মদীনায় মসজিদে নববীর অদূরেই হোটেল ‘যাহরাতুল মুনাওওয়ারাহ’ তে আমাদের অবস্থান। এই হোটেলে দুই জাতির মুসাফির, বাঙালি আর আফ্রিকান। ঢুকতে, বের হতে, চা খেতে খেতে প্রতিবারই আফ্রিকান হাজী ভাইবোনদের দেখা যায়। হারামাইনে নামাযের সময় কিংবা তাওয়াফ, সাঈর সময়ও এদের অস্তিত্বেই সবচে বেশি দেখা যায়।
বাঙালি হাজীদের অনেকের মধ্যেই একটা নাক ঊচা ভাব আছে- আফ্রিকানদের নিয়ে আলোচনা আসলেই ‘নিগ্রো’ শব্দটা এমনভাবে ব্যবহার করে যেন এটা একটা গালি। হ্যা, এটা সত্য যে তাওয়াফ বা সাঈর সময় এদের ভয়ে মোটামুটি অন্য সব হাজীই কম বেশি ভীত থাকে, আকার-আকৃতি-পোশাকে অতিকায় হওয়ায় হয়তো স্বভাব-চলন-বলনেও তার কিছু প্রভাব পড়েছে। তবে তা কি সবার মধ্যেই? নিশ্চয়ই না। আচ্ছা, বহির্বিশ্বের অধিকাংশ দেশে তো বাঙালিদেরও ছোট জাত/চোরের জাত হিসেবে দেখা হয়। তো আমরা কি সবাই চোর? তা যদি না-ই হয়, তবে আফ্রিকানদের সবাইকে গণহারে এমন নেগেটিভ ভাবা গুনাহের শামিল নয় কি?
আমারতো উলটো ওদের দেখলে অন্যরকম শ্রদ্ধার অনুভূতি হয়- এরকম উশৃংখল একটা জাতিকেও আল্লাহ তা’আলা হিদায়াতের নূর দিয়ে শৃঙ্খলিত ও পরিশীলিত করেছেন! যেখানে চকচকে সাদা চামড়ার তথাকথিত ভদ্র-সভ্য জাতিরাও এই হেদায়াতের নূর পায়নি। “হেদায়েতের নূর আল্লাহর যাকে ইচ্ছা তাকেই দেন”, মানুষের মধ্য থেকে তার পছন্দের মানুষদেরই দেন। যাকে আল্লাহ ভালোবেসে হেদায়াত দিয়েছেন, তাকে আমি আপনি অপছন্দ করতে পারিনা, করলেও তাদের কিছু এসে যায়না।
খুব বেশি যুগ আগের কথাও না, কৃষ্ণাঙ্গদের একসময় মানুষই মনে করা হতোনা, শুধু সাদা চামড়ারাই মানুষ। আর অ-সাদাদের বেচে থাকারও অধিকার নেই, তাই তাদের মেরে ফেলা জায়েয তো বটেই, বরং এটাই নাকি প্রকৃতির নিয়ম! বহু রক্ত ও সংগ্রামের যুদ্ধ পেরিয়ে তাদেরকে শুধু ‘মানুষ’ নামের অধিকার আদায় করতে হয়েছে। অথচ ইসলামে এই শ্বেত-কৃষ্ণের ভেদ নেই; মানুষে মানুষে সম্মানের তারতম্য তার ঈমানে, আখলাক্বে, তাক্বওয়ায়— রাসূল সা. দৃঢ়তার সাথে সর্বপ্রথম এই ঘোষণা দিয়েছেন।
মুখে মুখে এন্টি-রেসিজমের ফেনা তুললেও ভেতরে ভেতরে কৃষ্ণাঙ্গদের দেখলেই যদি এক প্রকারের বিরক্তির উদ্রেক হয়, তাহলে আসলে আমরা রেসিজমের ঊর্ধ্বে উঠতে পারিনি তো বটেই, ইসলামের সুমহান শিক্ষাও অন্তরে ধারণ করতে পারিনি।
এ তো গেল তাত্ত্বিক আলাপ, আফ্রিকানদের আরও একটা সুন্দর পরিচয় আছে। ভেবে দেখুন তো, তারা কি আল্লাহর রাসূলের প্রিয় সাহাবী বিলাল রাদিয়াল্লাহু আনহুর বংশধর নয়! কে সেই বিলাল? পরিচয় করিয়ে দিতে হবে? আল্লাহর রাসূল সা. জান্নাতে যার পদশব্দ নিজের আগে শুনতে পেয়েছিলেন, কি সম্মান, ভাবা যায়? মরুর তপ্ত রোদে শুইয়ে তাকে পাথর চাপা দেয়া হয়েছিলো শুধু ইসলামের জন্যই, এমন রোদ যেখানে আমরা এই যুগে এসেও মুহুর্তের জন্য পা রাখতে পারিনা! সেই তপ্ত রোদে পুড়ে যাওয়া মানুষটির মুখ দিয়ে উচ্চারিত হয়নি কোন অভিযোগ, কিংবা সামান্য অস্বস্তির সুর, নির্ভীক কণ্ঠে উচ্চারণ করে চলেছেন- আহাদ, আহাদ!
ঈমানের তেজ! মরুভূমির তপ্ত রোদ না বিলালের ঈমান, কোনটার তেজ অধিক? কেউ মাপতে পেরেছে কি কোন কালে!
আজকের কৃষ্ণকায় আফ্রো মুসলিমদের দেখে নিচু মনে হলে বিলাল রাদিআল্লাহু আনহুর কথা ভাবুন। নিজের সাদা চামড়া নিয়ে নিজেই লজ্জিত হবেন। হয়তো ওদের অনেকের স্বভাব-আচরণে কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত কদর্য টের পাওয়া যায়, তবে আমাদের অগোচরেই ওদের মাঝেও এমন অসংখ্য মুসলিম রয়েছে, যাদের ঈমান-আমল আমাদের থেকে লক্ষ গুণ বেশি। ডক্টর বিলাল ফিলিপস এর নাম শুনেছেন নিশ্চয়ই, খ্রিস্টান থেকে মুসলিম হওয়ার পর উনার হাত ধরে মুসলিম হয়েছে শত শত মানুষ। ৩০ বছরেরও বেশি সময় ধরে ইসলামী শিক্ষার প্রচার-প্রসারে তিনি বিশ্বব্যাপী ছুটে বেড়াচ্ছেন। রিয়াদ, ফিলিপাইন, দুবাই, শারজাহ, কাতার ও গাম্বিয়ায় দীর্ঘসময় একাডেমিকভাবে ইসলাম শিক্ষাদানে নিয়োজিত থেকেছেন। ২০০৭ সালে তিনি ইসলামিক অনলাইন ইউনিভার্সিটি (IOU) প্রতিষ্ঠা করেন যেখানে বর্তমানে ২০৭ টিরও বেশি দেশ থেকে ১ লাখের ওপর রেজিস্টার্ড শিক্ষার্থী পড়াশুনা করছে। ইসলামী দাওয়াতের কাজে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ সম্প্রতি “৫০০ প্রভাবশালী মুসলিম” এর তালিকায় তিনি স্থান পেয়েছেন। সাম্প্রতিককালে আফ্রিকার ১ মিলিয়ন শিক্ষাবঞ্চিত দরিদ্র মানুষকে তিনি শিক্ষার আলোয় আলোকিত করার টার্গেট নিয়েছেন। হাফিজাহুল্লাহ।
এইতো হজ্জ ২০২৩ এরই ঘটনা, সাবেক খ্রিস্টান পাদ্রী ইব্রাহীম রিচমণ্ডের গল্প কারও অজানা নয়। তিনিও কালোবর্ণের। পরপর তিন বার স্বপ্নে সাদা পোশাক পরার আদেশ পেয়ে অবশেষে ইসলাম গ্রহণ করলেন তার সমস্ত অনুসারীদের নিয়ে। এরপর সৌদি সরকারের আমন্ত্রণে হজ্জ করলেন। নও মুসলিম, বয়সও কম না, তারপরও পায়ে হেটে উঠে গেছেন জাবালে নূরের হেরা গুহা! উনার চোখ মুখে ঈমানের নূর দেখেছেন? উনাকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিলো- এত উচু পাহাড়ে উঠতে আপনার কষ্ট হয়নি? উনি উত্তরে জানিয়েছিলেন-
❝When you have that heart, nothing is hard. In the name of Allaah nothing is hard, He’ll make it easy.❞
(বিস্তারিত: https://youtu.be/d1g4dyfyoRA)
আল্লাহু আকবার! সাহাবী বিলাল থেকে আজকের রিচমন্ড… ঈমানের শক্তিতে একই রকম বলীয়ান! গায়ের রঙ তো কালোই? আমার আপনার সাদা চামড়ার ভেতরের ক্বলবে আছে এতটুকু প্রাণশক্তি?
হোটেলের লিফটে উঠতে নামতে যতবার আফ্রিকান ভাইবোনদের দেখি, আমার সত্যিই এই চিন্তাগুলো মনের ভেতর উকি দেয়। অপর মুসলিম ভাই বোনকে নিয়ে আমাদের ভাবনাগুলো ভালো হওয়া উচিৎ। হয়তো তাদের কিছু কদর্য দেখেই আমরা বাকিটাও কুৎসিত ভেবে নিই, অথচ কতজনের ভেতরের ঈমান ও সৌন্দর্য আমরা খুজে দেখার চেষ্টা করেছি??