বাংলাদেশে আলফা জেনারেশন এর বাচ্চাদের মধ্যে (জেনারেশন Z এর একটা অংশ), বিশেষ করে ৭-৮ বছর বয়সের ও টিনেইজারদের মধ্যে “স্পিরিট গেম” বা “চ্যালেঞ্জ” হিসেবে কিছু খেলা প্রচলিত, যা শহর থেকে গ্রাম, স্কুল থেকে মাদ্রাসা সব ঘরানায় প্রচলিত। খেলাগুলো তারা মজার ছলে বন্ধুদের কাছ থেকে শুনে বা ইউটিউব/ টিকটকের ভিডিও দেখে খেলে, কিন্তু তারা বোঝে না এগুলো আসলে জ্বিন ডাকার বা শয়তানি আমল অনুকরণ করার মতো কাজ। নিচে প্রতিটা গেম কিভাবে খেলা হয়, ডিটেইলস দিচ্ছি যেন বোঝা যায়, সমস্যাগুলো কোথায়—
1. Charlie Charlie Game (চার্লি চার্লি গেম):
– একটি কাগজে চার ভাগে লাইন টেনে লেখা হয় “Yes”, “No”, “Yes”, “No”।
– একটি পেন্সিল ক্রস করে রাখা হয় একটা আরেকটার ওপরে।
– তারপর বলা হয়: “Charlie, Charlie, are you here?”
– যদি উপরের পেন্সিল নড়ে যায়, তারা ধরে নেয় “Charlie” নামের আত্মা বা জ্বিন এসেছে।
2. Bloody Mary Game:
– ঘরের আলো বন্ধ করে, (অনেকসময় বাথরুমেও) আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে, মোমবাতি জ্বালিয়ে ৩ বা ১৩ বার বলে: “Bloody Mary, Bloody Mary, come to me.”
– তারপর বলে আয়নায় রক্তমাখা এক মুখ দেখা যায়।
3. Ouija Board (উইজা বোর্ড):
– বোর্ডে লেখা থাকে ইংরেজি বর্ণমালা, “Yes”, “No”, “Goodbye”।
– সবাই আঙুল রাখে ছোট একটি গ্লাস বা planchette এর উপর।
– তারপর আত্মাকে প্রশ্ন করে: “Who are you?”, “Are you a spirit?”, “Will I die soon?”
– গ্লাস নড়লে তারা ধরে নেয় আত্মা উত্তর দিচ্ছে।
4. Candyman Ritual:
– আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ৫ বার বলে “Candyman”।
– ধারণা করা হয় আত্মা এসে পেছনে দাঁড়ায় বা ভয় দেখায়।
5. Three Kings Ritual:
– ৩ টি আয়না, ১টি চেয়ার (“throne”), এবং ২ টি মোমবাতি রেখে মাঝরাতে অন্ধকার ঘরে বসা হয়।
– খেলোয়াড় একা থাকে, আয়নায় তাকিয়ে বলে “Ask your King anything.”।
– তারা ভাবে “shadow self” বা আত্মা উত্তর দেবে।
6. Midnight Game:
– মধ্যরাতে নিজের নাম রক্ত দিয়ে কাগজে লিখে দরজায় রাখে।
– তারপর মোমবাতি হাতে অন্ধকারে ঘোরে।
– বলা হয় “Midnight Man” নামের আত্মা আসবে।
7. Elevator Game (লিফট গেম):
– ১০ তলা ভবনের নির্দিষ্ট বোতাম ক্রমে চাপতে হয়: যেমন 4→2→6→2→10→5
– বলা হয়, এভাবে করলে অন্য “dimension” বা জগতে যাওয়া যায়, আর এক “মহিলা আত্মা” দেখা দেয়।
– খেয়াল করে দেখুন, নিউ এইজ স্পিরিচুয়ালিটিতে Astral Travel এর কথা বলেছিলাম, যেখানে আত্মা Atral plane তথা ভিন্ন ডাইমেনশনে ট্রাভেল করতে যায়। মিল পাওয়া যায়? বড়দের জন্য এস্ট্রোফিজিক্স ইউজ করা হচ্ছে, আর বাচ্চাদের জন্য ফান গেইম। অথব সবকিছুর এন্ডিং ঐ স্যাটানিজমে।
8. Red Door, Yellow Door:
– একজন শুয়ে পড়ে, আরেকজন তার মাথায় হাত রাখে।
– শুয়ে থাকা ব্যক্তি বলে “Red door, yellow door, any other door…”
– তারপর কল্পনায় দরজার ভেতর হাঁটে — এবং সে তখন বলে ভিতরে কী “দেখতে পাচ্ছে”।
– ধারণা করা হয় যে, এটা মনের গভীরে “spirit world”-এ প্রবেশ করার একটা খেলা।
– এই সেই spirit world, যেখানে Astral travel এর মাধ্যমে যাওয়া হয় আত্মার পরিশুদ্ধির জন্য, Cosmic Energy এর সাথে নিজের energy মিলানোর জন্য, যেটার ছদ্মনাম Cosmic Consciousness.
– Red Door Yellow Door খেলা আসলে Neurowave বা Mindwave পদ্ধতির শিশুসুলভ সংস্করণ, যেখানে বাচ্চাদের “brain wave shifting” ও “lucid imagination” প্রক্রিয়া খেলায় রূপ দেওয়া হয়। এটি New Age lucid-dream বা astral travel induction method-এরই এক ধরন।
9. The Closet Game:
– খেলোয়াড় একা ঘরে থাকে, সব লাইট বন্ধ করে।
– একটা মোমবাতি হাতে নিয়ে আলমারির মধ্যে ঢোকে।
– সে বলে, “Show me the light or leave me in darkness.”
– বলা হয়, যদি হঠাৎ কেউ শ্বাসের শব্দ শুনে বা গরম বাতাস টের পায়, তাহলে সেটা আত্মা বা জ্বিনের উপস্থিতি!
– তখন দ্রুত আলমারি খুলে মোম নিভিয়ে ফেলতে হয়।
10. Baby Blues Scary Game:
– একজন বাথরুমে গিয়ে লাইট বন্ধ করে আয়নার সামনে বসে।
২. নির্দিষ্ট কিছু বাক্য (spells) বলা হয়, যেমন—“Blue Baby, Blue Baby…” হাতের উপর কল্পনায় একটা অদৃশ্য শিশুকে ধরার মতো ভান করে।
৩. বলা হয়, কিছুক্ষণ পর হাত ভারি হয়ে যায়—মানে নাকি শিশুর আত্মা ধরা পড়ে।
৪. তারপর “drop the baby” বলতে হয় আয়নায় তাকিয়ে, না হলে আত্মা নাকি রেগে যায়!
The Shoebox Telephone Game
– একটা খালি জুতার বাক্স (shoebox) নিতে হয়।
– এর ভিতরে রাখতে হয়— একটা কাগজে মৃত ব্যক্তির নাম ও ফোন নম্বরের মতো কিছু লেখা।
– একটা খেলনা ফোন বা কাগজের ফোন তৈরি করা হয়।
– কখনও কেউ ব্যক্তির কোনো ছবি বা ছোট জিনিসও রাখে (যেমন চুল, চিঠি ইত্যাদি)।
– বাক্সের মুখ বন্ধ করে সেটি রাতে বালিশের নিচে রাখা হয়।
– ঘুমানোর আগে বলতে হয়:
“I’m ready to talk to you. Please call me.”
– এরপর স্বপ্নে বা রাতে ফিসফিস আওয়াজে নাকি Call আসে — মানে আত্মা যোগাযোগ করে। (নাঊযুবিল্লাহ)
ইসলামের দৃষ্টিতে এইসব গেইম:
এসব খেলা আসলে শয়তানি ও জ্বিন আহ্বানমূলক কাজের অংশ, যা ইসলামে স্পষ্টভাবে হারাম ও নিষিদ্ধ। কারণ—
ইলমুল গায়েব বা আল্লাহর সীমায় হস্তক্ষেপ:
আল্লাহ তাআলা বলেন —
“عَالِمُ الْغَيْبِ وَالشَّهَادَةِ الْعَزِيزُ الْحَكِيمُ”
”তিনি গায়ব ও প্রকাশ্য সবকিছুর জ্ঞান রাখেন। তিনি মহা মহান।” (সূরা আত-তাগাবুন, আয়াত ১৮)
এই আয়াত থেকে আমরা জানি, গায়েব বা অদৃশ্য জগত (যেমন জ্বিন, আত্মা, ফেরেশতা ইত্যাদি) সম্পর্কে মানুষের কোনো জ্ঞান বা ক্ষমতা নেই, শুধুমাত্র আল্লাহর আছে। তাই “আত্মা ডাকা”, “জ্বিনের সাথে কথা বলা”, “অন্য জগতে যাওয়া”— এগুলো সব আল্লাহর সীমার মধ্যে হস্তক্ষেপের চেষ্টা, যা শিরক বা কুফরির পর্যায়ে পড়ে।
জ্বিনদের সাহায্য চাওয়া:
আল্লাহ বলেন —
“وَأَنَّهُ كَانَ رِجَالٌۭ مِّنَ ٱلْإِنسِ يَعُوذُونَ بِرِجَالٍۭ مِّنَ ٱلْجِنِّ فَزَادُوهُمْ رَهَقًۭا”
“মানুষের কিছু লোক জ্বিনদের সাহায্য চাইত, ফলে তারা তাদেরকে আরও বিপথে নিত।” (সূরা আল-জিন, আয়াত ৬)
এখানে স্পষ্ট বলা হয়েছে — জ্বিনের সাহায্য নেওয়া মানে শয়তানদের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করা, এবং এর ফল হলো ভয়, বিভ্রান্তি ও ক্ষতি। চার্লি চার্লি, উইজা বোর্ড, থ্রি কিংস, ব্লাডি মেরি — সবগুলোর পেছনে মূল ধারণাই হলো অদৃশ্য আত্মা বা জ্বিনকে আহ্বান করা। এগুলো সরাসরি এই আয়াতের নিষেধাজ্ঞার মধ্যে পড়ে।
কাহিন (ভবিষ্যদ্বক্তা বা জাদুকর) এর কাছে যাওয়া:
রাসূল ﷺ বলেছেন —
“مَن أتى كاهِنًا فَصَدَّقَهُ بما يقولُ، فقد كَفَرَ بما أُنزِلَ على مُحَمَّدٍ ﷺ”
“যে ব্যক্তি কোনো কাহিন (fortune-teller) এর কাছে যায় ও তার কথা বিশ্বাস করে, সে মুহাম্মদ ﷺ এর উপর অবতীর্ণ বিষয়কে অস্বীকার করল।” (আবু দাউদ, হাদীস ৩৯০৪; তিরমিযি ১৩৫)
Ouija board বা Charlie Charlie এসব গেমে আত্মাকে প্রশ্ন করা হয়, ভবিষ্যৎ জিজ্ঞেস করা হয়— এগুলো মূলত কাহিনের কাজের মতোই, তাই এগুলোও নিষিদ্ধ।
শয়তানের ধোঁকা ও ভয় দেখানো:
আল্লাহ বলেন —
إِنَّمَا ذَٰلِكُمُ الشَّيْطَـٰنُ يُخَوِّفُ أَوْلِيَآءَهُ فَلَا تَخَافُوهُمْ وَخَافُونِ إِن كُنتُم مُّؤْمِنِينَ
“সে (শয়তান) তার বন্ধুদেরকে ভয় দেখায়, তাই তাদের ভয় করো না, বরং আমাকেই ভয় করো, যদি তোমরা ঈমানদার হও।”(সূরা আলে ইমরান, আয়াত ১৭৫)
এসব গেমে “অদৃশ্য আত্মার উপস্থিতি”, “ভয়ঙ্কর দৃশ্য”, “দরজা বন্ধ হয়ে যাওয়া” — সবই শয়তানের ভয় দেখানোর কৌশল। যাতে মানুষ আল্লাহর বদলে অন্য শক্তির প্রতি ভয় ও বিশ্বাস স্থাপন করে। নাউযুবিল্লাহ।
জাদু ও তন্ত্রমন্ত্রের সাদৃশ্য:
রাসূল ﷺ বলেছেন —
“من سحر فقد كفر”
“যে ব্যক্তি জাদু করে বা করায়, সে কুফরি করেছে।” (সহিহ বুখারি)
থ্রি কিংস রিচুয়াল, মিডনাইট গেম, রেড ডোর ইয়েলো ডোর — এগুলো মূলত Occult (তন্ত্র) বা Pagan Ritual এর অনুকরণ, যা ইসলামে সরাসরি কুফরি ও শিরকি কাজ।
পুনর্জন্ম, অতৃপ্ত প্রেতাত্মা, আত্মার ফিরে আসা, আত্মার সাথে কথা বলা- এগুলো ইসলামে সম্পূর্ণ মিথ্যা বিষয়:
আল্লাহ বলেন-
وَمِن وَرَائِهِم بَرْزَخٌ إِلَىٰ يَوْمِ يُبْعَثُونَ
“আর তাদের পেছনে আছে এক অন্তরাল (বরযখ), পুনরুত্থানের দিন পর্যন্ত।” (সূরা মুমিনুন, আয়াত ১০০)
এই আয়াত দ্বারা আল্লাহ স্পষ্ট করে দিয়েছেন যে,
মানুষ মারা যাওয়ার পর কবরে বারযাখ নামক এক জগতে অবস্থান করে, যেখান থেকে কেউই দুনিয়ায় ফিরে আসতে পারে না, যতই কেউ আত্মা ডাকার চেষ্টা করুক না কেন।
