দেখতে দেখতে মদীনার দিন ফুরিয়ে আসছে। গতকাল রাতেই বলা হয়েছে আজ আমরা যাব মদীনার একটি মিউজিয়াম দেখতে- দার আল মাদীনা। প্রথমে খুব একটা এক্সাইটেড ছিলাম না। ভেবেছিলাম আর দশটা মিউজিয়ামের মতই বুঝিবা কিছু। কিন্তু তারেক ভাইয়ের বারংবার তাগাদা দেখে মনে হল এই মিউজিয়াম বুঝি ‘স্পেশাল’ কিছু।
আমরা বাসে করে সদলবলে রওনা দিলাম। সময়মত মিউজিয়ামে পৌঁছে এক জায়গায় বসানো হল। এরপর দুটি গ্রুপে ভাগ করা হল- যারা পুরো ধারাভাষ্য বাংলায় শুনতে চান আর যারা ইংরেজিতে শুনতে চান। আমরা রয়ে গেলাম বাংলা গ্রুপে। যাই হোক, মিউজিয়ামের ভেতরে ঢুকে দেখলাম সারি সারি কাঁচে ঘেরা স্ট্রাকচার। ছেলে ও মেয়েদের আলাদা সারিতে জড়ো করে আমাদের ইন্সট্রাক্টর (খুব সম্ভবত বাংলাদেশি) পরিষ্কার বাংলায় বর্ণনা দিতে শুরু করলেন। নবীজির নবুওয়াত লাভ থেকে শুরু করে হিজরত পর্যন্ত এক নাগাড়ে বলে গেলেন। সামনের স্ট্রাকচারে হাতে থাকা লেজার লাইট দিয়ে বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন ঘটনাগুলোর ভৌগোলিক সেট আপ। বেশ মজা লাগল দেখে, বর্ণনার এক জায়গায় এসে দেখি উনি লেজার লাইটের এক বাটনে চাপ দেওয়ার সাথে সাথে কিছু কিছু পাহাড়ের স্ট্রাকচারের উপর মোমবাতির মত লাইট জ্বলে উঠল- তিনি বুঝাতে চাচ্ছিলেন এগুলো ছিল পোড়া পাহাড়। নবীজির পুরো হিজরতের গল্পতো কত অসংখ্যবার পড়েছি পড়িয়েছি কিন্তু এবার স্ট্রাকচারগুলো দেখতে দেখতে মুগ্ধ হয়ে শুনছিলাম। মনের মধ্যে তীব্র আশা জাগল- দেশে কি এমন কিছু করা যায় না? ছোটো পরিসরে হলেও? আমার বিশ্বাস, সীরাতের প্রতিটি ঘটনা এভাবে দেখাতে পারলে তা সীরাত শিক্ষায় বিপ্লব নিয়ে আসবে।
একে একে বদর, উহুদ, খন্দক থেকে নিয়ে মক্কা বিজয় ও নবীজির ইন্তেকাল পর্যন্ত পুরোটা তিনি আমাদের প্রোটোটাইপ স্ট্রাকচার দেখিয়ে বোঝালেন। দেখালেন ইব্রাহীম আ: থেকে শুরু করে মুহাম্মাদ সা: পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে কাবার গঠন পরিবর্তনের মডেল, রাসূল সা: থেকে নিয়ে এখন পর্যন্ত মসজিদে নববীর ক্রমবিবর্তন দেখিয়ে একেবারে শেষে গিয়ে নবীজির রওজার স্ট্রাকচার দেখালেন এবং ভেতরের গঠন ডিটেইল বললেন। এর আগে প্রথম ইয়াসির কাদ্বীর লেকচারেই এই ব্যাপারে শুনেছি ও এনিমেটেড পিকচার দেখেছি, এবারই প্রথম সামনাসামনি রওজার মডেল দেখা হল। কিছু কিছু কাঁচের বাউণ্ডারির মধ্যে দেখলাম মাটি ও কন্সট্রাকশনের ম্যাটেরিয়াল এদিক-সেদিক বিক্ষিপ্ত পড়ে আছে। বুঝলাম আরও বেশ কিছু যুদ্ধ ও ঐতিহাসিক ঘটনার মডেল নির্মাণের কাজ চলমান।
এবার বের হওয়ার পালা। আসার সময় যেখানটায় বসতে দেওয়া হয়েছিল সেখান দিয়েই বের হলাম। চোখে পড়ল সেখানে ছোট্ট একটি স্যুভেনিরের শপ আছে- কাবাঘর, মসজিদে নববী, মসজিদুল হারাম এমন আরও কিছু শো-পিস ছিল তবে সেগুলো ছাপিয়ে যে জিনিষটা নজর কাড়ল তা হল- মুদ ও সা’ এর পাত্র। আমরা সাধারণত কেজিতে কনভার্ট করে মুদ ও সা’ পরিমাপ করি। অথচ এই পাত্র থাকলে সরাসরি এখান থেকেই মুদ ও সা’ এর প্রকৃত পরিমাণ বোঝা যেত। অসংখ্য হাদীসে বিভিন্ন পরিমাপের মাপকাঠি হিসেবে মুদ ও সা’ এর কথা এসেছে। কেনার লোভ থেকে দাম জিজ্ঞেস করতেই ধাক্কা খেলাম। তাই আপাতত কেনার ইচ্ছাটাকে দমিয়ে একটি সীরাহ এলবামের (অনেকটা বই এর মত- সীরাহ এনসাইক্লোপিডিয়া বলা যায়) দাম জিজ্ঞেস করলাম। সেটার দাম শুনেও দমে গেলাম। এক ভাই বুদ্ধি দিলেন- কয়েকজন মিলে টাকা তুলে অরিজিনাল কপিটা কিনে সেটা নীলক্ষেত থেকে সবাই ফটোকপি করে নিলে কেমন হয়? বুদ্ধিটা মন্দ ছিল না তবে কেন যেন আর নেওয়া হল না শেষ পর্যন্ত!