চোখ বন্ধ করলেই ভেসে ওঠা কিছু পট: ধূ ধূ মরুভূমি…. সাফা মারওয়ার মাঝে দৌড়ে চলেছেন সাহসী মুতাওয়াক্কীলাহ এক নারী, বাচ্চাটির কান্নার সাথেই নেমে আসছে পানির ফোয়ারা….. মাক্বামে ইব্রাহীমে দাঁড়িয়ে আছেন আমাদের পিতা ইব্রাহীম, ইসমাঈল দৌড়ে দৌড়ে পাথর বয়ে আনছেন, ভিত গড়ছেন, বেড়ে চলছে বাইতুল্লাহর উচ্চতা, ঘর্মাক্ত দেহ, অশ্রুসজল নয়ন, রাব্বে করীমের দরবারে দু’টি হাত: রব্বানা ওয়াতাক্বাব্বাল দু’আ….
কিংবা রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের সেই জামানা, একদল আসহাব নিয়ে ছুটে চলেছেন রাব্বের আহবানে সাড়া দিতে, আরাফার ময়দান, হৃদয়স্পর্শী ভাষণ দিয়ে চলেছেন রাসূলুল্লাহ, লাখো শ্রোতার অশ্রুসিক্ত নয়ন, রাসূলুল্লাহর শেষ ফরিয়াদ: আমি কি তোমাদের নিকট আল্লাহর দ্বীন পৌছে দিতে পেরেছি?
লাখো জনতার সরব উত্তর “নিশ্চয়ই”।
তবে তোমরা সাক্ষী থেকো….
اليوم أكملت لكم دينكم واتممت عليكم نعمتي ورضيت لكم الإسلام دينا.
“আজকে আমি তোমাদের দ্বীনকে পরিপূর্ণ করে দিলাম….”
একদম ছোট্টবেলায় আব্বুম্মুর কোলে বসে রূপকথার গল্পের মত এই জীবন্ত গল্পগুলো শুনতে শুনতে বড় হয়েছি, ঘুমিয়ে গিয়ে স্বপ্নের মাঝে নিজেকে আবিস্কার করেছি বাইতুল্লার পাশে দাঁড়িয়ে; কৈশোর আর তারুণ্যে নিজেকে কতবার হারিয়েছি টগবগে গোড়ার উপরে, মরুবিয়াবনে: ‘ইহার চেয়ে হতেম যদি আরব বেদুঈন…. ‘
যৌবনে স্বপ্ন দেখেছি: প্রিয় মানুষটির হাত ধরে সবার আগে বাইতুল্লাহ জিয়ারত করবো। হয়নি, মানুষের সব স্বপ্ন পূরণ হয়না, লৌকিক এই জগতে সবাই একরকম করে ভাবেনা, কিংবা দুরন্ত স্বপ্ন বুকে নিয়েও বাস্তবতার কাছে হার মেনে নেয়, নিতে হয়: আল্লাহর সিদ্ধান্তই যে আমাদের কাছে চূড়ান্ত….
এরপর সব আবেগের পরিশীলিত রূপে মন থেকে করা দু’আ: ও বাইতুল্লাহর মালিক, আপনি আমাদেরকে আপনার ঘর না দেখিয়ে মৃত্যু দিয়েন না। আমাদের সামর্থ্য সামান্য, স্বপ্নের পরিধি বিস্তৃত, এই সামান্যটুকু নিয়েই আমরা শুরু করেছি, কবুল করার মালিক আপনি। পৃথিবীর ভূস্বর্গ দেখার স্বপ্ন নেই, চোখ ধাঁধানো আলোর আধুনিকতম নগরী ভ্রমণের স্বপ্ন নেই, কেবল আপনার ঘর দেখতে চাই, সেই মরুর দেশ, যেখানের প্রতিবিন্দু বালুকণা আজও বয়ে বেড়ায় আমার রাসূলুল্লাহর ত্যাগ, আসহাবে রাসূলের ত্যাগ আর কুরবানীর ইতিহাস….একটি বিজয়ের ইতিহাস, মানবতার মুক্তির ইতিহাস, সান’আ থেকে হাদরামাউত পর্যন্ত নিশ্চিদ্র নিরাপত্তা আর আমানতদারিতার ইতিহাস….
‘বাইতুল্লাহ’ আমাদের ভালোবাসার জায়গা, এই ভালোবাসা নিয়ে কারও কটূক্তি আমরা সহ্য করতে পারিনা। জাতি হিসেবে আমরা মুসলমানেরা হয়তো আমাদের আদর্শ সেইভাবে ধরে রাখতে পারিনি, কিন্তু মুসলিম মানেই আমাদের মত নামকাওয়াস্তে মুসলিম কেবল নয়, মুসলিম মানে ‘মিল্লাতে ইব্রাহীম’: আদর্শের ধারক, আদর্শের বাহক, পৃথিবীর বুকে আদর্শের দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী একটি জাতি: মুসলিমকে গাল দেওয়া হলে তাই আমাদের হৃদয়ে টান লাগে, সেই টান মুহাম্মাদ, ইব্রাহীম, ইসমাঈল ছাড়িয়ে আদম পর্যন্ত চলে যায়….
আমাদের সীমাবদ্ধতাগুলো ক্ষমা করুন, ও বাইতুল্লাহর মালিক। বাইতুল্লাহর মুসাফিরদের আপনি কবুল করে নিন, আমাদেরকেও বাইতুল্লার মুসাফির না বানিয়ে মৃত্যু দিয়েন না, সারা জাহানের লাখো কোটি বনী আদমের সাথে সুর মিলিয়ে একবার ‘লাব্বাইকাল্লাহ’ ধ্বনি তোলার সুযোগ দিন।
আমরা হাজির, ও আল্লাহ, আমরা হাজির: মনে ও মননে, হৃদয়ের সবটুকু আবেগ নিয়ে দাঁড়িয়ে, হাজার হাজার মাইল দূরে…. ক্ষমাপ্রাপ্তদের তালিকা থেকে আমাদেরকে বঞ্চিত করিয়েন না….