ডোন্ট ফীড দ্য ট্রল!

অনুজ মাঝে মাঝে ফেইসবুকিং করতে করতে হো হো করে হেসে ওঠে- এই দ্যাখ, অমুক হুজুর কী বলসে! সে নাকি…… ব্লা ব্লা ব্লা!

প্রতিউত্তর দেয়ার আগে ভিডিওটা দেখে নিই, বক্তাটা কে। কারণ, ‘ট্রলার’ জেনারেশনের কাছে সবই ট্রল, কিংবা এটা ওদের বয়সের দোষ, যুগের দোষ। কিন্তু আমরা যারা জীবন ও জগৎ দেখে দেখে বুড়ো হতে চলেছি, ট্রল নিয়ে ট্রল করার আগেও বিবেক খাটানো আমাদের বিবেকের দাবি, বয়সের দাবি কিংবা জ্ঞানের দাবি। আপনার কাছে হয়তো ভালোই লাগবে যে, ওরা ট্রল করে দেওয়ানবাগীকে নিয়ে, তাহেরীকে নিয়ে, যারা সত্যিই শিরক-বিদাতের আখড়া!


কিন্তু আপনাদের সবার হয়তো জানাও নেই যে, ওদের ট্রলের লিস্টে আল্লামা শফী হুজুর, মুফতি কাজী ইব্রাহীম, তারিক মুনাওয়ার, মিজানুর রহমান আজহারী, শায়খ আব্দুর রাজ্জাক- কেউ বাদ পড়েনি! আমার জানামতে ইনারা সবাই হক্বপন্থী আলেম, কিন্তু মাঝে মাঝে দু’একটা ভুলও বলে ফেলেছেন। ইনাদের কেউ আপনার পক্ষের, কেউ বিপক্ষের, তাই বিপক্ষের কারো ভিডিও পেলে আপনি ইসলামপন্থী, ইসলামপ্রেমী হয়েও সেটা নিয়ে বিনোদনে মেতে যান।

এখন আসল কথায় আসি, বাচ্চারা ট্রলের জন্য এইসব কাটপিস বক্তব্য পায় কোথায়? ওরা কি তাহলে খুটে খুটে আলেমদের লেকচার শোনে? উহু, মোটেও না, সেই সময় ওদের নাই। কিন্তু এই আমরা, এই আপনারা যারা বিপক্ষের হুজুরের একটা ভুল পাইলেই ট্রল করে ছড়িয়ে দিতে ত্রস্ত হয়ে পড়ি, ওগুলো শেয়ার হয়ে হয়েই একসময় জাতীয় ‘ট্রলার’দের হাতে পৌছে যায়। ওরা তখন এমনসব মানুষদের নিয়ে অজান্তেই নেগেটিভ কমেন্ট-রিকমেন্ট শুরু করে দেয়, যাদের ইখলাসের ধারে কাছে যাওয়ার সামর্থ্যও ওদের নেই। এর পিছনে দায় কাদের? আমাদের। আমরাই ওদের মাথায় ঢুকিয়ে দিচ্ছি- হুজুর মানেই ট্রলের বস্তু। দুদিন পর ভালো কোন লেকচার শোনাতে চাইলে ওদের বুঝাবেন কি করে যে, এই হুজুর হক্ব বলেন? ওরা তো কমবেশি সবারই ট্রল ভিডিও দেখে ফেলেছে। আমি নিজে সাফার করেই কিন্তু কথাগুলো বললাম। আর এই ট্রলগুলো যখন নাস্তিক কিংবা ইসলামবিদ্বেষীদের কাছে পৌছে, তারা কি পরিমাণ বিনোদিত হয়, কল্পনা করতে পারেন?

তাই আমার মনে হয়, সবকিছু নিয়ে ট্রল করে ইসলামবিদ্বেষীদের তালি বাজানোর সুযোগ করে দেয়া উচিৎ না। ভুল সবারই আছে, এখন এই আমার-আপনার সাথে ১০ দিন থাকার পর কেউ যদি আমাদের নেগেটিভগুলো নিয়ে রচনা লিখতে বসে, তাহলেও বই হয়ে যাবে। কিংবা আমি আপনিই যদি রেগুলার পাব্লিক স্পীচ দেয়া শুরু করি, দেখবেন আমাদের কথার কাটপিস নিয়েও কত কত ট্রল বানানো যায়!

কলেজ লাইফে লেকচার গ্যালারিতে ক্লাস করতে বসে দেখতাম, ডায়াসে দাড়ানো টীচারেরা সামান্য কোন ভুল করলেও হাসাহাসির রোল উঠে যায় শ্রোতা গ্যালারিতে (আলহামদুলিল্লাহ, আমি কোনদিনই এই গোত্রভুক্ত ছিলাম না)। তো স্যারদের ভুল নিয়ে প্রতিনিয়ত ঠাট্টা করা এক ছাত্রীকেই একদিন ডায়াসে নিয়ে যাওয়া হলো কোন একটা বিষয়ে কথা বলার জন্য। অদ্ভূতভাবে লক্ষ্য করলাম, ঐ মেয়েটার চলন-বলন আর কিছু শব্দের উচ্চারণ এত অদ্ভূত শোনাচ্ছিলো যে, তা নিয়ে তার বান্ধবীরাই হাসি জুড়ে দিলো। সেদিন বুঝলাম, নিজেকে ডায়াসে না বসালে আসলে নিজের ভুল ধরা যায়না! বুদ্ধিমান সে-ই, যে দর্শক গ্যালারিতে থেকেও ডায়াসের মানস ধরতে পারে, অন্যের দিকে আঙ্গুল তোলার আগে অন্যের আয়নায় নিজের বিকৃত রূপটাও দেখতে পায়….

যে আলেমসমাজ আজকে হাজার হাজার মানুষকে দ্বীনের পথে ডাকছেন, যারা ৯০% কথাই হক্ব বলেন, কি দরকার তাদের দু’একটা ‘মানবিক’ ভুল টেনে এনে জাতীয় ট্রলে পরিণত করার? এভাবে ট্রল ছড়িয়ে কি দ্বীনের খেদমত হয়, না এটা সমালোচনার কোন পন্থা? কোন আলেম যদি অন্য আলেমের ভুল ধরিয়ে দিতে চান, তাহলে উত্তম পন্থায় সমালোচনা করুন। কিন্তু ট্রল কেন? এটাই ‘হুমাযাহ’/’লুমাযাহ’ নয় কি?

ড. সালমান আল আওদাহ হাফিজাহুল্লাহ তার ‘প্রিয় শত্রু তোমাকে ধন্যবাদ’ বইয়ে এই কথাগুলোই লিখেছেন,

“সমালোচনার একটি মূলনীতি হলো- যেই মতের সমালোচনা করতে চাই, সেটিকে সঠিকভাবে ও সঠিক প্রসঙ্গ সহকারে উপস্থাপন করতে হবে।পারিপার্শ্বিকতাসহ দেখলে যে কথাটা খুব যৌক্তিক মনে হতো, প্রসঙ্গ বাদ দিলে সেটিকেই মারাত্মক ভুল মনে হয়। সঠিক বক্তব্য আর শক্ত যুক্তির মধ্য থেকে একটি ভুল শব্দচয়ন বেছে নিয়ে সেটাকে আলোচ্য বিষয় বানিয়ে ফেলা যাবে না। দ্বীনি বিষয়ের বিতর্কে এটি আরও গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষত অপরপক্ষ যদি আপনার মতই সত্যানুসন্ধানী হয়।

ফক্বীহ ইবনে হাযম আয-যাহিরী রহ. এর লেখাগুলোর কথাই ধরুন না। অসাধারণ বুদ্ধিমান একজন আলেম, অনেকগুলো কাজে তার মেধার দৃষ্টান্ত বিদ্যমান। ইমাম আয-যাহাবীর লেখা ‘সিয়ারু আলামিন নুবালা’ গ্রন্থে এর কতকগুলো দৃষ্টান্ত আলাদা ভাবে তুলে ধরা হয়েছে। কিন্তু একই সাথে ইবনে হাযম এমন অদ্ভুত অদ্ভুত কিছু ভুল করেছেন, যা দেখলে মনে হয় এমন একজন মানুষ এইসব ভুল কিভাবে করলেন! ইবনে হাযমের বুদ্ধিবৃত্তিক অর্জন নিয়ে কোন বই সংকলন করা হলে তা হবে একজন কিংবদন্তি ইসলামী চিন্তাবিদের বর্ণনা। আবার শুধু তার ভুলগুলো সংকলন করেই একটি বই লিখা হলে মনে হবে যে, আক্ষরিক অর্থের বাইরে কিছু বোঝার মত মেধা তার ছিলই না।
আবু হামিদ আল-গাযালিসহ আরও অনেক প্রখ্যাত আলিম এর ব্যাপারে একই কথা খাটে। এ কারণেই নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

أقيلوا ذوي الهيئات عثراتهم إلا الحدود-

“যাদের অনেক প্রশংসনীয় ব্যাপার আছে, তাদের ছোটখাটো ভুলগুলো উপেক্ষা করো, হদ্দের অপরাধ ব্যতীত।” (আবু দাউদ: ৪৩৭৫, নাসাঈ: ৭২৯৪)

চিন্তা করে দেখুন তো, আলেমদের যে ভুলগুলো নিয়ে আমরা প্রতিনিয়ত ট্রল করছি, তার কোনটাই কি হদ্দের সমতুল্য? না কোন কবীরা গুনাহ? বেশিরভাগই মুবাহ কিংবা সর্বোচ্চ মাকরূহ পর্যায়ের। অথচ আমরা নিজেরাই এরচে কত বড় বড় ভুল প্রতিদিন করে ফেলি, তা কি ফলাও করে বলে বেড়াই? কেবল যদি অন্য সবাইকেই ভুল মনে হয়, নিজেকেই ঠিক মনে হয়, তাহলে ধরে নিতে হবে, নিজের ভেতরই গলৎ সবচে বেশি।

আল্লাহ আমাকেসহ আমাদের সবাইকে সমালোচনা, কটুক্তি, ট্রল নিয়ে আরেকটু সচেতন হওয়ার তাউফীক দিন। আমীন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *