মানুষের সামনে  উপস্থাপন করতে চাই, সেক্ষেত্রে এই ব্যাপারটি মনে রাখা আবশ্যক। আপনি বক্তব্যের মাধ্যমে ইসলামের সঠিকত্ব, মহত্ত্ব, শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে যতই আলাপ করুন না কেন, দিন শেষে মানুষ এমন একটা ব্যবস্থা তার জন্য চায় যা বাস্তবিকভাবে তার সমাধান দেবে। কিছু গালভরা বুলি, ভালো ভালো কথা, নিয়মসর্বস্ব প্রথা তাদেরকে ইসলামের ব্যাপারে আগ্রহী করবে না। প্রথমত তারা প্রাত্যহিক এবং সমসাময়িক সমস্যার সমাধান দেখতে চাইবে অতঃপর  তারা সেসবের বাস্তবায়ন  দেখতে চাইবে। নববী ইতিহাসের পৃষ্ঠা উল্টালেও আপনি এ ব্যাপারটি লক্ষ্য করবেন।

রাসুলুল্লাহ সঃ যখন মক্কায় হকের দাওয়াত দেয়া শুরু করেন, তখন প্রথমত তিনি তাওহীদের সাথে সাথে তাদের সমসাময়িক বিষয়াদি এবং অধিকারগুলো নিয়েও কথা বলেন। দাসপ্রথার মত তৎকালীন সমাজে সর্বজন স্বীকৃত প্রথা নিয়ে তিনি সোচ্চার হন। সাথে সাথে ওজনে কম দেয়া, সুদের মত বিষয়গুলো তিনি পাবলিক স্ফেয়ারে নিয়ে আসেন। ফলাফলে তখনকার মানুষরা বুঝতে পারে ইসলাম কেবলমাত্র কিছু সময়ে সময়ে রীতিনীতি পালনের রেওয়াজ নয়, বরং এটা মানুষের সমস্যা সমাধানের একমাত্র আওয়াজ।

রাসূলের মক্কাকালীন জীবনে যদিও ত্রানকর্তা হিসেবে ইসলামের আবির্ভাব ঘটেছে এবং কিছু লোক এ দাওয়াতে লাব্বাইক বলে হকের পথে শামিল হয়েছে তবে ইসলামের বিস্তীর্ণ ক্ষেত্রে মানুষের ঢল নামে মদীনার জীবনে এসে। মক্কার তের বৎসরের জীবনে যেখানে মুসলমানদের সংখ্যা ছিল শয়ের কোঠায় সেখানে মদীনার জীবনে এক বৎসরের মধ্যে মুসলিমদের সংখ্যা হাজারের ঘরে চলে যায়।কারণ মদীনার জীবনের রাসূল প্র্যাকটিক্যাল ইসলামকে মানুষের সামনে উপস্থাপন করেছেন। শুধু কথা নয় বরং কাজেকর্মে মানুষ বুঝতে পেরেছে ইসলাম কিভাবে সমাজকে পরিবর্তন করে কিংবা করতে চায়। এরপর সময়ের সাথে সাথে মানুষ যতই ইসলামকে দেখেছে ইসলামের সত্যিকার উদ্দেশ্য বুঝতে পেরেছে এবং দলে দলে লোকজন ইসলামকে আপন করে নিয়েছে। খোলাফায়ে রাশেদীনের সময়ে ইসলাম এমন একটা অবস্থায় চলে যায় যে মোটামুটি অর্ধ পৃথিবীর মানুষ ইসলামী সমাজের অন্তর্ভূক্ত হয়ে যায় এবং ইসলামকে স্বাগত জানায়। আজকের জামানায়, কথায় আর চিড়ে ভিজে না। বরং যথাযথে কাজ মানুষের মস্তিষ্ক এবং অন্তরকে সিক্ত করে। আপনি কাজের মাধ্যমে মানুষের হৃদয়ে জায়গা করে নেবেন। তাই ইসলামকে নিজ জীবনে বাস্তবায়িত করে আরেকজনকে ইসলামের সৌন্দর্য অবগাহন করতে বলুন। সমাজকে ইসলামের রঙ্গে রাঙ্গিয়ে মানুষকে ইসলামের সমাজ গঠন করার জন্য বলুন। রাসূলের মাদানী জীবন, খোলাফায়ে রাশেদা এবং পরবর্তী ইসলামী রাষ্ট্রের যথাযথ উপস্থাপনা মানুষকে ইসলামের দিকে ঝোঁকাতে পারে। ইসলামের  পবিত্রতা,সঠিকতা,প্রামান্যতা মানুষকে ইসলামের ব্যাপারে দৃষ্টি ফেরাতে পারে কিন্তু আগ্রহী এবং সদস্য করবে না। সে আপনাকে মেপে ইসলামকে মাপবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *