তায়েফ: রক্তাশ্রুর স্মৃতি

গতকালই এজেন্সি থেকে জানানো হয়েছিল তায়েফ যিয়ারার কথা। হজ যেহেতু শেষ, এখন কিছুটা রিল্যাক্স মুডে যিয়ারায় যাওয়া যাবে। আমরা যারা মদীনায় আগে গিয়েছিলাম তারা মক্কার আযিযিয়াতে পৌঁছি হজের কয়েকদিন আগে। একারণে আমাদের আগে যিয়ারায় যাওয়া হয়নি, তাই এই সময়টাই বেছে নেওয়া হল যিয়ারার জন্য। পুরো কাফেলার অল্প কিছু মানুষ ছিল আমাদের সাথে কারণ বেশিরভাগ সদস্যই ফুল প্যাকেজে আগে মক্কায় এসেছিলেন এবং তখনই এক দফা তায়েফ সফর সেরে নিয়েছিলেন। যাই হোক, আমরা গুটি কয়েক মানুষ দুটি মাইক্রোবাস নিয়ে রওনা দিলাম তায়েফের উদ্দেশ্যে। আমাদের সফরসঙ্গী শাইখ রফিকুল ইসলাম মাদানী। উনাকে এই সফরে পাওয়াটা আমাদের জন্য বিশেষ সৌভাগ্যের কারণ ছিল। যদিও আমাদের পুরো হজের সফরটাই শাইখ আমাদেরকে দারুণভাবে মোটিভেট করে যাচ্ছিলেন তবুও যিয়ারার দিনগুলিতে শাইখের সান্নিধ্য আমাদেরকে দারুণ আবেগাপ্লুত করে তুলেছিল।
তায়েফের সৌন্দর্য উপলব্ধির জন্য তায়েফ পৌঁছানো লাগে না, এর কাছাকাছি আসাই যথেষ্ট। উঁচু উঁচু পাহাড়ের কোল ঘেঁষে চলে যাওয়া সর্পিল রাস্তা দিয়ে গাড়ি যতই উপরে উঠতে থাকে ততই আমাদের মুগ্ধতা বাড়তে থাকে। যদিও এর আগে ২০১৮ তে আমি উমরার সফরে এসে তায়েফ দেখেছিলাম তবুও কিছুটা স্মৃতিভ্রষ্টতা আর কিছুটা উত্তেজনা আমাকে নতুনভাবে তায়েফ চেনাল। দু’পাশে যতই তাকাই, চোখ স্থির হয়ে থাকে প্রগাঢ় সৌন্দর্যে আর মেঘের আবরণে। গাড়ি উঠতে থাকে পাহাড় বেয়ে আর আমরা দুপাশে নিচের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে ভাবি- ‘এত উপরে উঠে গেলাম!’ পাহাড়ের পুরো সৌন্দর্যটা উপর থেকে ধরা পড়ে আর এটাই তায়েফ ভ্রমণের অন্যতম আকর্ষণ। এভাবে একসময় আমাদের গাড়ি পৌঁছে গেল মসজিদে ইবনে আব্বাসের কাছে। সদলবলে গাড়ি থেকে নেমে সবাই এদিক ওদিক ঘুরে ঘুরে দেখছি, এমন সময় শাইখ রফিকুল ইসলাম এক বক্স আইসক্রিম নিয়ে হাজির-শেফার্ডস এর সালেহ ভাই এর নাকি এমনি নির্দেশনা!
সবাই আইসক্রিম খেতে খেতে সারিবদ্ধ হয়ে বসলাম, শাইখের নির্দেশে। এরপর তায়েফে নবীজির আগমনের ইতিহাস এবং দাওয়াতের প্রতিবন্ধকতা নিয়ে শাইখের আলোচনা আমাদেরকে প্রবলভাবে আলোড়িত করে। অতীতেও কতবার এই ইতিহাস শুনেছি আর শুনিয়েছি তবুও শাইখের প্রতিটি কথা যেন আমার অন্তর ক্ষত-বিক্ষত করে দিচ্ছিল।
মক্কার কুরাইশরা যখন ব্যাপকভাবে রাসূল ﷺ এর দাওয়াত প্রত্যাখ্যান করল এবং নানাবিধ অত্যাচার-নির্যাতনে রাসূল ﷺ ও মুসলিমদেরকে জর্জরিত করে ফেলল তখন রাসূল ﷺ যায়েদ বিন হারিসা রা: কে নিয়ে নবুওয়াতের ১০ম বছরের শাওয়াল মাসে মক্কা থেকে প্রায় ৬০ মাইল দূরে অবস্থিত তায়েফে গেলেন। তাঁর আশা ছিল তায়েফের মানুষ ইসলাম গ্রহণ করবে এবং তাঁর সাহায্যকারী হবে। কিন্তু বাস্তবে হল এর উল্টো। তায়েফে গিয়ে তাঁকে এক তিক্ত অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হয়। তায়েফের মানুষ তো ইসলাম কবুল করলই না; বরং তায়েফের ছোট-বড়, আবাল, বৃদ্ধ-বনিতা প্রত্যেকেই তাঁর সাথে অত্যন্ত ন্যাক্কারজনক আচরণ করল। রাসূল ﷺ তায়েফে দশ দিন অবস্থান করে নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের প্রত্যেককে ইসলামের দাওয়াত দিলেন। কিন্তু তারা সকলেই সেই দাওয়াত প্রত্যাখ্যান করে তাঁকে তায়েফ থেকে চলে যেতে বলল। এরপর তিনি সাধারণ মানুষদেরকে দাওয়াত দিলেন। কিন্তু তারাও তাঁর দাওয়াত অস্বীকার করল। ফলে ভগ্নহৃদয়ে তিনি মক্কায় ফিরে আসার প্রস্তুতি নিলেন। ফেরার পথে তাঁকে উত্ত্যক্ত, অপমানিত ও কষ্ট দেওয়ার জন্য শিশু-কিশোর, যুবকদেরকে তার পেছনে লেলিয়ে দেওয়া হলো। পথের দু’পাশে তারা হাত তালি দিয়ে অশ্লীল কথাবার্তা বলতে থাকল এবং তাকে গালমন্দ দিতে থাকলো ও পাথর দ্বারা আঘাত করতে থাকলো। আঘাত এর ফলে রাসূল ﷺ এর পায়ের গোড়ালিতে ক্ষত সৃষ্টি হল এবং রক্ত জমাট বেঁধে পায়ের জুতো পায়ের সাথে আটকে গেল। এভাবে পথ চলতে চলতে ক্লান্ত, অবসন্ন এবং বিধ্বস্ত অবস্থায় তিনি তায়েফ থেকে কিছুটা দূরে এক আঙুরের বাগানে আশ্রয় নিলেন।
সেখানে বিশ্রামের এক পর্যায়ে নবীজির চোখ বেয়ে ঝরে পড়ছিল কষ্ট ও অপমানের অশ্রু, কিন্তু রহমতের নবী নিজ হাত দিয়ে চোখের পানি আঁটকে মাটিতে পড়তে বাধা দেন কেননা তিনি জানতেন- এর ফলে যে ভূখণ্ডের মানুষ তাদের নবীকে কাঁদিয়েছে আল্লাহ তা’আলা সেই ভূখণ্ড ও তার মানুষগুলোকে ধ্বংস করে ছাড়বেন। আর তা হতেও চলেছিল। ফেরার পথে তিনি যখন ‘কারনে মানাজেল’ নামক স্থানে পৌঁছলেন তখন পাহাড়-পর্বত নিয়ন্ত্রণকারী ফেরেশতাকে নিয়ে জিবরীল আ: আসলেন। তিনি বললেন, রাসূল ﷺ যদি ইচ্ছে করেন তাহলে তারা দুই পাহাড় একত্রিত করে তায়েফবাসীকে পিষে দেবেন। কিন্তু রাসূল ﷺ বললেন, ‘না; বরং আমার আশা মহান আল্লাহ এদের থেকে এমন বংশধর সৃষ্টি করবেন যারা একমাত্র তাঁরই ইবাদত করবে এবং অন্য কাউকে তাঁর অংশীদার করবে না।’
সুবহানাল্লাহ! যাঁকে স্বয়ং আল্লাহ অভিহিত করেছেন ‘রহমাতুল্লিল আলামীন’ হিসেবে, তিনি তো এমনই দয়াময় হবেন, হবেন ‘ভিশনারি’ লীডার। দেখুন, নবীজির দাওয়াতের উদ্দেশ্য কেবল তায়েফের মানুষের ইসলাম গ্রহণ ছিল না বরং তাদের বংশধরেরাও যেন ইসলামের পথে আসেন এটাই ছিল নবীজির একান্ত চাওয়া। আর এজন্যই তায়েফের মানুষদের থেকে এত কষ্ট পেয়েও তিনি তাদের ধ্বংস চাননি। যুগে যুগে যারাই নবীজির আদর্শ মেনে দাওয়াতের কাজ করবে তাদের জন্য এই ঘটনায় রয়েছে গভীর চিন্তার খোরাক।
এখানে প্রসঙ্গক্রমে বলে রাখি, কেন নবীজি মক্কার বাইরে দাওয়াতী কাজের জন্য তায়েফকে বেছে নিয়েছিলেন? এর সম্ভাব্য কারণ হল-
❖ তায়েফ ছিল মক্কা থেকে তুলনামূলক কাছে অবস্থিত এবং তায়েফবাসীর সাথে মক্কাবাসীর শান্তিচুক্তি বিদ্যমান ছিল। তাই তায়েফের মানুষকে দাওয়াত দেওয়াটা রাসূল ﷺ তুলনামূলকভাবে নিরাপদ ভেবেছিলেন।
❖ রাসূল ﷺ যদি তায়েফে একটি সাহায্যকারী মুসলিম বাহিনী প্রস্তুত করতে পারতেন তাহলে কুরাইশদের ভিত কেঁপে উঠত এবং তাদের নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক ভিত হুমকির মুখে পড়ত।
❖ ভৌগোলিকভাবে কাছাকাছি অবস্থিত হওয়ার দরুন তায়েফবাসী ও মক্কাবাসীদের মধ্যে একটা সাধারণ জানাশোনা ছিল। মক্কাবাসীদের জন্য তায়েফ কোন অজানা-অচেনা ভূমি ছিল না এবং তায়েফের মানুষের জীবনাচারও অজানা ছিল না। কুরাইশের অনেক ধনী ব্যক্তি তায়েফে জমি কিনে রাখত এবং গ্রীষ্মকাল সেখানে গিয়ে কাটাত।
শাইখ রফিকুল ইসলাম বললেন, বিশিষ্ট সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা: শেষ বয়সে তায়েফে চলে আসেন এবং একটি মসজিদ নির্মাণ করেন। এই মসজিদটিই বর্তমানে মসজিদে আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা: নামে পরিচিত। এখানে আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা: এর কবরও রয়েছে। আমরা এই মসজিদে যুহরের সালাত আদায় করে রওনা দিলাম আরেক গন্তব্যের উদ্দেশ্যে। তায়েফে আমাদের পরের গন্তব্য সে আঙ্গুর বাগান যেখানে নবীজি বিশ্রাম নেওয়ার সময় এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটে যায়। এই ঘটনাটি সীরাতে আমার সবচেয়ে প্রিয় ঘটনাগুলোর একটা।
আঙ্গুর বাগানে বিশ্রাম নেওয়ার সময় দূর থেকে রাসূলের এই অবস্থা দেখে উতবা এবং শাইবা নামক দুই ভাই এর মনে কিছুটা সহানুভূতি জেগে উঠেছিল। আদ্দাস নামে তাদের এক খ্রিষ্টান দাসের হাতে একগোছা আঙুর তারা রাসূল ﷺ এর জন্য পাঠিয়ে দিলো। রাসূল ﷺ সেখান থেকে একটি আঙুর তুলে নিয়ে বিসমিল্লাহ বলে খাওয়া শুরু করলেন। আদ্দাস বলল, ‘এমন কথা তো এই অঞ্চলের লোকদের মুখে কখনো শুনিনি।’ রাসূল ﷺ বললেন, ‘তুমি কোথায় থাকো? তোমার ধর্ম কী?’ সে বলল, ‘আমি খ্রিষ্টান। আমি নিনাওয়ার বাসিন্দা।’ রাসূল ﷺ বলেন, ‘ভালো। তাহলে সৎ ব্যক্তি ইউনুস ইবনে মাত্তার গ্রামে তুমি বাস করো। তাই না?’ সে বলল, ‘আপনি আমাকে কীভাবে চেনেন?’ রাসূল ﷺ বললেন, ‘তিনি আমার ভাই। তিনি নবী ছিলেন এবং আমিও নবী।’ একথা শুনে সে রাসূল ﷺ এর দিকে ঝুঁকে পড়ল এবং তার মাথায়, হাত-পায়ে চুমু দিলো। আদ্দাস সেখানেই নবীজির কাছে ইসলাম গ্রহণ করে।
এই ঘটনার মাঝে প্রতিটি মুসলিমের জন্য এক চমৎকার শিক্ষা লুকিয়ে আছে। নবীজি আদ্দাসকে ইসলামের কোনো বয়ান দেননি, তিনি শুধু ‘বিসমিল্লাহ’ বলে আঙ্গুর মুখে দিয়েছিলেন আর এটাই যথেষ্ট হয়েছিল আদ্দাসের ইসলাম গ্রহণের জন্য। অর্থাৎ সুন্নাহ নিজেই একটি দাওয়াহ। আমরা যখন পরিপূর্ণ সুন্নাতের অনুসরণ করব এবং আমাদের কথা-কাজ ও আচরণে সুন্নাহকে ধারণ করব তখন মানুষ আমাদের সান্নিধ্যে ইসলামের সৌন্দর্য খুঁজে পাবে এবং এখান থেকেই অনেকে ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় নিবে।
আমরা সেই আঙ্গুর বাগান দেখলাম, ছবি তুললাম। আমার ধারণা ছিল বাগানটি বুঝি বড় আকৃতির কোনো বাগান হবে কিন্তু অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম বাগানটি একেবারেই ছোট্ট এবং অনেকটা স্কয়ার আকৃতির। সেই বাগানের উঁচু প্রাচীরে এখন একটি আরবী সাইনবোর্ড দেওয়া আছে যেখানে এই বাগানের ইতিহাস অতি সংক্ষেপে লিখে দেওয়া হয়েছে দর্শনার্থীদের জন্য। বাগানের ঠিক সামনেই (উল্টো পাশে) রয়েছে একটি ছোট্ট মসজিদ। শাইখ জানালেন, আদ্দাস ইসলাম গ্রহণের পর নবীজি তাকে সাথে নিয়ে এখানে দুই রাকাত সালাত আদায় করেছিলেন, তাই বর্তমানে সেখানে এই মসজিদ নির্মাণ করা হয়েছে। মসজিদটির নাম- মসজিদে আদ্দাস। আমরা এই মসজিদে ২ রাকাত নফল সালাত আদায় করলাম।
এবার ফেরার পালা। দু’একজন বাদে প্রায় সকলেই ফিরতি পথে উমরার ইহরাম বাঁধার জন্য ইহরামের কাপড় নিয়ে এসেছিলাম। তায়েফ থেকে মক্কায় ফেরার পথে মিকাত হল ‘কারনুল মানাযেল’। এখানে আমাদের মাইক্রোবাস থামল। আমরা নামলাম, পুরো মিকাত এরিয়াটা ঘুরে ঘুরে দেখলাম। চমৎকার ব্যবস্থাপনা- বিশেষত এখানে অনেকগুলো হাম্মাম ও টয়লেট রয়েছে ইহরামকারীদের গোসল, ওযু ও ফ্রেশ হয়ে নেওয়ার জন্য। স্বাভাবিকভাবেই এগুলোর পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতাও চোখে পড়ার মত। এখানে কয়েকজন বাঙ্গালী ক্লিনারের সাথে কথা হল। তাদের দেখলে আমরা অনেকেই হয়ত ভাবি- আহারে তারা কত সৌভাগ্যবান এমন একটি জায়গার খাদেম হতে পেরে! অথচ তাদের কথায় আক্ষেপ আর কষ্ট ঝরে পড়ছে। এই আক্ষেপ কাজের চাপ অনুযায়ী উপযুক্ত পারিশ্রমিক না পাওয়ার আক্ষেপ, এই কষ্ট দরিদ্রতার কষ্ট। আমরা তাদের সামান্য কিছু হাদিয়া দেওয়ার চেষ্টা করি।
সবার ইহরাম হয়ে গেলে গাড়িতে উঠে গেলাম। ফেরার পথে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নামার সময় দেখা গেল এক ঝাঁক বেবুন- রাস্তার রেলিং এর উপর বসে মহানন্দে কী যেন খাচ্ছে! আমাদের হাতে জুসের বোতল ছিল। মাইক্রোবাস থেকে এক আংকেল বেবুনসমাজের জন্য একটি বোতল ছুঁড়ে দিল। তারা পড়িমড়ি করে এসে বোতল লুফে নিয়ে গেল! আমরাতো এই দৃশ্য থেকে হাসতে হাসতে শেষ!
কিন্তু আসলেই কি তাই? মনের গহীনে বারবার একটাই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছিল- আবার কবে আসব এই প্রিয় তায়েফে? আবার কবে আসব বনু সাকীফের এই বাসভূমিতে? ইয়া আল্লাহ! আপনি দ্রুতই তৌফিক মঞ্জুর করেন, বারবার ফিরে নিয়ে আসেন বনু সাকিফ, আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস কিংবা আদ্দাসের স্মৃতিবিজড়িত এই পুণ্যভূমিতে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *