জ্ঞানের পথে চলার বাঁকে: ৩

আর-রহমান এবং আর-রহিম আল্লাহর নামে

অধ্যায় ৩ঃ মৌলিক বিষয়ের পূর্বেই গৌণ বিষয় নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি

কিছু ছাত্রকে ইসলামের মৌলিক বিষয়গুলিতে দক্ষতা অর্জনের আগেই অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ ও গৌণ ব্যাপারগুলো নিয়ে অধিক ব্যস্ত থাকতে দেখা যায়। অধিকাংশ ছাত্রই এমনটা করে থাকে হয় বিতর্কে জেতার জন্য অথবা অন্যদের সাথে দ্বীনের জটিল বিষয়ে মতবিনিময় করার জন্য। ইসলামী জ্ঞানের ছাত্রদের মাঝে এমন কিছু সাধারণ আলোচনার বিষয়বস্তু থাকে যেগুলো আলোচনা করে তারা ঘন্টার পর ঘন্টা শেষ করে দেয়। যদিও এ ধরনের বিষয়বস্তুর সংখ্যা দশ বা বিশের অধিক হবে না তারপরও তাদেরকে অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে কথা বলতে খুব কমই দেখা যায় ।

কিছু উদাহরণঃ

 -সালাতে রুকু থেকে উঠে দাড়াবার পর হাত কি বুকের উপর বাঁধতে হবে নাকি পাশে ঝুলিয়ে রাখতে হবে?

-সালাতে দ্বিতীয় সাজদার পরে দাঁড়াবার আগে কি কিছুক্ষণ সময় বসে নিতে হবে কিনা?

-বৈঠকে তাশাহহুদ পড়ার সময় আংগুল কি নাড়াতে হবে? আর নাড়ানোর পদ্ধতিই বা কি? হাতগুলো সেসময় কেমন অবস্থায় থাকবে? একইভাবে, দুই সিজদাহর মাঝখানে বসা অবস্থায় আংগুল কি নাড়াতে হবে কিনা?

ছাত্ররা যেসব প্রশ্ন নিয়ে আলোচনা করে বহু সময় নষ্ট করে এগুলো হচ্ছে তার কিছু উদাহরণ।

একইসাথে তারা ঈমানের মৌলিক বিষয়াদি এবং ইসলামিক নিয়মনীতির সুদূরপ্রসারী দিকগুলো এড়িয়ে যায়। তারা এসমস্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াদি নিয়ে পড়াশোনা করা এবং চিন্তাভাবনা করবার প্রয়োজন অনুভব করেনা কেননা তাদের সহপাঠীরা এসব বিষয়ের আলোচনায় আগ্রহী নয়। সুতরাং এসব বিষয়ে পড়াশোনা করলে তারা না পারবে তর্কে জিততে আর না পারবে নিজ মেধার আস্ফালন ঘটাতে।

আমরা বলছি না যে গৌণ ও সহায়ক বিষয়াদি নিতান্তই তুচ্ছ এবং এগুলো নিয়ে মাথা না ঘামাতে। এই ধরনের মতামত নিঃসন্দেহে ভুল কেননা দ্বীন ইসলামের কোন বিষয়ই তুচ্ছ এবং অগ্রাহ্য নয়। তা সত্ত্বেও কিছু বিষয়কে অন্য বিষয়ের উপর অগ্রাধিকার দিতে হয়। গৌণ বিষয়ের আগে মৌলিক বিষয়গুলো আলোচিত হবার দাবীদার। এটাই হচ্ছে জ্ঞানার্জনের সঠিক পন্থা। একজন ছাত্রের এও জানা থাকা উচিৎ যে গৌণ বিষয়গুলো নিয়ে স্কলারদের মাঝে বহু মতবিরোধ আছে।

ইসলামি জ্ঞানের ছাত্রকে যদি কখনও আপনি ঈমানের মৌলিক বিষয়গুলো নিয়ে প্রশ্ন করতেন তাহলে দেখতেন তাদের জ্ঞান কতটা অপর্যাপ্ত ও দ্বিধাদ্বন্দ্ব মিশ্রিত। ইসলামের সাধারণ অনুশাসন নিয়ে জিজ্ঞেস করলে এ বিষয়ে তার উদাসীনতা আপনার চোখে পড়বে। আইনশাস্ত্রের বিষয়াদি এবং ন্যায়শাস্ত্রের মৌলিক বিষয়গুলোতেও তার অবস্থান আগের মতই নড়বড়ে। তবে কিছু গৌণ বিষয়ে সে খুবই পারদর্শী হিসেবে প্রমাণিত হয়। কারন মৌলিক বিষয় বাদ দিয়ে সে এসবের পেছনেই লেগে থেকেছে।

এটা একজন ছাত্রের প্রজ্ঞার অভাবকে স্পষ্ট করে তোলে। কারন প্রজ্ঞার দাবি হচ্ছে প্রত্যেক বিষয়কে তার যথাযথ মর্যাদা প্রদান করা। একটি গৌণ সুন্নাহ বাস্তবায়নে যদি একজন এতটাই ব্যস্ত থাকে যে তার দরুন একটি মৌলিক এবং মুখ্য ঈমানের দাবি বাস্তবায়নে সে ব্যর্থ হয় তবে এটা চরম মূর্খতা ছাড়া আর কিছুই নয়। ঈমানের মৌলিক বিষয়ে উদাসীন থেকে কিছু তুচ্ছ বিষয়ে লোকজনের সাথে তর্কে লিপ্ত হওয়া চরম নির্বুদ্ধিতারই পরিচায়ক। আধুনিক যুগ ও সমাজে মহামারীর মত ছড়িয়ে পড়া নৈতিক অবক্ষয়ের ব্যাপারটি উপেক্ষা করে একটি সাধারণ সুন্নাহর পেছনে আমাদের সবটুকু সময় দেয়া কিছুতেই ঠিক হবে না।

আমরা সকলেই দেখতে পাচ্ছি আজকের মুসলিম সমাজ বিশ্বব্যাপী এক বিদ্বেষপূর্ণ যুদ্ধের মূল লক্ষ্যে পরিণত হয়েছে। যে যুদ্ধের উদ্দেশ্য শুধু গৌণ বিষয়াদি এবং ছোটখাট সুন্নাহর উৎপাটন নয় বরং এর মূল লক্ষ্যবস্তু হচ্ছে আমাদের ঈমানের মৌলিক ভিত্তিগুলো। বর্তমানে আমাদের সমাজের অনেক অংশই কমিউনিজম, সোস্যালিজম, সেকুলারিজমের মত বিপথগামী ধারণার ধ্বজাধারী ব্যক্তিদের প্রভাবে আন্দোলিত হচ্ছে। লোকজনের বিশ্বাসে চিড় ধরাবার জন্যে ইসলামের গোড়ায় তারা আঘাত হানছে।

ধর্ম বিবর্জিত, কুরুচিপূর্ণ লোকজন দ্বারা আমাদের সমাজ সমভাবে জর্জরিত যারা আমাদের সমাজকে পাপাচারের আস্তানায় পরিণত করতে চায়। এ উভয় দলই উল্লেখযোগ্য হারে তাদের লক্ষ্য বাস্তবায়ন করতে পেরেছে। সুতরাং একজন ইসলামি জ্ঞানের ছাত্রের জন্যে শুধুমাত্র কিছু ছোটখাট গৌণ বিষয়ে মনোযোগ দেয়া এবং অপরপক্ষে সমাজে অশ্লীলতার বিকাশ সম্বন্ধে অসচেতন থাকা মুর্খতাই বটে।

প্রত্যেক বিষয়কে ঠিক ততটুকু গুরুত্ব দেয়া উচিৎ তা যতটুকু গুরুত্বের দাবি রাখে। কোন নির্দিষ্ট বিষয়কে কখনোই সকল আলোচনা ও বিতর্কের মূল প্রতিপাদ্য বানানো উচিৎ নয়।

কোন সুন্নাহকেই আমাদের এড়িয়ে চলা উচিৎ নয়। আমাদের উচিৎ মানুষকে নবির  প্রদত্ত শিক্ষা ও দিকনির্দেশনা গুলো পুঙ্খানুপুঙ্খরুপে বুঝিয়ে দেঅয়া। একই সাথে আমাদের এটাও মাথায় রাখা উচিৎ যে সবার মানসিকতা সমান নয়। একজন ন্যায়নিষ্ঠাবান ও সৎকর্মশীল ব্যাক্তিকে সালাতের মধ্যে বিদ্যমান সকল সুন্নাহ গুলো শিখিয়ে দেঅয়া উচিৎ। তার জন্যে শুধু মৌলিক ফরজগুলো পালনই যথেষ্ট নয়।

পক্ষান্তরে বিপথগামী এবং গুনাহগার লোকদের দাওয়াহ দেবার ক্ষেত্রে আমাদের এ পদ্ধতি অনুসরণ করা ঠিক হবেনা। বরং এ সমস্ত লোকগুলোকে আমাদের ইসলামের মৌলিক ভিত্তির দিকে ডাকতে হবে এবং তাদেরকে গোমরাহী ও পাপাচারের অন্ধকার থেকে জ্ঞান ও বিশ্বাসের আলোকোজ্জ্বল পথে নিয়ে আসতে আমাদের চেষ্টা সাধনা চালাতে হবে।

এ সমস্ত লোকদের কখনোই এড়িয়ে চলা উচিৎ নয়। বরং তারাই আমাদের প্রাধান্য পাবার প্রথম দাবীদার। একজন ঈমানদার ও আল্লাহর ইচ্ছায় নিয়মিত সালাত আদায়কারী যদি কোন নির্দিষ্ট সুন্নাহ ছেড়েও দেয় তারপরও তাকে মহাবিপদের সম্মুখীন বলা যায় না। কিন্তু যে ব্যক্তি পাপের সাগরে ডুবে আছে এবং মিথ্যা বিশ্বাস দ্বারা বিপথগামী হয়েছে সে অবশ্যই মহা বিপদের মধ্যে আছে। তাই একজন ধার্মিক ব্যাক্তিকে একটি সুন্নাহ সম্পর্কে শিক্ষা দেওয়ার চেয়ে এ ধরনের পাপাচারি ব্যাক্তিকে ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচানো অনেক অনেক বেশী গুরুত্বপূর্ণ। তবে আমাদের সামর্থ্য থাকলে উভয় দায়িত্বই পালন করা উচিৎ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *