আমি নিজেকে কেমন প্যারেন্ট হিসেবে দেখতে চাই? অথবা প্যারেন্ট হিসেবে আমার কতটা কঠোর ও কতটা কোমল হওয়া উচিৎ, এ নিয়ে অনেকেই কিনফিউজড থাকেন। এই বিষয়টি নিয়েই আমাদের আজকের আলোচনা।
আমার জীবনে দেখেছি, যেসব সন্তানেরা ছোটবেলা থেকে কড়া শাসনে অতিষ্ঠ হয়ে বাবা-মায়ের উপর এক প্রকার ক্ষোভ নিয়ে বড় হয়েছে, এরাই জীবনের এক পর্যায়ে পড়াশোনা কিংবা পদবীর দিক দিয়ে ‘সফলতা’ অর্জনের পর বাবা-মায়ের সেই অতিশাসনকে বাহবা জানাতে শুরু করে। “আমাদের বাবা-মায়েরা তো মাইরের উপর ওষুধ নাই’ স্টাইলে আমাদের মানুষ করেছে, কই আমরা কি মানুষ হইনি? যারা সন্তানকে অতি আদরে মাথায় তোলে, এরাই বেয়াড়া হয়, মানুষ হয়না।” এই জাতীয় মনোভাব পোষণ করে থাকে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, অতি আদরে যেমন সন্তান বখে যায়, অতি শাসনেও সন্তানের স্বাভাবিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়, আমাদের প্যারেন্টিং স্টাইল হওয়া উচিৎ আদর ও শাসনের ভারসাম্য, অর্থাৎ ভারসাম্যপূর্ন আদর ও ভারসাম্যপূর্ণ শাসন।
এই উপলব্ধিটুকু আমার নিজের হলেও এই কথাগুলো আমার নয়, সাইকোলজিস্টরা বছরের পর বছর চিন্তা ও গবেষণা করেই এগুলো বের করেছেন। ১৯৬০ এর দিকে Diana Baumrind নামে একজন ক্লিনিক্যাল ও ডেভেলপমেন্টাল সাইকোলজিস্ট প্যারেন্টিং স্টাইলকে ৪ টি ভাগে চিহ্নিত করেন। এই ৪ টি প্রকার নিয়ে একটু আলোচনা করি, তাহলে বুঝতে ও তুলনা করতে সুবিধা হবে।
প্যারেন্টিং স্টাইলের রকমফের:
১) Authoritarian প্যারেন্টিং
২) Authoritative প্যারেন্টিং
৩) Permissive প্যারেন্টিং
৪) Un-involved/ Negligent প্যারেন্টিং

এই প্যারেন্টিং স্টাইলগুলো মূলত দুইটি বিষয়ের উপর ভিত্তি করে আলোচিত হয়- Demandingness (বাবা মা সন্তানের কাছ থেকে কতটুকু বা কী কী আচরণ প্রত্যাশা করেন) ও Responsiveness (বাবা মা সন্তানের আচরণ বা বিকাশের প্রতি কতটুকু সংবেদনশীল)।
১) Authoritarian Parenting
(High demandingness, Low responsiveness)
এই ধরণের বাবা মায়ের সন্তানের কাছে চাহিদা অনেক কিন্তু তারা সন্তানের প্রতি কম সংবেদনশীল। এরা স্বৈরাচারী মনোভাব সম্পন্ন, তাই এই প্যারেন্টিং স্টাইলকে Autocratic বা Dictatorship ও বলা হয়। তারা কোন কাজ মানা করেছেন, ব্যস, মানা। করা যাবেনা তো যাবেই না। কেন যাবেনা, কী ক্ষতিকর প্রভাব পড়তে পারে এসব ব্যাখ্যা সন্তানের কাছে দেবার প্রয়োজন মনে করেন না। ম্যানেজমেন্টের পরিভাষায় এটি হচ্ছে ‘Hands off’ এপ্রোচ, যেখানে ম্যানেজারের সাথে এমপ্লয়ির সহজগম্যতা একেবারেই নেই। এই পরিবারে সন্তানদেরকে কঠোর নিয়মের মধ্যে বড় হতে হয় এবং কারণে-অকারণে শাস্তি পেতে হয়। সন্তানের মানসিক বা অন্যান্য চাহিদার প্রতি বাবামায়ের সংবেদনশীলতা একেবারে নেই বললেই চলে। বেশিরভাগ পরিবারে বাবারাই এই ভূমিকায় অগ্রণী হয়ে থাকে।
অথোরিটেরিয়ান বাবা মায়ের সন্তানেরা
– পড়াশোনায় ভালো ফলাফল করে
– সমাজে ভালো অবস্থানে যেতে পারে
– তবে মানসিকভাবে অসুখী হয়ে থাকে
– এক ধরণের নিরাপত্তাহীনতায় ভুগে থাকে
– আত্নবিশ্বাস বা আত্নমর্যাদা (self-esteem) কম থাকে
– সোশ্যাল স্কিল বা সামাজিক দক্ষতা কম থাকে
– অল্পতেই অস্থির হয়ে যায়
– মাদকাসক্তি তে বেশী ভুগে থাকে।
২) Authoritative Parenting
(High demandingness, high responsiveness)
অথোরিটেটিভ বাবা মায়ের সন্তানের কাছ থেকে প্রত্যাশা অনেক বেশি থাকে, কিন্তু একই সাথে তারা সন্তানের প্রতি যথেষ্ট সহনশীল ও সংবেদনশীল। তারা সন্তানদের জন্য নির্দিষ্ট কিছু নিয়ম কানুন বেঁধে দেন, সবকিছুর সীমা নির্ধারণ করে দেন। কিন্তু সেই সাথে এগুলোর পেছনের কারণও ব্যাখ্যা করেন, ভাল মন্দ বুঝিয়ে বলেন। ম্যানেজমেন্টের ভাষায় এটি অনেকটা ‘Hands on’ এপ্রোচের মত, যেখানে ম্যানেজারের সাথে এমপ্লয়ির সম্পর্ক সহজগম্য। এই বাবা-মায়েরা সন্তানের প্রতি স্নেহপ্রবণ, সহযোগিতাপূর্ন আচরণ করে থাকেন এবং সন্তান কে স্বাবলম্বী হতে সাহস যোগান। এই স্টাইলের আরেকটি নাম গণতান্ত্রিক বা ডেমোক্রেটিক স্টাইল।
অথোরিটেটিভ বাবা মায়ের সন্তানেরা
– পড়াশোনায় ভালো ফলাফল করে
– সমাজেও ভালো অবস্থানে যেতে পারে
– মানসিকভাবে আনন্দিত ও সন্তুষ্ট থাকে
– অন্যদের তুলনায় বেশি স্বাবলম্বী
– আত্নবিশ্বাসী ও ধীর-স্থির হয়ে থাকে
– সামাজিক দক্ষতা ভাল এবং বন্ধুদের সাথে ভাল সম্পর্ক বজায় রাখতে পারে
– বিষণ্ণতা, অস্থিরতা, মাদকাসক্তি ইত্যাদি সমস্যায় কম পড়ে
– আগ্রাসী মনোভাবের অধিকারী হয় না।
৩) Permissive parenting
(Low demandingness, high responsiveness)
পারমিসিভ বাবা মা সাধারণত সন্তান কে কোন নিয়ম কানুন বা লিমিট সেট করে দেন না। আদব কায়দা ও আচার আচরনের নিয়ম- কানুন মানলো কি না মানলো সে বিষয়ে অনেকটাই নির্বিকার থাকেন। তারা সন্তানকে ‘না’ খুব কম বিষয়েই বলতে পারেন, বেশিরভাগ কাজেই তারা সন্তানের উপর মাত্রাতিরিক্ত আস্থা রেখে অনুমতি দিয়ে দেন, তাদের সন্তুষ্ট রাখার চেষ্টা করেন। সাধারণত মায়েদের মধ্যে এই প্রবনতা বেশি লক্ষনীয়।
পারমিসিভ বাবা মায়ের সন্তানেরা
– নিয়ম কানুনের তোয়াক্কা করেনা
– আত্ননিয়ন্ত্রণ খুব কম
– আত্নকেন্দ্রিক হয়ে থাকে
– সামাজিক মেলামেশায় ততটা পরিপক্ক নয়
– অবাধ্যতা জনিত রোগ (oppositional defiant behaviour) বা আচরণের সমস্যা জনিত রোগ (Conduct Disorder) এ ভোগার সম্ভাবনা বেশি থাকে।
৪) Negligent/ Un-involved Parenting
( Low demand, low responsiveness)
নেগলেক্টফুল বাবা মা অনেকটা অবহেলা নিয়ে সন্তান লালন-পালন করে থাকেন। তারা সন্তানকে কোন প্রকার সীমা নির্ধারণ করে দেন না, আবার জীবনের বৃহত্তর কোন লক্ষ্যও নির্ধারণ করে দেন না। সন্তানের যাবতীয় চাহিদার প্রতি তারা একরকম নির্লিপ্ত, সন্তানের সাথে মানসিকভাবে প্রায় বিচ্ছিন্ন। সাধারণত বাবাদেরকে এই ভূমিকায় বেশি পাওয়া যায়।
নেগলেক্টফুল বাবামায়েদের সন্তানেরা
– ইম্পালসিভ বা হঠকারী হয়ে থাকে
– আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনা
– আইন ভংগ করার প্রবণতা বেশি এবং মাদকের ঝুকিতে থাকে বেশি
– আত্নহত্যার প্রবণতা সহ বেশ কিছু মানসিক রোগে ভোগার প্রবণতা বেশি।
এবার একটি উদাহরণ দিয়ে ৪ টি প্যারেন্টিং স্টাইল আরেকটু খোলাসা করার চেষ্টা করি-
সাইফুল একজন নর্থ প্রি-টিন। সে একদিন বাবার কাছে দাবি করে বসলো, বন্ধুদের সাথে একটি পার্কে ঘুরতে যেতে চায়, যেখানে সাধারণত এই বয়সী কিশোরেরা অনৈতিক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হয়। এই প্রস্তাবে কোন ধরণের প্যারেন্টের রেসপন্স কেমন হবে?
অথোরিটেরিয়ান: উহু! কোনভাবেই যাওয়া যাবেনা। না মানে না! আমার অনুমতি ছাড়া যদি ওখানে গিয়েছো বলে জানতে পারি, তাহলে তোমার খবর আছে।
অথোরিটেটিভ: না, আমি চাইনা তুমি এই মুহুর্তে তোমার বন্ধুদের সাথে ওখানে যাও। চলো, আজ বিকেলে তুমি আর আমি গিয়ে দেখে আসি, ওখানকার পরিবেশ কেমন। যদি আমাদের কাছে ভালো মনে হয়, তাহলে পরবর্তীতে তোমাকে বন্ধুদের সাথে যেতে দেওয়া হবে, ইনশাআল্লাহ।
পার্মিসিভ: অবশ্যই, কেন যাবেনা? এখনই উপভোগ করার সময়! যাও, তবে নিজের খেয়াল রেখো।
আন-ইনভলভড: তোমার যেতে ইচ্ছে করলে যাও না করলে না। এ নিয়ে আমাকে বিরক্ত কোরোনা।
এতক্ষণে নিশ্চয়ই বোঝা গেছে, সন্তান পালনের কোন স্টাইলটি সবচেয়ে বেশি কার্যকর। গবেষণালব্ধ ফলাফলগুলোই একই কথা বলছে, Authoritative পদ্ধতিই উপহার দিতে পারে সবচেয়ে ব্যালেন্সড চিন্তাসম্পন্ন ও সফল সন্তান, ইল্লা মা শা আল্লাহ। তাই আমরা নিজেরা যদি এমন প্যারেন্ট না-ও পেয়ে থাকি, তথাপি আমাদের টার্গেট থাকা উচিৎ নিজেরা সন্তানদের সাথে এমন প্যারেন্ট হতে পারা।
আমরা যদিও আমাদের বাবা-দাদাদের উদাহরণ টেনে থাকি, কিন্তু পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষের জীবনী পড়েই দেখুন না! তিনি তার ৬৩ বছরের জীবনে এতগুলো স্ত্রী, এতগুলো সন্তান সামলেছেন, কোনদিন কারও গায়ে সামান্য হাত তুলেছেন বলেও আমরা কোন বর্ণনা পাইনি। এমনকি কিশোর খাদেম দশ বছর তার খেদমত করার পরও তিনি তাকে কোনদিন ধমক দেননি, কিংবা জেরা করেননি। তাহলে বাবা-মা-অভিভাবক হিসেব্ব আমাদের অনুকরণীয় আদর্শ আসলে কে? আমাদের বাপ-দাদারা, নাকি সর্বশ্রেষ্ঠ বাবা ও স্বামী নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম। তিনি সন্তানকে শাসন করতেও বলেছেন, কিন্তু তা উত্তম পন্থায়। আর প্রহার? তা তো একদম শেষ পর্যায়ের ব্যবস্থা।
هَلْ جَزَاء الْإِحْسَانِ إِلَّا الْإِحْسَانُ
“ইহসানের বদলা ইহসান ছাড়া আর কিছু হতে পারে কি?” [সূরা আর-রহমান, ৫৫: ৬০]
إِنَّ اللهَ رَفِيقٌ يُحِبُّ الرِّفْقَ فِي الأَمْرِ كُلِّه
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: “আল্লাহ তাআলা কোমল; তিনি প্রত্যেকটি ব্যাপারে কোমলতা ও নম্রতাকে ভালবাসেন।’’ [বুখারি, মুসলিম, তিরমিযি, ইবন মাজাহ]