দু’আ এবং তার সাথে তাকদীরের সম্পর্ক

দু’আর সাথে তাকদীরের সম্পর্কের বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ন এবং যেটা নিয়ে মানুষে অনেক সন্দেহের বেড়াজালে ঘুরপাক খায়। অনেক লোক প্রশ্ন করে “ যদি কি ঘটবে তার সবকিছু পূর্ব নির্ধারিত হয়, তাহলে দোয়ার কাজ কি? যদি আমি যা চাই আল্লাহ তা লিখে রাখেন তাহলে দু’আ না করেও সে জিনিসটি পাব আর যদি সেটা আমার জন্য লিখিত না থাকে তাহলে আমি যতই দু’আ করি না কেন সেটা আমি কখনোই পাবনা”।

‘কোন কিছুর ফলাফল নির্ভর করে সে কাজটি সুসম্পন্ন করতে যে প্রচেষ্টার প্রয়োজন তার উপর’ এবং উপরোক্ত প্রশ্নটির উত্তর এ কথাটির মধ্যেই নিহিত। অন্যকথায় এটি ইতিমধ্যেই ফয়সালাকৃত, যেমন – একটা বীজ তখনই ফল দেবে যদি তা রোপন করা হয়। কিন্তু এটা ঘটবে না যদিনা কৃষক এটার সেচকাজ, পরিচর্যা, বীজটি রক্ষনাবেক্ষন, এবং যে বিষয়গুলো ফলদানের জন্য অত্যাবশ্যকীয় সেগুলোর যথাযথ ব্যবস্থা না করেন।

অতএব যদিও একটা লোক তাকদীরে বিশ্বাস স্থাপন করে, তাকে সাথে সাথে অবশ্যই তার সকলরকম প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে তাঁর লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য। তাই দু’আ একটা উপায় যা একজন মানুষ তাঁর কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য ব্যবহার করে থাকে এবং এ ‘উপায়’ অবলম্বনের বিষয়টি কোনভাবেই সেই ব্যক্তির ভাগ্যের বিপরীতে যায় না যা তার জন্য লেখা হয়েছে।

এই বিষয়টি রাসূল (সঃ) এর কথা দ্বারা পরিষ্কার হওয়া যায় যা সাওবান বর্ননা করেছেন। রাসূল (সঃ) বলেন-

“কেবল সৎ কর্মই আয়ু বৃদ্ধি করে এবং দুআ ব্যতীত অন্য কিছুতে তাকদীর রদ হয় না। এবং নিশ্চয়ই একজন মানুষ একটি গুনাহ করার দ্বারা তার রিযক থেকে বঞ্ছিত হতে পারে!”। (1)

অন্যকথায় ভাল কাজ করাই মানুষের আয়ু বৃদ্ধির কারণ, তাই কেউ যথাযথ প্রচেষ্টা নিলে ফলাফল আসবে। এবং এটাও পূর্বনির্ধারিত। অতএব একটি লক্ষ্য অর্জনের উপায় এবং লক্ষ্যটি অর্জন, দুটোই পূর্বনির্ধারিত।

কেউ যদি আপনাকে প্রশ্ন করে-

“ দু’আ কিভাবে তাকদীর পরিবর্তন করে?”

আমরা যে উত্তর দেব-

‘বিষয়টা হচ্ছে আপনি অসুস্থ হতে পারেন সেটা পূর্বনির্ধারিত। আপনি আল্লাহর কাছে আপনার রোগমুক্তির জন্য দু’আ করবেন (এ অসুস্থতা এবং আপনার দু’আর মাধ্যমে সুস্থতা চাওয়া দুটোই পূর্বনির্ধারিত) একইভাবে কোন লোক তাঁর পূর্বনির্ধারিত রিযক থেকে বঞ্চিত হতে পারে, যেহেতু আল্লাহ তাঁর অসীম জ্ঞানের মাধ্যমে বিষয়টি জানেন যে এ লোকটি গুনাহ’র কাজ করবে এবং গুনাহটি তার রিযক থেকে বঞ্চিত হওয়ার কারন হয়ে দাঁড়াবে। এ সবকিছুই ঘটে সকল প্রশংসার দাবীদারর আল্লাহর আদেশেই। অনেক হাদীসেই এ বিষয়টি পরিষ্কারভাবে তুলে ধরা হয়েছে। যেমন মুয়ায ইবনে জাবাল বর্নিত,রাসূল (সঃ) বলেছেন-

“ পূর্ব সতর্কতা তাকদীরের বিপক্ষে কোন উপকারে আসেনা, কিন্তু দু’আ সবকিছুর উপকার করে তা আসুক বা না আসুক। তাই আমি তোমাদেরকে উপদেশ দিচ্ছি হে আল্লাহর বান্দারা তোমরা দু’আ কর। (2)

তাই একজন লোক যতই সতর্ক হোকনা কেন, সে তার জন্য যা লেখা আছে সেখান থেকে পালিয়ে বাঁচতে পারেনা। কারণ আল্লাহ সবকিছু নিয়ন্ত্রন করেন এবং কোন কিছুই তাঁর জ্ঞান এবং ক্ষমতা থেকে মুক্ত নয়। অবশ্য দু’আর মাধ্যমে আল্লাহর কাছে ফিরে গেলে পূর্বনির্ধারিত বিষয়গুলোও এড়ানো সম্ভব। সালমান আল ফারেসী (রাঃ) থেকে বর্নিত রাসূল (সঃ) বলেছেন-

“দু’আ ছাড়া অন্য কিছুই তাকদীর পরিবর্তন করতে পারেনা, এবং ভাল কাজ ব্যতীত কোন কিছুই আয়ু বৃদ্ধি করতে পারেনা” (3)

এই হাদীসটিতে কোন অস্পষ্টতা নেই। তাকদীর পরিবর্তনের একমাত্র পথ হচ্ছে দু’আ। তাই এটা হতে পারে যে, অপ্রীতিকর কিছু আমাদের জন্য পূর্বনির্ধারিত হয়ে আছে কিন্তু দু’আ না করার ফলে আমরা সেটা এড়িয়ে যেতে পারিনি। তাই,যদি দু’আ করা হয় এ বিষয়টি ঘটবেনা অপরদিকে দু’আ না করলে দুর্ভাগ্য আমাদের গ্রাস করবে।

তিরমীযির আরেকটি বর্ননাও বিষয়টির সমর্থন দেয়। রাসুলুল্লাহ (সঃ) বলেছেন-

“পৃথিবীতে এমন কোন মুসলিম নেই যে কিনা আল্লাহর কাছে যেকোনো কিছু চায় এবং আল্লাহ তাকে দেন না অথবা সমপরিমান কোন খারাপ তার কাছ থেকে সরিয়ে দেন না, যতক্ষন না তারা কোন খারাপ কিছু চায় অথবা আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করে” (4)

এই বর্ননা থেকে দু’আর উপকারীতা স্পষ্ট, এবং এটার মূল্য উপলব্ধি করা যায়। দু’আর মাধ্যমে একজন শুধু পুরস্কৃতই হননা বরং এটা খারাপ দূরীকরনও ঘটায় (যা তার জন্য নির্ধারন করা হয়েছিল),  এবং তার প্রত্যাশিত ভাল কিছু লাভ করারও কারণ।

ইবনে হাজার (রহঃ) দু’আর উপকারীতা নিয়ে বলতে গিয়ে বলেন-

“…এবং দু’আর উপকারীতা হচ্ছে,(আল্লাহ্‌র দু’আ করার) আদেশ পালনের মাধ্যমে পুরস্কার অর্জন, এবং সাথে সাথে যা চাই সেটার অর্জন। যেহেতু আল্লাহ প্রচেষ্টা এবং প্রচেষ্টার ফলাফল দুটোরই স্রষ্টা তাই সম্ভাবনা আছে যে আমাদের অনুরোধগুলো দু’আর উপর নির্ভরশীল।” (5)

এই লেখার শুরুতে যে প্রশ্নগুলোর কথা বলা হয়েছে ইবনে কাইয়ুমের ভাষায় এর জবাব নিম্নরুপ-

“ এরকম বাদানুবাদের যৌক্তিক ফলাফল হচ্ছে সকল প্রচেষ্টাকে পরিত্যাগ করা। যারা এরকম ধারণা পোষন করে তাদেরকে এভাবে বলা যায় যে,- ‘ যদি তোমার ক্ষুধা ও তৃষ্ণার পরিতুষ্টি ইতিমদ্ধেই লেখা হয়ে থাকে, তাহলে  সেটা পরিপূর্ন হবে, তুমি খাও অথবা না খাও। অপরদিকে যদি এটা না লেখা থাকে, তাহলে তুমি খাও অথবা না খাও এ পরিতুষ্টি কখনোই আসবেনা। এবং একটি সন্তান যদি তোমার জন্য নির্ধারন করা থাকে, তা তোমাকে দেয়া হবে, তুমি তোমার স্ত্রীর সাথে মিলিত হও বা না হও। অপরদিকে যদি তা নির্ধারন করা না থাকে,  তোমাকে কখনোই সন্তান দেয়া হবেনা। সে ক্ষেত্রে তোমার বিয়ে করেও কোনও লাভ নেই…!”

‘এখন কোন বিবেকবান মানুষ কি একমত হবে এই সকল উপসংহারের সাথে ?” (6)

সংক্ষেপে,  তাহলে  তাকদীর দু’আ না করার ক্ষেত্রে কোন বাহানা হতে পারেনা। কেউ যেমন পার্থিব খাদ্য, পানীয় এবং পরিবারের জন্য প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখে তেমনি তাকে ধর্মীয় বিষয়গুলোর ক্ষেত্রেও লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। দু’আ অন্তঃর্নিহিতভাবেই তাকদীরে সাথে সংযুক্ত। এমনকি এটা তাকদীরেরই অংশ। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ইতিমদ্ধেই এ আদেশ করেছেন যে বান্দার কোন বিষয় মঞ্জুর অথবা কোন খারাপ থেকে তাকে মুক্ত করা হবে যদি সে দু’আ করে। তাই সে যদি দু’আ পরিত্যাগ করে সে তাঁর লক্ষ্যে পৌঁছাতে সক্ষম হবেনা।

এ কারনে বিতর নামাযে নিম্নোক্ত দোয়াটি পড়া রাসূল (সঃ) এর সুন্নাহ-

“……আপনি যা দিয়েছেন তাতে আপনি বরকত দিন। আপনি আমার তাকদিরে যা রেখেছেন এর অসুবিধা থেকে আমাকে রক্ষা করুন, কারন নিশ্চয়ই আপনিই ফয়সালা দেন(সবকিছুর), এবং আপনার বিপরীত তো ফয়সালা দিতে পারে না কেউ”। (7)

এজন্য মুসলিমররা আল্লাহর নিকট ফিরে যায় এবং তাঁর কাছেই প্রার্থনা করে যেন সকল এবং যেকোনো খারাপ কিছু তার কাছ থেকে সরিয়ে নেয়া হয়।

সাথে সাথে এটা মনে রাখতে হবে তাকদীর এমন একটা বিষয় যেটা মানুষ সীমিত বুদ্ধিবিবেচনা এবং সীমাবদ্ধ সামর্থ্যের কারণে কখনোই পুরোপুরি হৃদয়ঙ্গম করতে পারেনা। প্রকৃত মুসলিম যারা তারা তাকদীরের জটিল দর্শনে অতিরিক্ত হাবুডুবু খায়না। বরং, অতীতে যা ঘটে গেছে সেটাকে পূর্বনির্ধারিত হিসেবে গ্রহণ করে ভবিষ্যতের ইচ্ছা আকাঙ্ক্ষার জন্য প্রচেষ্টা চালিয়ে যায়(যতক্ষন পর্যন্ত এটা তার জন্য অনুমোদিত হয়)। যেহেতু সে জানেনা তার ভবিষ্যৎ বিষয়ে কি লেখা আছে, সে আল্লাহর নিকট সর্বোত্তমটাই আশা করে, এবং সেটা পাওয়ার জন্য সাধ্যের সবটুকু করে। যেমনিভাবে আল্লাহর ইচ্ছায় মানুষ প্রতিদিন কাজে যায় এবং মাস শেষে “পে-চেক” পায়, তেমনিভাবে আল্লাহর ইচ্ছায় দু’আর মাধ্যমে মানুষ অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারে।

আল হিদায়া পাবলিকেশনের Dua: The Weapon of the Believer বইথেকে আর্টিকেলটি নেয়া হয়েছে।

ফুটনোটঃ

1 Narrated by Ibn Majah #90, and Shaykh al-Albani said in Sahih Ibn Majah (73): “It is authentic without the addition, ‘And verily…’; see al-Sahihah, # 154.” 
2 This hadith is weak. It was narrated by Ahmad, Abu Ya’la , and al-Tabarani in al-Kabir, as has been mentioned in Da’if al-Jami’ # 4785. 
3 Authentic, reported by al-Tirmidhi and al-Hakim from Salman, and is in Sahih al-Jami’ # 7687. 
4 Authentic, narrated by al-Tirmidhi from ‘Ubadah ibn Samit, as is mentioned in Sahih al-Jami’ # 5637. 
5 Fath al-Bari, 11/95. 
6 Al-Jawab al-Kafi, Ibn aI-Qayyim, p. 13. 
7 Reported by al-Tirmidhi (# 464), al-Nasa’i (# 1725) and others, with an authentic chain.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *