স্বপ্নে দেখেছিলাম, একদম অপ্রস্তুত অবস্থায় বাহনে উঠে যাচ্ছি, কিচ্ছু পড়া হয়নি। আজ সেই কাঙ্ক্ষিত দিন, তবে আলহামদুলিল্লাহ, আল্লাহ স্বপ্নের মাধ্যমে ঐ ধাক্কাটা দেয়ায় মোটামুটি প্রস্তুতি নিতে পেরেছি।
শেষ ৪-৫ টা দিন কি যে দৌড়ের উপর গেছে! একদিকে সফরের কেনাকাটা, আত্মীয় ও কাছের কিছু মানুষের সাথে দেখা করা, ফোনে বিদায় নেয়া ও দোয়া চাওয়া, বাচ্চাদের এক মাসের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনে দিয়ে যাওয়া, বাচ্চাদের দেখভালের জন্য আব্বু আম্মুর সাথে একজন খাদেমা খুজে দেয়ার চেষ্টা, আরেকদিকে সফরের কিতাবাদি পড়ে শেষ করা। এরই মাঝে মায়ের মন, বার বার শুধু মনে হয়- এই ২০ দিনে বাচ্চাদের কোন বিপদাপদ হবে না তো? আমাদের কোন বিপদ হবে না তো? বাচ্চা দুটোর সাথে আবার মিলিত হতে পারবো তো? আব্বু আম্মু, বাবা-মায়ের কাছে কিছু অসীয়ত করে গেলাম, এটা সফরের সুন্নাত। একদিকে বাচ্চাদের সাহস দিই, আরেকদিকে মুনাজাতে ওদের নিরাপত্তার জন্য আল্লাহর কাছে সাহায্য চেয়ে কাদি। নানা-নানুর কাছে রেখে যাচ্ছি, উনাদের চেয়ে উত্তম অভিভাবক আর কে-ই বা হতে পারেন? দাদা-দাদীও অন্য শহরে আছেন, তারাও খোজ খবর নিচ্ছেন। আর যে আল্লাহর রাস্তায় বের হচ্ছি, যে আল্লাহর হাওলায় বাচ্চাদের রেখে যাচ্ছি, তার চেয়ে বড় জামিনদার আর কে আছেন?
ভোর ৫ টার দিকে বের হতে হবে। আগে আগে উঠে বিছানায় বাচ্চা দুটোকে জড়িয়ে ধরে শেষবারের মত অনেকক্ষণ নিঃশব্দে কাদলাম আর আল্লাহর কাছে দুয়া করলাম- আব্বু আম্মু আর সন্তানদের হিফাজতের, আমাদের হিফাজত ও কবুলিয়াতের। বড়টার বয়স সাড়ে চার পার হয়েছে, ছোটটার ১ হয়নি। এই পাচ বছরে ওদের কাউকে রেখে একটা দিন বা একটা রাতও কোথাও থাকা হয়নি, এই প্রথম ওদের রেখে লম্বা কোন সফরের উদ্দেশ্যে বের হওয়া….
বিকেল ৫ টায় ফ্লাইট, বের হচ্ছি ভোর ৫ টায় ফজর পড়েই, ১২ ঘণ্টা আগে বের হতে হয়- বিমানবন্দরে ইমিগ্রেশান সংক্রান্ত নানা ধরণের প্রোসিডিউরে এই সময় লেগেই যায়। এত ভোরে উবার ডাকা কঠিন, এলাকায় পরিচিত এক দ্বীনি ভাইয়ের সি এন জি আছে, আগের রাতেই উনাকে জানানো হয়েছিলো, যথাসময়ে উনার বাহনে চড়েই বের হয়ে গেলাম। ফাতিমা সেই কাকভোরেই উঠে গেছে বিদায় জানাতে, ব্যাগ গুছিয়ে দিচ্ছে, মাঝে মাঝে জড়িয়ে ধরে কাদছে। ছোট বাবুটা ঘুমিয়ে ছিলো, বের হওয়ার সময় সেও উঠে গেলো। বাচ্চার সাথে মায়ের এক অদ্ভূত এলার্ম সেট করা থাকে, মা বিছানা ছাড়লেই কিভাবে যেন বাচ্চার ঘুমটাও ভেঙে যায়। নাহ, আর আবগী হওয়া যাবেনা, আম্মু আব্বু আর দুটো বাচ্চাকে বিদায় জানিয়ে বের হয়ে গেলাম- মা আর মেয়ের চোখে পানি, তবে ছোটটার চাহনি ছিলো নির্বিকার- মা বাবা কোথায় যাচ্ছে, কেন যাচ্ছে কিচ্ছুটি বোঝার বয়স তার হয়নি।
অবশেষে বের হয়েই গেলাম- আমার কলিজার টুকরা ইব্রাহীমকে ছেড়ে ইব্রাহীম আলাইহিস সালামের ভূমির উদ্দেশ্যে, আমার জানের টুকরা ফাতিমাকে ছেড়ে ফাতিমা রাদিয়াল্লাহু আনহার শহরের উদ্দেশ্যে….
সি এন জি থেকে নামার সময় ড্রাইভার ভাই দুয়া চাইলেন, উনার মনের অবস্থাটা চিন্তা করে একটু কষ্ট হচ্ছিলো- বাইতুল্লাহ তো সবারই স্বপ্নের জায়গা, আল্লাহ আমাদের জন্য সহজ করেছেন, অথচ এই ভাইয়ের মত কত মানুষ হয়তো শুধু কল্পনাতেই চোখের জল ফেলছেন!
‘আল্লাহ, আপনি উনাদেরকেও বাইতুল্লাহর মুসাফির হওয়ার সুযোগ দিয়েন একটাবার!’