দোস্ত, অফিসে থাকি বলে…

সেদিন এক ফ্রেন্ডের সাথে কথা হচ্ছিলো, তো কথাপ্রসঙ্গে নামাজের কথা আসলে জানালো, অফিস করিতো, কয়েক ওয়াক্ত নামাজ ওখানেই চলে যায়….

ইন্টার্নীতে ঢোকার আগে মাঝে মাঝেই সিনিয়রদের কাছে শুনতাম: ওটিতে গিয়ে সালাত মিস হয়ে যায়। কি করি বলোতো!

কেউবা আরেকটু লজিক্যালি বলতো: সরকারি মেডিক্যালে এডমিশান ডে তে এত রোগীর প্রেশার, নামাজে যাওয়ার তো কোন সুযোগই নেই!

আমি যেহেতু তখনও ইন্টার্নি করিনি, ঐ লাইফের অভিজ্ঞতা আমার হয়নি, আর যেটা নিজে ফেইস করিনি সে বিষয়ে গলার জোরে উপদেশ দেওয়াটাও খাটেনা।

তো আলহামদুলিল্লাহ অবশেষে ইন্টার্ন ডক্টর হিসেবে রামেকহায় জয়েন করলাম। একবছর ডিউটির মাঝে ছ’মাস সুস্থ শরীরে, পরের ছ’মাস বাবু পেটে নিয়ে, বড় রকমের অসুস্থতার মধ্যে ডিউটি করেছি(বড় রকমের অসুস্থতা বলার কারণ, আমার প্রেগন্যান্সি পিরিয়ডটা সহজ ছিলোনা, আলহামদুলিল্লাহ। খাওয়ার অরুচি, বমিভাব, মেটালিক টেস্ট এসব তো ছিলই, উপরন্তু সবচে বিরক্তিকর কষ্ট ছিলো স্যালাইভেশন/স্পিটিং, কন্টিনিউয়াস মুখ ভরে পানি আসতো। এডমিশান ডিউটিতে, ওটিতে একটু পরপর নিক্বাব মেইন্টেইন করে স্পিটিং করা যে কি ভয়ংকর অভিজ্ঞতা, মনে করতেও এখন শিউরে উঠি। এমনও রাত গেছে, মিডনাইট পর্যন্ত জানালার পাশে বসে স্পিটিং করছি, ঐসময় IOU মিডটার্মগুলোও দিয়েছি জানালার পাশে বসে।)

তো যেটা বলতে চাচ্ছিলাম, এই একটা বছরে মর্নিং, ইভিনিং, নাইট ডিউটি, এডমিশান ডিউটি, ওটি সব মিলিয়েই একটা ওয়াক্ত নামাজও কাযা হয়নি, আলহামদুলিল্লাহ। নিজেকে নিয়ে গর্ব করার জন্য বলছিনা, বরং যারা বলে থাকেন ডিউটিতে নামাজ মেইন্টেইন করা অসম্ভব, তাদেরকে বোঝানোই আমার উদ্দেশ্য- কঠিন হলেও এটা ‘সম্ভব’। আমার জন্য যদি সম্ভব হয়, আরও দশজনের জন্য যদি সম্ভব হয়, আপনার জন্যেও সম্ভব, ইনশাআল্লাহ।

আমরা অনেকেই অনেকসময় অজুহাত দেয়ার জন্য জব কিংবা ডিউটির কথা এমনভাবে বলি যেন যারা ডিউটি করেন, তারা ক্ষণিকের জন্যেও ফুরসত পাননা। অথচ আমি হলফ করে বলতে পারি, এমন কোন জব নেই যেখানে দশ পনের মিনিটের ব্রেকও পাওয়া যায়না। কেন, অফিসে কি মানুষ চা-কফি খায়না? কলিগদের সাথে গল্প করেনা? কাজের ফাঁকেফাঁকে দু’চারবার ফেইসবুকে ঢু মারেনা? সরকারি হসপিটালের ইন্টার্নদের মত কামলা খাটার চাকরি কম প্রফেশানেই আছে, ঐ কামলা খাটার মধ্যে যদি আমি নামায পড়া+ IOU দুইটা সেমিস্টারের পড়া পড়ে পাস করে আসতে পেরেছি(আলহামদুলিল্লাহ), আপনি বাংলাদেশের যেকোন প্রান্তে যে জবই করুন, অন্তত নামাজ পড়ার সময়টা বের করতে পারবেন, ইনশাআল্লাহ। আমি একাই পেরেছি তা নয়, আমার দ্বীনি কলিগরাও পেরেছে, এখনো অসংখ্য মানুষ পারছে, আর আল্লাহ যে ইবাদতটা ফরজ করেছেন, সেটা পারার মত যোগ্যতা নিশ্চ্যই তিনি আমাদের ফিতরাতের মধ্যে এনকোড করেই দিয়েছেন, তাই নয়কি?

এখন আসি, ডিউটিতে কীভাবে সালাত পড়েছি? সাধারণ ডিউটিতে তো নামায পড়া কোন ব্যাপারই না। এডমিশান ডিউটিতে প্রেশার বেশি, আযান দিলে তখন অন্য কলিগকে ডিউটিতে রেখে আমরা যারা সালাত পড়ি তারা ডক্টর’স রুমে গিয়ে সালাত পড়েছি। এর মধ্যে কোন কোন ডাক্তার ভাইকে দেখেছি, জামাতে সালাতও মিস যায়নি তাদের, হসপিটালের ভিতরেই তো মাসজিদে জামাত হয়।

আর ওটিতে? গাইনী ওটি শুরু হতো আসরে, শেষ হতো ঈশারও পরে। আসরের সালাত পড়েই অযু নিয়ে বের হতাম। আর ওটিতে দাড়ালেও এমনভাবে হিসেব করে দাড়াতাম যাতে সালাতের ওয়াক্ত পার হয়ে যাবে এমন না হয়। একদম আযানের সময় ওটি শুরু হলে সেটায় না দাঁড়িয়ে নার্স আপাদের রুমে গিয়ে সালাত পড়ে এসে তারপর ওটিতে দাড়িয়েছি। সত্য বলতে, বাংলাদেশে নামাযীর সংখ্যা কম হলেও আপনি নামায পড়তে চাইলে মুখের উপর না করে দেবে, এমন মানুষ নেই বললেই চলে। সার্জারি ওটিতে সালাতের জন্য জায়গা পাইনি, তখন ওটির পাশে ভাঙ্গাড়ি রাখার রুমে একটা জায়নামায ফেলার মত জায়গা ছিলো, ব্যাগে সবসময় একটা জায়নামাজ, একটা তায়াম্মুমের মাটি, একটা কম্পাস রাখি(আমার মনে হয় প্রত্যেকটা কর্মব্যস্ত মুসলমানের ব্যাগেই রাখা উচিৎ), তো ঐ ভাঙ্গারি রুমেই জায়নামাজ বিছিয়ে আমরা দুই ফ্রেন্ড বাই টার্ন নামাজ পড়েছি।

এখন প্রশ্ন আসতে পারে, একটা সেটিং এর সবাই যদি নামাজী হয়, তখন? হ্যা, তখনও মন থেকে চাইলে আল্লাহ ঠিকই ব্যবস্থা করে দেবেন। মেডিসিনে এডমিশান ডিউটির সময় মাঝে মাঝে এমন হতো যে একের পর এক রোগী আসছে,ওদিকে সালাতের সময় হয়ে গেছে, আর আমরা ডিউটি ডক্টর তিনজনই নামাযী। ভাইয়াটা আবার জামাতে নামায পড়েন। তো আযান দিলেই সাথে সাথে উনি নামাযে চলে যেতেন, ঐ সময়টুকু আমরা দুজন রোগী রিসিভ করতাম, উনি সালাত শেষ করে দ্রুত ফিরে আসতেন, তখন উনাকে বসিয়ে আবার আমরা রুমে গিয়ে সালাত পড়তাম।

একবার এমন হয়েছে, ম্যাডাম আমাকে পাঠিয়েছেন পোস্ট অপারেটিভে ফলো আপ দিতে। ১০/১২ জন রোগী, আমি একা ফলো আপ দিবো, ঐসময় আবার মাগরিবের সালাতের ওয়াক্ত চলছে। মহাবিপদ! ইন্টার্ন রুম থেকে পোস্ট অপ অনেক দূর, জোর পায়ে হেটে আসতেও পাচ/সাতমিনিট লাগে, অতগুলো রোগী ফলো আপ দিয়ে রুমে যেতে যেতে আর ওয়াক্ত থাকবেনা। ৪/৫ টা ফলো আপ দিয়ে পোস্ট অপের নার্স আপাদের রিকোয়েস্ট করলাম আমাকে একটু নামাজের জায়গা দিতে, উনারা উনাদের রুম ছেড়ে দিলেন। আমি সালাত পড়ে বাকি ফলো আপগুলো দিয়ে ওয়ার্ডে ফিরলাম। নামাযটা মিস হলোনা, আলহামদুলিল্লাহ।

আল্লাহর রাসূলের সাহাবারা সোনার মানুষ ছিলেন, উনাদের সাথে আমাদের কোন তুলনা চলেনা, কিন্তু উনারাও ‘মানুষ’ই ছিলেন, অতিমানব নন। উনারা সার্জারির ব্যথা ভোলার জন্য সালাতে দাঁড়াতেন, কোন এক সাহাবীর পা কাটতে হবে, তো উনি সালাতে দাড়ালেন, সালাতে উনি এত গভীরভাবে মগ্ন থাকবেন যে পা কাটার ব্যথাও টের পাবেন না; ঘরবাড়িতে আগুন ধরে পুড়ে গেছে, উনারা সালাতে দাঁড়িয়ে আছেন, টেরই পাননি……

সেসব উদাহরণ দিচ্ছিনা, এই আমাদের জন্য ওসব কল্পনা করতেও কষ্ট হবে। আমরা আসলে মানুষ হিসেবে বড় বেশিই দুর্বল। আমরা অসুস্থ হলে বরং সালাত আদায়ে মনোযোগ দিতে পারিনা, অক্ষম হয়ে যাই, এজন্যেই আল্লাহ আমাদের জন্য সহজ করেছেন: অপারগতায় বসে, শুয়ে এমনকি ইশারায়ও সালাত পড়ার অনুমতি রয়েছে, তবু এই ইবাদাত ছেড়ে দেওয়া যাবেনা হুশ থাকা পর্যন্ত। অযুর পানি পাচ্ছেন না, তায়াম্মুম করুন, তায়াম্মুমেরও ব্যবস্থাও নেই, তাহলে ওভাবেই দাঁড়িয়ে যান, আল্লাহ মাফ করে দেবেন, ইনশাআল্লাহ। কিন্তু সালাত ছেড়ে দেয়া যাবেনা…..

প্রেগন্যান্সির শেষদিকে কিছু মেডিকেল ইমার্জেন্সির কারণে বসে সালাত পড়তে হয়েছে, তবু বাদ দিতে হয়নি, আলহামদুলিল্লাহ। লেবার পেইন উঠেছে সকালে, তা নিয়ে যোহরের সালাত পড়েছি, আসরও পড়েছি(শুধু ফরজটা পড়েছি), কিন্তু মাগরিব আর পারিনি, ওটা ছিলো লাস্ট স্টেইজ, ঝড়ের মত একটার পর একটা কন্ট্রাকশন আসছিলো, যে আমি মানুষের সামনে সামান্য চোখের পানি ফেলে কাদতেও লজ্জা পাই, সেই মানুষ সর্বশক্তি দিয়ে চিৎকার করেছি(যদিও ডাক্তার ম্যাডাম বলেছিলেন, উনার জীবনে আমার মত কম চিৎকার করা রোগী নাকি উনি আর পাননি, খুশি হয়ে উনি ডেলিভারির চার্জটাও নেননি)। মাগরিবের তিন রাকাত সালাত পড়তে আমার মিনিমাম ৫-৭ মিনিট লাগে, কিন্তু ঐ সময় প্রতি মিনিটে কিংবা তারও কম সময়ে একবার করে কন্ট্রাকশন হচ্ছিলো, মনের জোর সবটুকু দিয়েও মাগরিবের সালাতটা পড়তে পারিনি, এরই মধ্যে লেবার রুমে নিয়ে গিয়েছে। আল্লাহ মাফ করুন। শুনেছি কোন কোন দ্বীনি বোন এর মধ্যেও সালাত পড়েছেন, জানিনা কীভাবে পড়লেন, আল্লাহ উনাদের উপযুক্ত জাযা দিন। আমার এই এক ওয়াক্ত কাযা গেছে….

এখন বাবু নিয়েও আলহামদুলিল্লাহ পারছি। আগে ফজরে এলার্ম দেয়া লাগতো, এখন দিইনা, বাবুই আমাদের এলার্ম, ঠিক ফজরেই ওর ঘুম ভাঙে। বাচ্চার বাবা মাসজিদে যায়, আমি ওকে রাখি। সে ফিরে এলে তার কোলে দিয়ে আমি নামাযে দাঁড়াই। কোন কোনদিন এমনও হয় যে ঘুম ভেঙেই দেখছি ওয়াক্ত যায় যায়। দুজনেরই সালাত বাকি, ওদিকে বাবুও কাদছে। বাবুকে কোনরকমে একটু খাইয়ে বিছানায় রেখে দুজনে সালাতে দাঁড়িয়ে যাই, বাকিটা আল্লাহই ম্যানেজ করে দেন।

সেদিন আমার রুম্মেট এসেছিলো বাবু নিয়ে বেড়াতে, জিজ্ঞেস করলাম: ভাইয়া তো সবসময় বাসায় থাকেনা, আমার তো পাশেই আম্মুরা আছেন, তুই বাবু কাঁদলে একা একা কিভাবে নামায পড়িস? ও বললো, বাবুকে জায়নামাজের পাশে বেডিং দিয়ে শুইয়ে দিয়ে নামাজে দাঁড়িয়ে যাই, ও আমাকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলে আর কাদেনা। (আমার এই বান্ধবীকে আমি হোস্টেল লাইফ থেকেই নামাযে সচেতন দেখেছি, ইন্টার্নিতেও ও আমার নামাযের পার্টনার ছিলো, নামাযের ব্যাপারে সময়সচেতনতার জন্য সত্যি বলতে আমি ওকে ঈর্ষাই করতাম।)

যাহোক, মোদ্দাকথা হচ্ছে, আপনি যদি সত্যিকার অর্থেই নামায পড়তে চান, তাহলে এমন কোন পরিস্থিতি নেই যেখানে আপনি পারবেন না। আর যেখানে বান্দার প্রচেষ্টার শেষ, সেখানে আল্লাহর সাহায্যের শুরু। আল্লাহ তার বান্দার উপর এমন একটা বিষয় ফরজ করবেন না যেটা তার জন্য অসাধ্য। সূরা তালাকের ২ নং আয়াতটিই সবচে বড় প্রমাণ:

من يتق الله يجعل له مخرجا.
“যে আল্লাহকে ভয় করে, আল্লাহই তার জন্য উপায় করে দেন।”

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *