স্বপ্ন না সন্তান: ভাবনার দোলাচালে

হজ্জের খরচ তখনও আকাশচুম্বী হয়নি। আমার নামে খোলা হজ্জ একাউন্টের ইন্সটলমেন্ট লিমিট শেষ। আবু ফাতিমার নামে আরেকটা একাউন্ট খোলা হলো। ততদিনে আমি ইন্টার্নি শেষ করে ঢাকায় ফিরে ফাতিমাকে নিয়ে পুরোদস্তুর ঘরকন্যা (অথবা মানবশিল্পী), একাউন্টে শুধু ফাতিমার বাবার স্যালারি থেকেই রাখা হয়। আল্লাহ তা’আলা ফাতিমার বরকতে তার স্যালারিও বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। ২০১৯। আল্লাহর নামে হজ্জের প্রি-রেজিস্ট্রেশান করে ফেলা হলো। যতদিনে সিরিয়াল আসবে, ততদিনে টাকা জমা হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ।

বাধ সাধলো কোভিড-১৯। গোটা দুনিয়া ওলটপালটের সাথে সাথে বদলে গেলো হজ্জ নির্দেশনাও। এত ফাকা কাবাচত্ত্বর মনে হয় ইতিহাসে কেউ দেখেনি। আমাদের সিরিয়াল গড়াতে গড়াতে চলে গেলো বহুদূর। ফাতিমার বয়স একদম উপযুক্ত, ওকে নানাবাড়ি রেখে খুব স্বস্তিতেই হজ্জ করা যাবে ইনশাআল্লাহ। কিন্তু আল্লাহ না চাইলে কি হয়? করোনায় তো সবকিছু জ্যামে আটকে গেলো। মনের ভেতর শুধু এই ভয়টাই কাজ করতো- করোনায় যদি মউত লেখা থাকে, তাহলে তো আর বাইতুল্লাহ দেখা হলোনা! আল্লাহর সিদ্ধান্ত কি তবে এমনটাই?

‘ইয়া রব্ব! বাইতুল্লাহ না দেখিয়ে মৃত্যু দিয়েন না! আর যদি তার আগেই নিয়ে যান, তবে মৃত্যুর পর সরাসরি আপনাকে দেখার সুযোগ দিয়েন।’

২০২০, ২১ গড়িয়ে ২২। এবার একটা আশু সম্ভাবনা সিরিয়ালে আমাদের নাম আসার। এজেন্সি থেকে জানিয়েছে- সম্ভাবনা ৫০-৫০: আসতেও পারে, নাও পারে। এদিকে ফাতিমা বড় হয়েছে, পরিবারের সবাই ফাতিমার আরেকজন অনুজের স্বপ্ন দেখা শুরু করে দিয়েছে। স্বপ্ন দেখাটাও বাস্তব, সব কিছুরই একটা বয়সসীমা আছে। মুরুব্বিদের সব চাওয়া ভুল না, অভিজ্ঞতার মূল্য অনেক, যদিও আমাদের জেনারেশন এসব বিষয়ে মুরুব্বিদের ভদ্রোচিত পরামর্শকেও একেবারে অসহনীয়তার পর্যায়ে নিয়ে গেছে। যাহোক, এখন সন্তান আর হজ্জ এখন দুটো বিপরীতমুখী অবস্থানে দাঁড়িয়ে গেলো। বান্দাহর স্বপ্ন তো নানামুখী, কেবল রবই জানেন কোনটা অধিক কল্যাণকর….

এক রাতে হঠাৎ স্বপ্ন দেখি, আমরা হজ্জের সফরের উদ্দেশ্যে গাড়িতে উঠছি। হজ্জ নিয়ে আমার অনেক পড়াশোনার প্ল্যান ছিলো, কিছুই পড়ার সুযোগ হয়নি। গাড়িতে বসে দ্রুত বইয়ের পাতা ওল্টাচ্ছি, হজ্জ্বের নিয়মকানুন পড়ছি….

অন্যরকম এক মুগ্ধতায় ঘুম ভেঙে গেলো। এমন একটা দ্বিধাদ্বন্দ্বের মুহুর্তে এমন একটা দিকনির্দেশনামূলক স্বপ্ন, ভাবলাম হয়তো আল্লাহ বাইতুল্লাহ সফরটাই চাচ্ছেন। সেইদিনই আবু ফাতিমার সাথে পরামর্শ করলাম, সে এজেন্সিতে ফোন দিয়ে জানিয়ে রাখলো, আমাদের নাম যদি নাও আসে, অনিচ্ছুক কোন হজ্জযাত্রীর জায়গায় হলেও যেন আমাদের সুযোগ দেন।

স্বপ্ন নিয়ে আবারও স্বপ্ন দেখা: এবার আমি ঘুরে বেড়াচ্ছি সরাসরি হারামের ভেতর। সালাত পড়ছি। কথা বলছি অন্য মুসাফিরদের সাথেও। আলহামদুলিল্লাহ, এত সুন্দর স্বপ্নের আমি যোগ্য নই, ইয়া রাব্ব! যাক, তাহলে হজ্জেই যাচ্ছি, ইনশাআল্লাহ।

মানুষের স্বপ্ন, আল্লাহর পরিকল্পনা। আবারও আল্লাহর পরিকল্পনার কাছেই সমর্পণ করলাম। হজ্জের সিদ্ধান্ত নেয়ার এক সপ্তাহের মাথায়ই পরিবারে নতুন সদস্যের আগমনী বার্তা টের পেলাম। সেই অসুস্থতার সব সিম্পটম, যা ফাতিমার সময় টের পেয়েছিলাম। হ্যা, সত্যিই সে আসছে, আলহামদুলিল্লাহ! এই তাহলে রবের সিদ্ধান্ত! তাহলে আমি ওর অস্তিত্ব ভেতরে নিয়েই কেন দুই দুইবার বাইতুল্লাহ সফরের স্বপ্ন দেখলাম? আল্লাহ আসলে কোনটা চান?

رب إني لما أنزلت إلي من خير فقير.

❝হে রব্ব! আপনি আমাকে যে কল্যাণ দেবেন, আমি তারই মুখাপেক্ষী।❞

আলহামদুলিল্লাহ, আল্লাহ ইব্রাহীমকেই চেয়েছেন। অনস্তিত্ব থেকে একটু একটু করে অস্তিত্বে আসছে আমার কল্পিত ইব্রাহীম আব্দুল্লাহ। মাঝে মাঝে মনের গহীনে ভয় হতো, আচ্ছা, এমনকি হতে পারে যে কোন কারণে আল্লাহ আমার বাচ্চাটাকে নিয়ে নেবেন, আর শেষ দিকে তাড়াহুড়ো করে অপ্রস্তুত অবস্থায় হজ্জের সফরে যাবো? না না, এমনটা তো চাইনা! আল্লাহ মাফ করেন। এ আমার ভুল কল্পনা, এই কষ্টের পরীক্ষায় আমাদের ফেলিয়েন না রব্ব! স্বপ্ন তো দলীল না, গুনাহগারের স্বপ্ন আরও না! কাউকে বলিনি, আজ সময় অতিক্রান্ত হওয়ার পর বললাম। মায়ের মন, কত যে কু-ডাক ডাকে!

২৮ শে জুন, ইব্রাহীম যেদিন পৃথিবীতে এলো, ঠিক সেই মুহুর্তে মক্কা-মদীনায় হজ্জ চলছে। আহা! আমি ভেবেছিলাম বাইতুল্লাহ, আর আল্লাহ চেয়েছিলেন সন্তান! হ্যা, বাইতুল্লাহর স্থপতির নামেই ওর নাম, ইব্রাহীম, মুসলিম জাতির পিতা, বাইতুল্লাহর গাথুনিও যার হাতে। আয় আল্লাহ! আমার সন্তানটিকে আপনি ইব্রাহীম নবীর সিফাত দান করেন, জান্নাতে তার প্রতিবেশী হওয়ার তাউফীক দিয়েন।

আল্লাহর সিদ্ধান্ত আবারও সর্বোত্তম প্রমাণিত হলো। কীভাবে? ইব্রাহীমের আগমনী বার্তা পাওয়ার পর পরই তো আমরা ২২ এ হজ্জের পরিকল্পনা বাদ দিয়ে দিলাম। আল্লাহর দেয়া আমানত ও নেয়ামত সন্তান, দায়িত্ব আগে, স্বপ্ন পরে। আলহামদুলিল্লাহ সুম্মা আলহামদুলিল্লাহ, বছরান্তে দেখা গেলো, হজ্জের সিরিয়ালে আমাদের কারও নামই আসেনি। মাঝখান দিয়ে আমাদের ঘর জুড়ে এক অতিথি পাঠিয়ে দিলেন আল্লাহ!

আপনার সিদ্ধান্তের চেয়ে উত্তম আর কিছুই হয়না, ইয়া রব্ব! এমন কল্যাণই আমরা চেয়েছিলাম, আপনি তারচেয়েও উত্তম কিছু দিয়েছেন। প্রশংসা কেবলই আপনার। ফাসুবহানাল্লাহি ওয়াবিহামদিহ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *