বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম
অন্যান্য বিলুপ্ত মাজহাব
যায়দি মাজহাব
এই মাজহাবের নামকরণ করা হয় ইমাম যায়দ ইবনু আলী জয়নুল আবেদীন(র.) এর নামে। তিনি ৭০০ খ্রীষ্টাব্দে মাদীনায় জন্মগ্রহণ করেন। জ্ঞানার্জনের উদ্দেশ্যে তিনি কুফাহ, বসরা, ওয়াসিত ইত্যাদি জায়গায় ভ্রমণ করেন এবং তাঁর সমসাময়িক ‘উলামাগণের (আবূ হানিফা, সুফইয়ান আস সাওরি) সাথে বিভিন্ন বিষয়ে মতবিনিময় করেন। বর্তমানে ইয়েমেন এর অধিকাংশ মানুষ এই মাজহাব অনুসরণ করেন এবং ইয়েমেন এর বাইরে এর অনুসারীর সংখ্যা খুবই নগণ্য।
ইমাম যায়দ(র.)-র শিক্ষাদান পদ্ধতিঃ
তিনি মূলত হাদীস বর্ণনা ও কুরআন তিলাওয়াতের উপর একজন ‘আলিম ছিলেন। মাদীনাহ, বসরা, কুফাহ, ওয়াসিত ইত্যাদি বিভিন্ন জায়গায় শিক্ষকতা করার কারণে তাঁর প্রচুর সংখ্যক ছাত্র ছিল। তিনি ছাত্রদেরকে হাদীস বর্ণনা করতেন এবং কুরআন তিলাওয়াতের নিয়মকানুন শেখাতেন। কোন সমস্যার সমাধান দিতে হলে তিনি হয় নিজে ইজতিহাদ করতেন অথবা ঐ বিষয়ে তাঁর সমসাময়িক কারও মত বেছে নিতেন। তাঁর ছাত্ররা তাঁর মাজহাব লিপিবদ্ধ করেন।
যায়দি মাজহাবে ইসলামী আইনের উৎসসমূহঃ
(১) কুরআন
(২) সুন্নাহ
(৩) আকওয়াল আলীঃ
ব্যাক্তিগত অভিমত ছাড়া ধর্মীয় ব্যাপারে আলী ইবনু আবী তালিব(রা.) এর মতামতকে ইমাম যায়দ সুন্নাহর অংশ মনে করতেন। অর্থাৎ কোন বিষয়ে আলী(রা.) যদি না বলতেন যে এটি তাঁর ব্যাক্তিগত মত তবে ইমাম যায়দ মনে করতেন এটি রাসূলুল্লাহ(সা.) থেকে এসেছে। তবে আলী(রা.) এর নামে প্রচলিত সব ফতোয়াই তিনি গ্রহণ করতেন না এবং কখনো কখনো তার বিপরীত ফতোয়াও দিতেন।
(৪) সাহাবাগণের ইজমাঃ
তিনি মনে করতেন আবূ বাকর, উমার, উসমান (রা.) এর চাইতে তাঁর দাদা আলী(রা.) ছিলেন খিলাফাতের অধিক উপযুক্ত তবে সাহাবাগণের ইজমার কারণে তিনি তা মেনে নিয়েছিলেন।
(৫) কিয়াসঃ
অন্যান্য মাজহাবে ‘ইসতিহসান’ ও ‘ইসতিসলাহ’ নামে যে দুইটি উৎস প্রচলিত আছে সেগুলোকে ইমাম যায়দ কিয়াস এর অংশ মনে করতেন।
(৬) আকল (Human Intellect):
যখন পূর্বের কোন উৎসেই খুঁজে পাওয়া যেত না তখনই কেবল ইমাম যায়দ আকল এর আশ্রয় নিতেন। তিনি যুবক বয়সে মু‘তাযিলা আক্বীদার প্রতিষ্ঠাতা ওয়াসিল ইবনু আতা-র ছাত্র ছিলেন এবং তাই আকল এর নীতি দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। তবে মু‘তাযিলাগণ কুরআন ও সুন্নাহর পরেই সাহাবাগণের ইজমা ও কিয়াসকে অস্বীকার করে আকলকে গ্রহণ করে কিন্তু ইমাম যায়দ আকল এর আশ্রয় নিতেন সবার শেষে।
লায়সি মাজহাবঃ
এই মাজহাবের নামকরণ করা হয় ইমাম লাইস ইবনু সাদ(র.) এর নামে। তিনি ৭১৬ খ্রীষ্টাব্দে মিশরে জন্মগ্রহণ করেন। তৎকালীন সময়ে ইসলামী জ্ঞানের সকল শাখায় গভীরভাবে অধ্যায়ন করে তিনি মিশরের প্রধান ‘আলিমে পরিণত হন। এমনকি ইমাম শাফিঈ তাঁকে ইমাম মালিক এর চেয়েও বড় ফকীহ মনে করতেন। ৭৯১ খ্রীষ্টাব্দে তাঁর মৃত্যুর পরপরই তাঁর মাজহাব বিলুপ্ত হয়ে যায়।
লায়সি মাজহাবের বিলুপ্তির কারণঃ
(১) তিনি কুরআন, সুন্নাহ ও সাহাবাগণের মতের আলোকে তাঁর ইজতিহাদগুলি কখনো সংকলিত করেননি এবং তাঁর ছাত্রদেরকেও সংরক্ষণ করতে বলেননি। তাই প্রাচীন ফিক্বহ এর গ্রন্থগুলির বাইরে তাঁর গবেষণাগুলি যৎসামান্যই পাওয়া যায়।
(২) তাঁর ছাত্রদের সংখ্যা ছিল খুবই নগণ্য এবং তাদের কেউই বড় ফকীহ হতে পারেননি যাদের মাধ্যমে তাঁর মাজহাব সংরক্ষিত হতে পারত।
(৩) আল লাইস এর মৃত্যুর পর ইমাম শাফিঈ মিশরে স্থায়ী হন এবং দ্রুত শাফিঈ মাজহাব তাঁর মাজহাবের স্থান দখল করে।
সাওরি মাজহাবঃ
এই মাজহাবের নামকরণ করা হয় ইমাম সুফইয়ান আস সাওরি(র.) এর নামে। তিনি ৭১৯ খ্রীষ্টাব্দে কুফায় জন্মগ্রহণ করেন। হাদীস ও ফিক্বহ শাস্ত্রে গভীর অধ্যায়নের পর তিনি কুফার প্রধান ফকীহতে পরিণত হন। ইসলামী আইনের ক্ষেত্রে তিনি ইসতিহসান ও কিয়াস ছাড়া হানাফি মাজহাবের অন্যান্য উৎস গ্রহণ করেছিলেন। আব্বাসীয় খলীফা আল মানসুর তাঁকে এই শর্তে কুফার বিচারক হতে বলেন যে, খলীফার কোন সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে তিনি ফতোয়া দিতে পারবেন না। সুফইয়ান(র.) রাগে এই চিঠি ছিঁড়ে টাইগ্রিস নদীতে ফেলে দেন। পরিণতিতে তাঁকে জীবন রক্ষার জন্য পালিয়ে আত্নগোপন করতে হয় এবং ৭৭৭ খ্রিষ্টাব্দে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি আত্নগোপনেই ছিলেন।
সাওরি মাজহাবের বিলুপ্তির কারণঃ
(১) তিনি জীবনের একটি বড় অংশ আত্নগোপনে কাটিয়েছিলেন এবং এজন্য অনেকেই তাঁর ছাত্রত্ব লাভ থেকে বঞ্চিত হয় ফলে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে তাঁর মাজহাবকে পৌঁছে দেওয়ার মত উল্লেখযোগ্য কেউ ছিল না।
(২) তিনি তাঁর প্রধান ছাত্র ‘আম্মার ইবনু সাইফকে তাঁর যাবতীয় ফিক্বহ বিষয়ক গবেষণাগুলি পুড়িয়ে ফেলতে বলেন। ফলে সেগুলো বিলুপ্ত হয়ে যায়। তবে এরপরেও তাঁর কিছু গবেষণাকর্ম অন্যান্য ইমামগণের ছাত্রদের দ্বারা সংরক্ষিত হয় যা বর্তমান সময়েও বিক্ষিপ্তভাবে রয়েছে।
যাহিরী মাজহাবঃ
এই মাজহাবের নামকরণ করা হয় ইমাম দাঊদ ইবনু ‘আলী(র.) এর নামে। তিনি ৮১৫ খ্রীষ্টাব্দে কুফায় জন্মগ্রহণ করেন। ইমাম শাফিঈ-র ছাত্রদের কাছে প্রাথমিকভাবে ফিক্বহ পড়া শুরু করলেও পরবর্তীতে তিনি হাদীসের প্রতি ঝুঁকে পড়েন এবং ইমাম আহমাদ এর দারসে বসতেন। কিন্তু ‘কুরআন সৃষ্ট’ এই মত দেওয়ার পর তিনি ইমাম আহমাদ এর দারস থেকে বহিষ্কৃত হন। এরপর তিনি কুরআনের বাহ্যিক বা প্রকাশ্য (যাহির) অর্থের উপর ভিত্তি করে ফতোয়া দেওয়ার এক নিজস্ব রীতি চালু করেন। এজন্য তিনি দাঊদ আয যাহিরী নামে পরিচিত হন এবং তাঁর মাজহাব এর নাম হয় যাহিরী মাজহাব। তিনি কুরআন ও সুন্নাহর বাহ্যিক অর্থ নেওয়ার কারণে পরোক্ষভাবে কিয়াসকে অস্বীকার করলেও ‘মাফহুম’(Understood Meaning) এর আশ্রয় নেন যা প্রকৃতপক্ষে কিয়াস এরই একটি প্রকার।
যাহিরী মাজহাবের বিলুপ্তির কারণঃ
খুব সীমিত সুযোগ এবং বড় কোন ফকীহর অনুপস্থিতির কারনেই মূলত যাহিরী মাজহাব বিলুপ্ত হয়ে যায়। সত্য বলতে, ইমাম দাঊদ এর জীবদ্দশাতেই শূধু নয় বরং তাঁর মৃত্যুর ১৫০ বছর পরেও কোন মুসলিম ভূমিতে যাহিরী মাজহাব শক্ত আসন করে নিতে পারেনি। তবে ১১শ শতকের বিখ্যাত স্পেনীয় ‘আলিম ‘আলি ইবনু আহমাদ ইবনু হাযম আল আন্দালূসি (র.) এই মাজহাবকে সাময়িকভাবে পুর্নজীবন দান করেন। আন্দালুসে মুসলিম শাসনের পতনের পর ইবনু হাযম এর কিছু গবেষণাকর্ম ছাড়া এই মাজহাব সম্পূর্ণরূপে বিলুপ্ত হয়ে যায়।
জারিরী মাজহাবঃ
এই মাজহাবের নামকরণ করা হয় ইমাম মুহাম্মাদ ইবনু জারীর ইবনু ইয়াজীদ আত তাবারি(র.) এর নামে। তিনি ৮৩৯ খ্রীষ্টাব্দে তাবারিস্তান এর এক প্রদেশে জন্মগ্রহণ করেন। হাদীস, ফিক্বহ ও ইতিহাস শাস্ত্রে তিনি গভীর পাণ্ডিত্য অর্জন করেন। তিনি ইমাম আবূ হানিফা, মালিক, শাফিঈ ও অন্যান্য ইমামদের মাজহাবের উপর পড়াশোনা করেন। মিশর থেকে প্রত্যাবর্তনের পর ১০ বছর তিনি কঠিনভাবে শাফিঈ মাজহাব অনুসরণ করতেন এবং এরপর নিজের একটি স্বতন্ত্র মাজহাব প্রতিষ্ঠা করেন যা ‘জারিরী মাজহাব’ নামে পরিচিত হয়। কিন্তু তাঁর মাজহাব তুলনামূলক দ্রুত বিলুপ্ত হয়ে যায়। তিনি সমধিক পরিচিত তাঁর বিখ্যাত তাফসীর গ্রন্থের জন্য যা ‘তাফসীর আত তাবারি’ নামে সুপরিচিত।