প্রশ্ন ১: কুরআনের কি কোন ancient manuscript বা আদি সংস্করণ আছে?
উত্তর: কুরআন আল্লাহ তাআলা নিজেই হিফাযতের দায়িত্ব নিয়েছেন।
সূরা হিজর ১৫:৯ –
“আমিই কুরআন নাজিল করেছি এবং আমিই এর হিফাযতকারী।”
ইসলামের ইতিহাসে কুরআন প্রথম দিন থেকেই মুখে মুখে (তিলাওয়াত, হিফজ) এবং লিখিতভাবে সংরক্ষিত হয়েছে। সাহাবারা রাসূল ﷺ-এর নির্দেশে আয়াতগুলো কাগজ, চামড়া, হাড়, খেজুর পাতায় লিখে রাখতেন, পরে হযরত আবু বকর (রাঃ) ও উসমান (রাঃ) সময় তা একত্র করা হয়।
তাই মুসলমানদের কাছে “কুরআনের পুরনো কপি” (manuscript) মানে একই কিতাবের প্রাচীন প্রতিলিপি—কোনো পরিবর্তিত বা নতুন সংস্করণ নয়।
অন্যান্য ধর্মে “old manuscript” এর ধারণা:
এই “পুরনো পাণ্ডুলিপি খোঁজা” আসলে মূলত অন্য ধর্মগুলো থেকে এসেছে, কারণ তাদের মূল গ্রন্থগুলো পরিবর্তিত হয়েছে বা হারিয়ে গেছে। যেমন-
হিন্দুধর্ম- বেদ, উপনিষদ ইত্যাদি প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে মৌখিকভাবে চলে এসেছে। পরবর্তীতে বিভিন্ন রূপে লিখিত হয়েছে, তাই আজও গবেষকরা প্রাচীন “manuscript” খুঁজে বের করে ভিন্ন ভিন্ন সংস্করণ মিলিয়ে আসলটা অনুমান করার চেষ্টা করেন।
বৌদ্ধধর্ম- বুদ্ধের শিক্ষা প্রথমে লিখিত হয়নি, মুখে মুখে প্রচারিত হয়। ৪০০–৫০০ বছর পর শ্রীলঙ্কায় পালি ভাষায় তিপিটক লিপিবদ্ধ হয়। ফলে এখনো বহু প্রাচীন “পালি manuscript” সংগ্রহ করা হয়।
খ্রিস্টধর্ম- ইনজিল (Bible/New Testament) মূল আরামাইক বা হিব্রুতে নেই; বর্তমানে সবচেয়ে পুরনো পাণ্ডুলিপি হলো Greek কোডেক্স (Codex Sinaiticus, Codex Vaticanus, ৪র্থ শতক)। শত শত কপি ভিন্ন ভিন্ন পাঠভেদ (variant readings) আছে। এজন্য খ্রিস্টান গবেষকরা সবসময় “oldest manuscript” খুঁজে বের করেন যাতে আসল লেখকের কথার কাছাকাছি যাওয়া যায়।
অন্যান্য ধর্মগ্রন্থের সাথে আল-কুরআনের পার্থক্য:
মুসলমানদের জন্য কুরআনের textual criticism (যেটা অন্য ধর্মে হয়) জরুরি হয়নি, কারণ কুরআন শুরু থেকে আজ পর্যন্ত একই রূপে আছে।
কোরআনের পুরনো প্রতিলিপি (যেমন সানা ম্যানুস্ক্রিপ্ট, তোপকাপি, উসমানি মুসহাফ) কেবলমাত্র ইতিহাসের সাক্ষ্য হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ, “টেক্সট নির্ধারণ” করার জন্য নয়।
অর্থাৎ, “old manuscript” খুঁজে দেখা—এটা আসলে খ্রিস্টান ও বৌদ্ধদের textual study থেকে আসা ধারণা। মুসলমানদের জন্য কুরআন কখনো পরিবর্তিত হয়নি, তাই আমাদের জন্য “পুরনো কপি খুঁজে আসল নির্ধারণ” দরকার নেই; বরং এগুলো শুধু প্রমাণ দেয় যে আল্লাহর ওয়াদা সত্য।
প্রশ্ন ২: কুরআনের পুরাতন ম্যানুস্ক্রিপ্টগুলো কী কী? এগুলো কি বর্তমান কুরআন থেকে ভিন্ন?
উত্তর:
বিশ্বের প্রাচীন ও বিখ্যাত কুরআন ম্যানুস্ক্রিপ্ট:
১. তোপকাপি মুসহাফ (Topkapi Manuscript)
অবস্থান: ইস্তাম্বুল, তুরস্ক (Topkapi Palace Museum)
সম্ভাব্য সময়: খলিফা উসমান (রাঃ)-এর যুগের প্রতিলিপি হিসেবে ধরা হয় (৭ম শতক)।
এটি সবচেয়ে সম্পূর্ণ এবং সংরক্ষিত প্রাচীন কপি।
২. সামারকন্দ কুফিক কুরআন (Samarqand Kufic Qur’an)
অবস্থান: তাশখন্দ, উজবেকিস্তান (Telyashayakh Mosque)
সম্ভাব্য সময়: ৭ম–৮ম শতক।
বিশাল আকারের, কুফিক লিপিতে লেখা। অনেকেই এটিকে উসমানি মুসহাফের সাথে যুক্ত করেন।
৩. সানা ম্যানুস্ক্রিপ্ট (Ṣan‘ā’ Manuscripts)
অবস্থান: ইয়েমেন, গ্রেট মসজিদ অব সানা
আবিষ্কার: ১৯৭২ সালে।
এর মধ্যে palimpsest (একই পৃষ্ঠায় পুরোনো লেখার উপর নতুন লেখা) পাওয়া যায়। তবুও পাঠে কোনো ভিন্নতা নেই, কেবল লেখনশৈলী ও অক্ষরের দিক থেকে ভিন্ন। এটি প্রমাণ করে—একই সময়ে একাধিক নকল করা হচ্ছিল।
৪. ব্লু কুরআন (Blue Qur’an)
অবস্থান: তিউনিসিয়া, পরে ইউরোপের বিভিন্ন সংগ্রহশালায়।
সময়: ৯ম–১০ম শতক।
স্বর্ণাক্ষরে নীল রঙের মখমলে লেখা—খুব শিল্পসমৃদ্ধ ও আলংকারিক প্রতিলিপি।
৫. পার্চমেন্ট কুরআন (Birmingham Qur’an Manuscript)
অবস্থান: University of Birmingham, UK
সময়: ৫৬৮–৬৪৫ খ্রিস্টাব্দ (radiocarbon dating অনুযায়ী, অর্থাৎ রাসূল ﷺ জীবিত থাকা সময়ের কাছাকাছি)।
এটি বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন খণ্ডাংশ (কেবল কয়েকটি সূরা আছে, যেমন সূরা কাহফ, ত্বহা)।
৬. প্যারিসিনো-পেত্রোপলিটানুস কুরআন (Codex Parisino-Petropolitanus)
অবস্থান: প্যারিস, সেন্ট পিটার্সবার্গ ও ভ্যাটিকান লাইব্রেরিতে ভাগ হয়ে আছে।
সময়: ৭ম শতকের শেষ বা ৮ম শতকের প্রথম দিক।
খুবই প্রাচীন কপি, Hijazi script-এ লেখা।
৭. মাশহাদ হুসাইনি মুসহাফ (Mashhad al-Husayn Manuscript)
অবস্থান: কায়রো (মাশহাদ হুসাইন মসজিদ)
সময়: বলা হয় খলিফা উসমান (রাঃ)-এর হাতে লেখা কপি এখানেই সংরক্ষিত। ঐতিহাসিকভাবে বিতর্ক আছে, তবে এটিও অতি প্রাচীন।
তবে এসব ম্যানুস্ক্রিপ্টের মধ্যে বিরোধপূর্ণ কোন পাঠভেদ নেই, বরং শুধু লেখার ধরন, অক্ষর, নুকতা/হারাকাত যোগ করা হয়েছে পরে। এগুলো প্রমাণ করে কুরআন প্রথম দিন থেকে এখন পর্যন্ত অপরিবর্তিত। তাই মুসলমানদের কাছে “কুরআনের পুরনো কপি” (manuscript) মানে একই কিতাবের প্রাচীন প্রতিলিপি— অন্যান্য ধর্মগ্রন্থের মত কোনো পরিবর্তিত, বিকৃত বা নতুন সংস্করণ নয়।
প্রশ্ন ৩: কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনে “আল কোরআন বাংলা মর্মবাণী” নামে যে কুরআনের অনুবাদ পড়ানো হয়, এটা কি সঠিক কুরআন??
উত্তর:
কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনে “আল কোরআন বাংলা মর্মবাণী” বিষয়ে মারাত্মক কিছু অভিযোগ রয়েছে। যেমন—
১. অনুবাদে বিকৃতি:
“ইসলাম ও কোয়ান্টাম মেথড” বইতে একটি অভিযোগ এসেছে যে কোয়ান্টামের “কুরআন মর্মবাণী” অনুবাদে কিছু আয়াতের অনুবাদ মূল আরবি অর্থ থেকে পরিবর্তিত বা বিকৃত করা হয়েছে। উদাহরণ দেওয়া হয়েছে: غير المغضوب عليهم (رحمهم الله) এর অনুবাদ করা হয়েছে “অন্ধকার গহ্বর থেকে তুমি আমাদের রক্ষা কর” — অভিযোগ অনুসারে, এই অনুবাদে “অন্ধকার গহ্বর” ও “রক্ষা কর” শব্দটি এসেছে, যেটি মূল আয়াতে নেই।
২. শিরক বা তাওহীদের বিরোধী ব্যাখ্যা:
“কোয়ান্টাম মেথড” কিছু ব্যাখ্যায় “কুন (Kun— হোক) শব্দের ব্যবহার” ইচ্ছাশক্তি-চাওয়াকে অতিরঞ্জিতভাবে ব্যাখ্যা করছে, এমনভাবে যেন মানুষ নিজেই পৃথিবীর নীচের-উপরে বিভিন্ন পরিস্থিতিতে ইচ্ছামতে তাদের চাওয়া-পাওয়া অর্জন করতে পারে। এটি ইসলামি আক্বীদা (বিশ্বাস) ও তাকদীরের (নিয়তির) বাধার বিপরীতে যেতে পারে।
৩. মূল আরবি পাঠ বা আয়াতের অনুপস্থিতি: অনুবাদ ও ব্যাখ্যাগুলি “মূল আরবি পাঠ বাদ দিয়ে” করা হয়েছে৷ অর্থাৎ, পাঠকরা শুধু বাংলা অনুবাদ ও ব্যাখ্যাগুলো শুনে বা পড়েও বুঝতে পারছেন যে কোথাও জায়গায় পাঠ (আয়াত) থেকে সরাসরি উদ্ধৃতি নেই, বা ভাষ্য কিছু বাড়ানো-কমানো হয়েছে। এটি এক কষ্টকর বিষয় যদি এমন হয় যে পাঠ্যাংশের মানে বা উদ্দেশ্য পরিবর্তিত হচ্ছে।
৪. বিভিন্ন ধরনের ভুল / ভাষার প্রয়োগ:
কিছু শব্দ বা অভিব্যক্তি ব্যবহার হয়েছে যা ইসলামে স্বীকৃত নয়। কিছু ব্যাখ্যায় বিজ্ঞান, মেডিটেশন, “মন‐চাওয়া” ইত্যাদি ধারণা যুক্ত করা হয়েছে যেগুলো কুরআনের সঠিক ব্যাখ্যার সাথে একদমই সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। তাদের বইতে লেখা হয়েছে যে “ইসলাম প্রত্যেকের ধর্ম বিশ্বাসকে শ্রদ্ধা করে, প্রত্যেককে উৎসাহিত করে আন্তরিকভাবে নিজ নিজ ধর্ম পালনের”… অথচ ইসলামে স্পষ্ট বলা হয়েছে যে অন্য ধর্মকে উৎসাহ দেওয়া যাবে না, আল্লাহর কাছে একমাত্র মনোনীত ধর্ম হচ্ছে ইসলাম।
তাই কুরআন বাদ দিয়ে এই ভুল কোরআন যারা পড়বে, তারা যে ইসলাম সম্পর্কে অসংখ্য ভুল ও শিরকি বিশ্বাস ও আক্বীদায় জড়িয়ে যাবে, এতে কোম সন্দেহ নেই। শিরক ও ঈমান ধ্বংস হয়ে যাওয়ার মত বিষয় এখানে জড়িত। আল্লাহ সবাইকে হেদায়েত দিন।
