মক্কায় যখন মহানবী (সঃ) ইসলামের প্রচার শুরু করেছিলেন তখন কাফির মুশরিকরা এ বিপ্লবী প্রচার বন্ধ করার জন্য উঠে পড়ে লাগে। ইসলামের দাওয়াতের পথ রোধ করার জন্য তারা তাদের গুরু মস্তিষ্কের যথেষ্ট ব্যায়াম সম্পাদন করে। মহানবী সঃ কে নিষেধ করা,আপোস করা,ব্যংগ বিদ্রুপ করা,ভয় দেখানো কিছুই তারা বাদ রাখেনি।তাদের এসকল কর্মসূচির একটা অন্যতম অংশ ছিল সাংস্কৃতিক কর্মসূচী।মানুষকে কিচ্ছা কাহিনী,গান,বাদ্য বাজনা, আনন্দ সম্ভোগে মগ্ন রেখে তাদেরকে চিন্তা চেতনার দিকে পঙ্গু করে রাখা যাতে তারা যেন কোন গুরুতর বিষয়ের প্রতি মনোযোগ দিতে না পারে যা কুরআন ও মুহাম্মদ (সঃ) তাদের কাছে পেশ করছিলেন।
ইবনে হিশাম সীরাতে মুহাম্মদ বিন ইসহাকের বর্ননা উদ্ধৃত করে বলেন,বনী আবদুদ্দারের নদর বিন আল হারেস বিন কালাদা কুরাইশের এক সমাবেশে বলে,তোমরা মুহাম্মদের সঃ মুকাবেলা যেভাবে করছ তার কোন ফল হবেনা। মুহাম্মদ সঃ যখন যুবক ছিলেন তখন তিনি তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে অমায়িক ছিলেন,সবচেয়ে সত্যবাদি, বিশ্বস্ত ছিলেন। এখন যখন তাঁর চুল শ্বেতবর্ন ধারন করেছে তখন তিনি তোমাদের নিকটে এমন জিনিস এনেছেন যে তোমরা তাকে বলছ যাদুকর,গনক ,কবি ও পাগল। খোদার কসম তিনি যাদুকর নন,আমরা যাদুকর দেখেছি তাদের ঝাঁড়ফুঁকও দেখেছি। খোদার কসম তিনি গনক নন। আমরা গনকের নীরস ছন্দোবদ্ধ কথা শুনেছি। সে যে আবোল তাবোল কথা বলে তাও আমাদের জানা আছে। খোদার কসম তিনি কবিও নন। কবিতার সকল ধারা পদ্ধতিও আমাদের জানা আছে। তাঁর কালাম এসবের কোন ধারায় পড়েনা। খোদার কসম তিনি পাগল নন।পাগলের যে অবস্থা হয়ে থাকে যে ধরনের অর্থহীন কথা বিড়বিড় কড়ে বলে তা কি তোমাদের জানা নেই? হে কুরাইশ সর্দারগন! অন্য কিছু উপায়চিন্তা করে দেখ। যে জিনিসের মুকাবেলা তোমাদের করতে হবে তা এর চেয়ে অনেক গুরুতবপূর্ন যে তোমাদের কিছু রচনা করে তাকে পরাজিত করতে চাও।
তারপর সে প্রস্তাব করে যে অনারব দেশ থেকে রুস্তম ও ইসফেয়ান্দরের কেচ্ছা কাহিনী সংগ্রহ করে এনে ছড়ানো হোক যাতে লোক এর প্রতি অনুরক্ত হতে থাকে এবং তা তাদের কাছে কুরআন থেকে অধিক বিস্ময়কর মনে হয়।তারপর কিছুদিন এ কাজ চলতে থাকে এবং স্বয়ং নদর কেচ্ছা কাহিনী শুনাতে থাকে।
ইবনে আব্বাস রাঃ বলেন নদ র এ উদ্দেশ্যে গায়িকা দাসী ও খরিদ করেছিল।যখনই সে এ কথা শুনত যে অমুক নবি সঃ এর কথায় প্রভাবিত হয়ে পড়ছে , তখনই তার পেছনে সে একজন দাসী লাগিয়ে দিত এবং তাকে বলতো তাকে খুব ভালো করে যত্ন করে খেতে দাও এবং গান শুনাতে থাক, যাতে তোমাকে নিয়ে মত্ত থেকে তার মন যেন ওদিক থেকে সরে আসে।
২।
যুগে যুগে শয়্তান বিভিন্ন চেহারা মানুষকে ধোঁকা দেওয়ার জন্য আসলেও তাদের কর্ম পদ্ধতি মোটামুটি একই থাকে। যে পদ্ধতিতে আদম আ ও হাওয়া আঃ কে ধোঁকা দিয়েছে ঠিক সে পদ্ধতিতেই মানুষকে ধোঁকা দিচ্ছে।১৪৫০ বছর আগে যেভাবে ইসলামের প্রচার প্রসার আন্দোলনকে বন্ধ করতে চেয়েছিল আজো ঠিক মানুষকে ইসলাম বিমুখ করে রাখার জন্য কাফির মুশরিকরা ঠিক একই ফর্মুলায় কাজ করছে। বিভিন্ন ইলেট্রনিক প্রিন্ট মিডিয়াতে তাদের শয়তানী দাওয়াত অনর্গল দিয়ে যাচ্ছে। বস্তা পঁচা উপন্যাস পড়ে আমরা সময় নষ্ট করছি। নাচ গানের মাধ্যমে মানুষকে ভুলিয়ে রাখা হয়েছে আখিরাতকে। এ মিডিয়ার মাধ্যমে মানুষ সম্মোহিত,আর কাফির মুশরিক শ্রেনী ঠিক সে জিনিসটাকেই কাজে লাগিয়ে আমাদের জ্ঞান বুদ্ধি বিবেককে তাদের ছাঁচে গড়ে তুলছে।আর পশ্চিমারা মিডিয়ার মাধ্যমে বস্তুবাদের বীজ এমনভাবে মানুষের মন মস্তিষ্কে ঢুঁকিয়ে দিচ্ছে যে মানুষ আজ আখিরাতকে পুরোপুরি ভুলতে বসেছে। দুনিয়াকেই তারা সর্বস্ব বিবেচনা করে মিথ্যা স্বপ্নে বিভোর। কবি আল্লামা ইকবাল খুব সুন্দর বলেছেন-
“কাফির হচ্ছে তারাই যারা দুনিয়ার মধ্যে হারিয়ে যায়,আর মুমিন তারাই যাদের মধ্যে দুনিয়া হারিয়ে যায়”।
আজকে দুনিয়ার আকর্ষনের মাধ্যমে মুসলিমদের কাফিরীকরনের প্রক্রিয়া আগের চেয়ে ত্বরান্বিত হয়েছে, আর তা সম্ভব হয়েছে মিডীয়ার কল্যানে। এত বেশি দুনিয়াপূজা,পেটপূজা আমাদেরকে মনের অজান্তেই গলাধ:করন করাচ্ছে যার ফলাফল যা হবার তাই হচ্ছে,বিশ্ব জ্ঞান বিজ্ঞান থেকে আমরা ছিটকে পড়ে গেলাম,বিশ্ব নেতৃত্বের স্থান হয়ে গেল মুসলিম শুন্য।
শেক্সপিয়র,ডিকেন্স আর ফকনরদের মনের মাধুরী মেশানো কল্পকাহিনী পড়তে আমরা মহাব্যস্ত অথচ মহাসত্য আল-কুরআনকে আমাদের খুলে দেখার ও সময় নাই।
ইমদাদুল হক মিলনের প্রেমের উপন্যাস পড়ে প্রেমের সাগড়ে হাবুডুবু খেতে থাকি। বাংলাদেশের অন্যান্য লেখকের নাম না হয় নাই নিলাম। শিশুতোষ লেখা ও কিশোর উপন্যাস পড়িয়ে আজ আমরা শিশু কিশোরদের নৈতিকতা শেখাতে আগ্রহী অথচ মহানবী সঃ এর হাদীস থেকে আমাদের হৃদয় যোজন যোজন দুরে। এমনকি হাদীসগ্রন্থ সমূহের নামও আমরা জানিনা। কোন উপন্যাসে নায়ক গায়ের জামা খুলে এক ভিক্ষুককে দিয়ে দিয়েছে এ থেকে আহা! কি জিনিসই না শিখলাম!! এক সাহায্যপ্রার্থী যে মহানবী সঃ এ কাছে আসার পর তিনি তাকে বিচরনরত বকরী দেখিয়ে প্রয়োজনমত নিয়ে যেতে বললেন সে সম্পর্কে আমরা পুরোপুরি অজ্ঞ।
আফসোস!! আফসোস!! এ ছাড়া আর কি বা করার আছে?
রাবার মার্কা হিন্দী সিরিয়াল,হিন্দি সিনেমা আর হলিঊডের সিনেমার নিয়ে এত বেশি ব্যস্ত, দিন কিংবা সপ্তাহের নির্দিষ্ট সময় এসব কিছুর জন্য বরাদ্দ থাকে কিন্তু ইসলামী কোন কথা বললেই “একটু সাইড দেন তো”।
জেনিফার,ম্যাডোনা আর ব্রিটনীর গলার কম্পনের সাথে এত বেশি আমাদের অন্তর অনুরনিত হচ্ছে চিন্তাই করা যায়না।মেটালিকা,লিঙ্কিন পার্ক রা যেভাবে আমাদের অন্তর কাঁপাচ্ছে (!)?আহা!মধু মধু।
মহাকবি মাওলানা রুমী তার এক কবিতায় বলেছিলেন-
“যাদের হৃদয় তরতাজা শক্তিশালী এবং রুহ চেতনা ও সজাগ জাগ্রত,তার কাছে কোরানকে মনে হবে পরম বন্ধুর কণ্ঠস্বর অথবা এ তাদের আপন হৃদয়েরই গান”।
বুকে হাত দিয়ে দেখুন আপনার হৃদয়ে কি বাজছে? যদি কোরআন না বাজে তাহলে বুঝতে হবে মক্কার কাফির মুশরিকরা সফল নাহলেও আজকের কাফির মুশরিকরা মুসলিমদের ধোঁকা দিতে সফল হয়েছে। এ সফলতার একটা উল্লেখযোগ্য অংশের দাবীদার যে আপনি সেটাও আপনি খুব ভালভাবে উপলব্ধি করতে পারছেন।
বদনসীব !!মুসলমানকে লিয়ে
আজকাল অনেকসময় বন্ধুমহলে নিজেকে অতীব বেয়াকুফ ও মূর্খ মনে হয়।তাদের মুখ থেকে যখন বের হয়
“ওই রিয়ালের খেলাটা দেখছস?”
“দোস্ত বার্সা কালকে জটিল খেলছে।মেসি কি খেল দেখাইলো?অছাম ব্যাটা, অছাম”
“দ্রগবার মোট গোল কত রে ”?
আর ক্রিকেট প্রেমীদের কথা আর কি বলব?তাহাদের সামনে নিতান্তই মূর্খসুলভ আচরনে করতে বাধ্য হই।নীরব দর্শকের ভূমিকাটা অত্যন্ত দক্ষতার সাথেই পালন করি।
তারমানে কি আমি ইনিয়ে বিনিয়ে খেলা নিষেধ হওয়ার ফতোয়া দিতে চাচ্ছি নাকি?নাহ!ইসলাম আপনাকে খেলতে উৎসাহ দেয় তবে সে খেলা যা আপনার শারিরীক উন্নতিতে সহায়ক।এ খেলাধুলার মাধ্যমে আপনি সুঠাম দেহের অধিকারী হবেন যা দিয়ে আল্লাহর পথে জিহাদ করবেন।সকল অন্যায় অবিচার মোকাবেলার জন্য আপনার শারিরীক শক্তি আপনি ব্যবহার করবেন।কিন্তু রাতভর খেলায় দেখায় মত্ত থেকে আপনি আপনার শরীরের উপর জুলম করবেন, সকালে ফজরের নামায পড়বেননা এটা ইসলামের দৃষ্টিতে গ্রহনযোগ্যনা।
আজকাল এ খেলায় মত্ত রাখার জন্য কত কি না ব্যবহার হচ্ছে।ক্রিকেটে চিয়ার গার্লদের নৃত্য কিংবা ফুটবলে শাকিরার “ওয়াকা ওয়াকা “ গানে পাবলিক আজ উন্মত্ত।বহুত আচ্ছা হে……
এভাবে লিখতে থাকলে হয়ত আমার এ আর্টকেলটি আরো কয়েক পৃষ্টা যাবে।তাই বেশি আর যেতে চাচ্ছিনা।যে ব্যাপারটি আমি পরিষ্কার করতে চেয়েছি সেটা হচ্ছে ,১৪০০ বছর আগের ট্রিক্স আর আজকের কাফির মুশরিকদের ট্রিক্সের মধ্যে আমি খুব একটা বৈসাদৃশ্য খুঁজে পাচ্ছিনা।অত্যন্ত ঠান্ডা মাথায় তারা মুসলিমদের দুনিয়ামুখী করে দিয়ে তাদের আখের গোছাতে ব্যস্ত।এখনও সময় আছে,মুসলিমদের সতর্ক হতে হবে।শেষ করব কোন বইতে পড়া একটি ঘটনা দিয়ে-
“এক মুসলিমের সাথে এক অমুসলিমের ভাল বন্ধুত্ব হয়। মুসলিম লোকটি ছিল একজন ব্যবসায়ী। অমুসলিমটির এক আত্মীয়ও ছিল ব্যবসায়ী। অমুসলিম বন্ধুটি তার আত্মীয়কে তার মুসলিম বন্ধুর সাথে ব্যবসা করার অফার দিলে আত্মীয় কঠিনভাবে তা প্রত্যাখান করে। তার এ প্রত্যাখানের কারন জানতে চাইলে উত্তর দেয় ,সে মুসলিম বলে মদ খায়না তাই তার সাথে ব্যবসা করা সম্ভব না। কারন মদে মাতাল করে প্রমোদ সংগিনীকে দিয়ে যথেচ্ছা ডিল করা যাবেনা।“
এ আত্মীয়টি যেমন মানুষকে মাতাল করে তার স্বার্থ হাসিল করে নেয় আজ কাফির মুশরিকরাও আমাদের দুনিয়ার মাতাল করে তাদের স্বার্থ হাসিলের কূট ষড়যন্ত্রে লিপ্ত।তবে মদের ক্ষেত্রে অত্যন্ত স্পষ্ট রুপে শয়তান আসে বলে বেশিরভাগ মুসলিমকে ধোঁকা দিতে পারেনা,কিন্তু আজকের আমোদপ্রমোদের শয়তানটি অত্যন্ত সূক্ষ্ম ভাবে আসে বলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আমরা পরাজিত হয়ে যাচ্ছি।ঈমান ও আল্লাহভীতি নামক শ্বেতকনিকা দ্বারা যদি একে নির্মূল করতে নাপারি তাহলে পুরো রক্তকে বিষাক্ত করে তুলবে এ বিষয়ে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই।
রসদ সরবরাহ
১,সীরাতে সরওয়ারে আলম ৫ম খন্ড
২,মহাবিজ্ঞান আল কোরআন-ডাঃ ইসরার আহমেদ