স্বপ্নের শুরুটা অনেক আগে, কতটা আগে তা কীভাবে হিসেব করে বলি? যখন থেকে মানব-মানবী মনের গভীরে একজন জীবনসঙ্গীর স্বপ্ন বুনতে শুরু করে, তখন থেকেই। মনে মনে তখন থেকেই ভাবতাম, বিয়ের আগে বাইতুল্লাহ দেখার সুযোগ হবে কিনা জানা নেই, মধ্যবিত্তের সন্তান হয়ে অত বড় স্বপ্ন দেখা কঠিন। তবে বিয়ের পর ইনশাআল্লাহ হাজব্যান্ডের সাথে প্রথম সফরই হবে বাইতুল্লাহ সফর। রাসূলের রওজা স্বপ্নে দেখেছি তারও আগে, অনেক ছোটবেলায়, আব্বুর কাছে রাসূলের গল্প শুনে শুনে যখন নবীপ্রেমে উদ্ভাসিত হতো ভাইবোনের শিশুমন…
Man proposes but God disposes. মানুষ পরিকল্পনা করে, আর আল্লাহও করেন। আর আল্লাহর পরিকল্পনাই তার বান্দাহর জন্য সর্বোত্তম। বাইতুল্লাহ সফরের স্বপ্ন-কল্পনা বহু আগে থেকে হলেও জীবনের স্বপ্ন-কল্পনা নিয়ে কখনোই পরিস্থিতির উপর খুব বেশি জোর করিনি। কারণ আমরা যাতে কল্যাণ ভাবি, সবসময় তাতেই কল্যাণ থাকেনা, যদি না আল্লাহর সিদ্ধান্তও একই হয়। বিয়ের উদ্দেশ্যটাও যেহেতু আল্লাহর সন্তুষ্টিই ছিলো, তাই মনের গভীরে লুকানো স্বপ্ন ছিলো বিয়ের পর প্রথম সফর যদি বাইতুল্লাহ সফর হতো!
হবু স্বামী নতুন চাকরিতে জয়েন করেছে, আমার স্বপ্ন হলেও তার সাধ্যের বাইরে, তার উপর চাপিয়ে দেয়া সঙ্গত হবেনা। তাই স্বপ্নটা সম্ভবত সেই মুহুর্তে কাউকে জানানো হয়নি। একই সাথে এটাও জানতে পারলাম যে বিয়ের পর শ্বশুরবাড়ির এক নিকটাত্মীয় বিয়ের গিফট হিসেবে কক্সবাজারের বিমান টিকিট+ হোটেল বুকিং দিয়েও রেখেছেন। বিয়ের পর প্রথম সফর চেয়েছিলাম বাইতুল্লাহ, কিন্তু আল্লাহ হয়তো ভিন্নটাই চাইলেন। আলহামদুলিল্লাহ আলা কুল্লি হাল। তিনি উত্তম সময়েই তার ঘর দেখাবেন।
বিয়ের পর পর হজ্জ একাউন্ট খুলে প্রতি মাসে একটা নির্দিষ্ট এমাউন্ট জমাতে থাকি। আবু ফাতিমাহ জব থেকে স্যালারি পায়, পাশাপাশি আমারও কিছুদিন পর ইন্টার্নি শুরু হলো, সেখান থেকে আমিও সামান্য স্যালারি পাই, আলহামদুলিল্লাহ। দুজনের টাকা থেকে বাচিয়ে প্রতিমাসে হজ্জ একাউন্টে রাখতে শুরু করি। একটু একটু করে টাকা বাড়তে থাকে, একটু একটু করে গড়ে উঠতে থাকে স্বপ্নের পথটাও। নিজেদের টাকা একটু একটু করে সঞ্চয় করে বাইতুল্লাহ সফর, এই প্রশান্তিটা বোধহয় অন্যরকম।
এরইমধ্যে বাইতুল্লাহর ডাক পেয়ে যাই। আব্বু রিটায়ার্ড করার পর একটা এজেন্সি থেকে খেদমতের সুযোগ পেয়ে এজেন্সির সাথে কিছুদিনের জন্য যুক্ত হয়। আল্লাহর রহমতে সেবার আব্বু আম্মু ভাইয়া সবাই একসাথে হজ্জে গিয়েছিলো। আমার আবাল্য স্বপ্নের কথা আব্বা আম্মা জানতেন, তারা খুব করে চাচ্ছিলেন আমাকেও হজ্জে নিয়ে যেতে। সেসময় হজ্জের খরচ এম্নিতেই কম ছিলো, আব্বু এজেন্সিতে যুক্ত থাকায় আমাকে আরও কমে নেয়ার সুযোগ ছিলো। ওদিকে আমিতো এই স্বপ্নের যাত্রায় আরেকজনকে মনসঙ্গী করে নিয়েছি, কিন্তু ঐ মুহুর্তে হজ্জ সফরের মত সামর্থ্য তার ছিলোনা। আমি জোর করলে সে নিষেধ করতোনা, সে আমাকে অনুমতি দিয়েও দিয়েছিলো, কিন্তু আমারই মন সায় দিলোনা এত বড় স্বপ্নের সফরটা তাকে ছাড়াই করে আসার….
এর কিছুদিন পর শাশুড়ী-মা উমরায় যাবেন, কিন্তু উনি অসুস্থতার কারণে ভালোভাবে হাটতেও পারেন না। হুইল চেয়ারেই উমরা করাতে হবে, হুইল চেয়ার ঠেলার জন্যেও একজন শক্তিমান মানুষ দরকার। আবু ফাতিমা দায়িত্ব নিলো। আলহামদুলিল্লাহ, বাবা-মায়ের সাথে তার উমরা সফরের সুযোগ হয়ে গেলো, সেই সাথে মায়ের খেদমতের সুযোগ। সেই মুহুর্তে আমাকে ছেড়ে যেতে তার মনও সায় দিচ্ছিলো না, কষ্ট আমিও পাচ্ছিলাম, তবু আমিই উৎসাহ দিলাম- মায়ের সেবার এমন সুযোগ আর নাও পেতে পারে। আল্লাহ বাচিয়ে রাখলে আল্লাহ আমাদের একসাথে আবারও বাইতুল্লাহ সফরের সুযোগ করে দেবেন, ইনশাআল্লাহ। সেবারের তার সেই সফর ব্যর্থ হয়নি, আলহামদুলিল্লাহ। মাকে দেখেছি, যতবার সেই উমরার স্মৃতিচারণ করেন, ছেলে যে তাকে হুইল চেয়ার ঠেলে তাওয়াফ, সা’ঈ করিয়েছে, এই কষ্টের বিনিময়ে প্রতিবার তিনি চোখের পানি ফেলে ছেলের জন্য জান্নাতের দুয়া করেন। সন্তানের জন্য, সন্তানের পরিবারের জন্য মায়ের এমন দুয়ার চেয়ে বেশি আর কিছু চাওয়ার থাকেনা। আমার বাইতুল্লাহ যেতে না পারার কষ্ট ঘুচে যায়, আলহামদুলিল্লাহ।