শৈশবঃ
আবু আমিনাহ বিলাল ফিলিপ্স। সবাই বিলাল ফিলিপ্স হিসেবে এক নামে চেনেন তাঁকে। জামাইকান-কানাডীয় বংশদ্ভূত এই বিখ্যাত ‘আলিম ১৯৭২ সালে ইসলামের ছায়াতলে আসেন। তাঁর জন্ম ১৯৪৬ সালে জামাইকার কিংস্টনে এক খৃস্টান পরিবারে। ইসলাম গ্রহণের আগে তাঁর নাম ছিল ডেনিস ব্র্যাডলি ফিলিপ্স। খৃস্টান পরিবারে জন্ম হলেও শৈশব থেকেই ছিলেন ধর্মীয় গোঁড়ামির শেকল থেকে মুক্ত এক জ্ঞানপিপাসু ও কৌতুহলী মানুষ। এই কৌতুহলই পরবর্তীতে তাঁকে ইসলামের ছায়াতলে নিয়ে আসে।
কৈশোরঃ
দ্বাদশ শ্রেণী সমাপ্ত করে তিনি ভ্যাঙ্কুভারের সিমন ফ্রেজার ইউনিভার্সিটিতে স্নাতকে ভর্তি হন এবং এসময় কমিউনিস্ট চেতনায় উদ্বুদ্ধ হন। বিশ্বের চলমান সমস্যাগুলোর একমাত্র সমাধান কমিউনিজম- এমন বিশ্বাস তাঁর মাঝে দানা বাঁধতে শুরু করে। তাঁর ভাষায়-
“…আমেরিকা সরকারের শোষণ-নিপীড়ন আমাকে ভাবিয়ে তুলেছিল। দেশটির ইতিহাস নিয়েও বিস্তর পড়াশুনা করলাম। আমেরিকায় ইউরোপিয়ানদের আগমন ও আগ্রাসনের কারণে এখানকার স্থানীয় রেড ইন্ডিয়ানদের সংখ্যা এই কয়েকশ বছরে আট মিলিয়ান থেকে কমে দুই মিলিয়নে এসে ঠেকেছে। এছাড়া নিগ্রোদের দাসত্ব, আমেরিকান ব্ল্যাক প্যান্থারের নিধন- এসবই পশ্চিমা সভ্যতায় অন্যায়ের শাসনকে বার বার চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছিল। কমিউনিজমে সম্পদের সুষম বণ্টন ও সমাজের বাসিন্দাদের সুষম মর্যাদার প্রতিশ্রুতি দেখে আমার বিশ্বাস জন্মাল কমিউনিজমই পারে এসব সমস্যার সমাধান দিতে। তাই আমি কমিউনিজমের পথে পা বাড়ালাম।” [উৎস: http://bilalphilips.com/about/gulf-today-biography/ থেকে বাংলা অনুবাদ]
শুরুতে কমিউনিস্ট পার্টির সক্রিয় কর্মী হিসেবে মাঠে নামলেও পরে কমিউনিস্ট নেতাদের মাঝে সীমাহীন দুর্নীতি দেখে কমিউনিজমের অসারতা উপলব্ধি করলেন তিনি। ইতোমধ্যে কৌতুহলবশত ইসলাম নিয়েও পড়াশুনা শুরু করেছেন। ইসলাম গ্রহণে তাঁকে প্রথম যে বইটি উদ্বুদ্ধ করে সেটি হলো মুহাম্মাদ কুতুবের “Islam: The Misunderstood Religion”. এই বইটি পড়ার পর তাঁর মনে বিশ্বাস জন্মাল ইসলামই একমাত্র পারে বর্তমান সভ্যতার সমস্যাগুলোর সমাধান দিতে। এরপর ১৯৭২ সালে এক অলৌকিক স্বপ্ন দেখে তিনি পুরোপুরি ইসলামের পথে চলে এলেন। এ স্বপ্নের কথা তিনি তাঁর একাধিক সাক্ষাৎকারে বলেছেন।
বিলাল ফিলিপ্স সত্য জানার ব্যাপারে সদা উৎসুক ছিলেন। ইসলাম গ্রহণ করেই নির্ভরযোগ্য উৎস থেকে ইসলামের জ্ঞানার্জনের পথ খুঁজতে শুরু করলেন। প্রথম প্রথম স্থানীয় ‘আলিমদের কাছে পড়া শুরু করলেও মাযহাবগত বিভক্তি দেখে দ্বিধায় পড়ে যান। ইসলামের বিশুদ্ধ জ্ঞানের সন্ধানে তিনি মাদীনাহ চলে যান এবং মাদীনাহ ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া শুরু করেন। সেখান থেকে ১৯৭৯ সালে ইসলামিক স্টাডিজে বি.এ. সম্পন্ন করেন এবং এরপর রিয়াদের কিং সউদ ইউনিভার্সিটি থেকে ইসলামি আক্বীদায় মাস্টার্স সম্পন্ন করেন। পরবর্তীতে ১৯৯৪ সালে ব্রিটেনের ওয়েলস ইউনিভার্সিটি থেকে ইসলামী আক্বীদায় পিএইচডি সমাপ্ত করেন।
মাদীনায় থাকাকালে তিনি তৎকালীন বড় বড় ‘আলিমগণের সান্নিধ্যে পড়াশোনা করেছেন। এঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন শাইখ নাসির উদ্দীন আল-আলবানি এবং শাইখ মুক্ববিল বিন হাদী (রহিমাহুমুল্লাহ)।
দাওয়াতী কার্যক্রমঃ
৩০ বছরের অধিক সময় ধরে বিলাল ফিলিপ্স দাওয়াতী কাজে যুক্ত রয়েছেন। রিয়াদে দশ বছরেরও অধিক সময় ধরে প্রাইভেট স্কুলগুলোতে ইসলাম শিক্ষা ও আরবী পড়িয়েছেন। পরবর্তীতে ফিলিপাইনের মিন্দানাওয়ে কোতাবাতো শহরে শরীফ কাবুনসুয়ান ইসলামি ইউনিভার্সিটির ইসলামিক স্টাডিজ ডিপার্টমেন্টে এম.এড. ছাত্রদের পড়িয়েছেন। পরে আরব আমিরাতের দুবাইয়ে দশ বছর আমেরিকান ইউনিভার্সিটিতে আরবী ও ইসলামিক স্টাডিজের ক্লাস নিয়েছেন।
তিনি ১৯৯৪ সালে দুবাইয়ে ইসলামিক ইনফরমেশন সেন্টার এবং আরব আমিরাতের শারজাহতে দারুল ফাতহ ইসলামিক প্রেসে ফরেইন ল্যাঙ্গুয়েজ ডিপার্টমেন্ট প্রতিষ্ঠা করেন। কাতারে ৭ বছর থাকাকালে তিনি Sh. Eed Charity-র ইসলামিক ইনফরমেশন শাখায় ইসলামি কনসালট্যান্ট ও প্রভাষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
২০০২ সালে ড. বিলাল আরব আমিরাতের আজমান প্রিস্টন ইউনিভার্সিটিতে ইসলামিক স্টাডিজ ডিপার্টমেন্ট প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনা শুরু করেন। ২০০৭ এ কাতারের দোহায় ইসলামিক স্টাডিজ একাডেমী প্রতিষ্ঠা করেন এবং একই বছর তিনি ইসলামিক অনলাইন ইউনিভার্সিটি (IOU) প্রতিষ্ঠা করেন যেখানে বর্তমানে ২০৭ টিরও বেশি দেশ থেকে ১ লাখের ওপর রেজিস্টার্ড শিক্ষার্থী পড়াশুনা করছে। ইসলামী দাওয়াতের কাজে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ সম্প্রতি “৫০০ প্রভাবশালী মুসলিম” এর তালিকায় তিনি স্থান পেয়েছেন।
২০০৮ সালে তিনি নলেজ ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি (KIU) প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা রাখেন। একই বছর সুদানে ওমদুর্মান ইসলামিক ইউনিভার্সিটিতে দাওয়াহ ও ইসলামি সংস্কৃতি বিভাগ (ইংলিশ সেকশন) প্রতিষ্ঠা করেন এবং ভারতের চেন্নাইয়ে প্রিস্টন ইন্টারন্যাশনাল কলেজ প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখেন।
উপসাগরীয় যুদ্ধের (Desert Storm) সময় তিনি রিয়াদের সৌদি আরবীয় বিমান বাহিনী সদর দফতরের ধর্ম বিভাগের অধীনে বাহরাইন ও সৌদি আরবের পূর্ব প্রদেশের ক্যাম্পগুলোতে আমেরিকান সেনাদলের মাঝে বক্তব্য দিতেন।
বিশ্বের বহু দেশে তিনি অসংখ্য বক্তৃতা দিয়েছেন। তিনি Riyadh Channel 2TV, Sharjah TV, Peace TV, Huda TV, Islam Channel, UK এবং The Deen Show সহ নানা চ্যানেলের ইসলামি প্রোগ্রামে অংশ নিয়েছেন।
প্রকাশনাঃ
ড: বিলাল ফিলিপ্স বিভিন্ন বিষয়ে পঞ্চাশটির ওপর ইসলামী বই লিখেছেন। শিশুদের জন্য “ঈমান রিডিং সিরিজ” এর ৫৬টি বইয়ের সম্পাদনা ও প্রকাশনার সাথে তিনি যুক্ত ছিলেন। এছাড়াও ইসলামি বিভিন্ন ক্লাসিকাল বইয়ের অনুবাদ ও ব্যাখ্যাও করেছেন তিনি যেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো Ibn Taymiyyah’s Essay on the Jinn, The Devil’s Deception এবং The Radiance of Faith.
তাঁর বিখ্যাত বইগুলোর মধ্যে রয়েছে-
- The Fundamentals of Tawheed,
- The Evolution of Fiqh,
- The Quran’s Numerical Miracle – Hoax and Heresy,
- Tafseer Soorah al-Hujurat,
- Tafseer Soorah al-Buruj,
- Contemporary Issues,
- Ramadan Reflection,
- Usool al Hadeeth,
- Usool at Tafseer,
- Usool al Fiqh,
- The True Religion of God,
- Did God Become Man,
- Is There A True Religion,
- The Clash of Civilization,
- Salvation through Repentance,
- The Mirage in Iran ইত্যাদি।
এছাড়া সহলেখক হিসেবে “Polygamy in Islam” বইটিও তিনি রচনা করেন।
“The fundamentals of Tawheed” বইয়ে তিনি ইসলামি একত্ববাদী আক্বীদার সঠিক ব্যাখ্যা তুলে ধরেছেন। আল-কুর-আন ও সুন্নাহর আলোকে আক্বীদার শাখাগুলো ব্যাখ্যা করেছেন, ব্যাখ্যা করেছেন শিরকের বিভিন্ন শাখাসহ ধ্বংসাত্মক দিকগুলো। পাশাপাশি বর্তমানে পাশ্চাত্য সমাজে প্রচলিত বিদ’আত নিয়ে সহজবোধ্য আলোচনা করেছেন।
তাঁর “The Evolution of Fiqh” বইয়ে মাযহাবী গোঁড়ামি নিয়ে আলোচনা করেছেন এবং বর্তমানে প্রচলিত চার মাযহাবের উত্থান ও প্রভাব সম্পর্কে দক্ষ হাতে বর্ণনা করেছেন। বইয়ের শেষে তিনি একজন মুসলিমের করণীয় হিসেবে আল্লাহর রসূল (সা) ও তাঁর সঠিকপ্রাপ্ত সাহাবাদের পথ ও পন্থা অনুসরণে তাগিদ দিয়েছেন।
তিনি “Mirage in Iran” বইটিতে খোমেনীর মিথ্যা দাবী ও আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা’আহর আক্বীদা নিয়ে শিয়াদের মিথ্যাচারের মুখোশ উন্মোচন করেছেন।
এ যাবত তাঁর প্রকাশিত বইগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত হলো তাঁর পিএইচডি থিসিসের জন্য লেখা “The Exorcist Tradition in Islam”। এ বইটি বিশ্বের সর্বাধিক বিক্রিত বইয়ের তালিকায় উঠে এসেছে। জ্বীনজাতির অদৃশ্য জগত নিয়ে তাঁর এই গবেষণামূলক বইটি এ বিষয়ে জ্ঞানপিপাসুদের জন্য একটি অবশ্য পাঠ্য।
ড: বিলাল ফিলিপ্সের জীবন নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করে তাঁর কর্মবহুল জীবনে প্রতি সুবিচার করা সম্ভব নয়। আল্লাহ দ্বীনের সেবক ও আলিম এই মহান মানুষটিকে রক্ষা করুন। সত্য ও দ্বীনের সেবায় তাঁর খেদমত তরুণদের জন্য এক অসামান্য প্রেরণার উৎস হয়ে আছে।