বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম
আব্বাসীয় খলিফাদের যুগ (৭৫০-৯৫০ খ্রীষ্টাব্দ)
ফিক্বহ বিবর্তনের এই পর্যায়টি ৭৫০ খ্রীষ্টাব্দ থেকে শুরু হয়ে ৯৫০ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত (আব্বাসীয় খিলাফতের পতনের শুরু) বিস্তৃত ছিল। এই সময়েই প্রথমবারের মত ফিক্বহ ইসলামী জ্ঞানের একটি স্বতন্ত্র শাখা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। এছাড়াও এই সময় গ্রীক দর্শনশাস্ত্রের বিভিন্ন বই আরবীতে অনূদিত হয় ফলে গ্রীক চিন্তাধারা ইসলামী জ্ঞানের উপর প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করে।
এই পর্যায়ে ফিক্বহ এর বৈশিষ্ট্য আলোচনা করতে গেলে একে দুইটি ভাগে ভাগ করতে হবে-
(১) ৭৫০-৮৫০ খ্রীষ্টাব্দ
(২) ৮৫০-৯৫০ খ্রীষ্টাব্দ
৭৫০-৮৫০ খ্রীষ্টাব্দঃ
প্রথম যুগের আব্বাসীয় খলীফাগণ ইসলামী আইন ও ‘উলামাদের প্রতি যথেষ্ট সম্মান দেখাতেন এবং খলীফাদের মধ্যে কেউ কেউ ‘আলিমও ছিলেন(যেমন-খলীফা হারুন অর রশিদ)। খলীফা আল মানসূর ইমাম মালিককে রাসূল(সা.) এর সুন্নাহর উপর একটি সংকলন তৈরী করতে বলেন এবং তা রাষ্ট্রীয় সংবিধান হিসেবে চালু করার প্রস্তাব দেন। তবে অন্যদিকে, ‘উলামাগণ ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক খলীফাদের রাজনৈতিক কোন সিদ্ধান্তের বিরোধীতা করলে তাদের উপর অত্যাচারের খড়গ নেমে আসত। এজন্য খলীফাগণ একটি অদ্ভূত নিয়ম চালু করেছিলেন- ‘যদি কোন ব্যক্তি খলীফার সাথে আনুগত্যের বায়াত ছিন্ন করে তবে তার স্ত্রীর সাথে কোন প্রক্রিয়া ছাড়াই তালাক হয়ে যাবে’। ইমাম মালিক(র.) এই আইনের বিরোধীতা করেন এবং একে বাতিল বলে মত দেন। এজন্য তাঁজে জেলবন্দী করে নির্মম অত্যাচার করা হয়।
এই সময় ‘উলামাগণ জ্ঞান অন্বেষণের উদ্দেশ্যে দেশ-বিদেশে পাড়ি দিতে থাকেন। ইমাম মুহাম্মাদ ইবনু আল হাসান ইরাকে আবূ হানিফা(র.) ও মাদীনায় ইমাম মালিক(র.) এর কাছে অধ্যায়ন করেন, ইমাম আশ শাফিঈ(র.) হিজাজে ইমাম মালিক(র.) এর কাছে অধ্যায়ন শেষে ইরাকে ইমাম মুহাম্মাদ(র.) এবং অতঃপর মিশরে আল লাইস ইবনু সাদ(র.) এর ছাত্রদের কাছে অধ্যায়ন করেন। মহান ইমামগণের জ্ঞানার্জনের উদ্দেশ্যে এসব ভ্রমণের ফলে তৎকালীন সমাজে বিদ্যমান কিছু উল্লেখযোগ্য ইখতিলাফ এর অবসান হয় এবং কিছু কিছু ‘উলামাগণের পারস্পরিক মতের সমন্বয় সম্ভব হয়। এছাড়াও এই সময়ে ‘উলামাগণের মধ্যে বিভিন্ন ফিক্বহী বিষয়ে পারস্পরিক আলোচনা ও বিতর্ক এক নতুন রূপ লাভ করে।
৮৫০-৯৫০ খ্রীষ্টাব্দঃ
এই সময়ের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হল এই সময়ে ফিক্বহ গ্রন্থের সংকলন শুরু হয়। ইমাম মালিক(র.)-র ‘আল মুয়াত্তা’, ইমাম আশ শাফিঈ(র.)-র ‘আল উম্ম’, ইমাম আবূ ইউসুফ(র.) এর ‘কিতাব আল খারাজ’ এবং ইমাম ইবনু আল কাসিম(র.)-র ‘আল মুদাউওয়ানাহ’ এই সময়ের উল্লেখযোগ্য ফিক্বহ সংকলন। এই সময়ে প্রথমবারের মত ফিক্বহশাস্ত্র কে ‘উসূল’(Fundamental Principles) এবং ‘ফুরূ’’(Secondary Principles) এই দুই ভাগে ভাগ করে আলোচনা করা হয় এবং তাফসীর, হাদীস ও আরবী ব্যাকরণ শাস্ত্র ইসলামী জ্ঞানের বিশেষ শাখা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়।
এই সময়ে রাসূল(সা.) এর সুন্নাহ নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে সংগৃহীত ও বই আকারে সংকলিত হয়। ইমাম আহমাদ ইবনু হাম্বাল(র.)-র ‘মুসনাদে আহমাদ’ এই সময়ে হাদীস এর সর্ববৃহৎ সংকলন। এছাড়াও ইমাম বুখারী(র.)-র বিখ্যাত ‘সহীহ বুখারী’, ইমাম মুসলিম(র.)-র ‘সহীহ মুসলিম’ এই সময়ের উল্লেখযোগ্য হাদীস গ্রন্থ।
এই শতকের আরেকটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হল Court Debate. খলীফার মনোরঞ্জন এর জন্য বিভিন্ন মাজহাবের ‘উলামাগণকে রাজদরবারে নিয়ে আসা হত এবং ফিক্বহী বিষয়ে বিতর্ক করতে বলা হত। কিছুদিন এর মধ্যেই যখন বাস্তবভিত্তিক সমস্যা নিয়ে বিতর্ক শেষ হয়ে যায় তখন শুধুই খলীফার বিনোদন এর জন্য নতুন নতুন কাল্পনিক ফিক্বহী সমস্যা বের করা হত এবং জয়ী পক্ষকে খলীফার পক্ষ থেকে পুরষ্কৃত করা হত। বিভিন্ন মাজহাবের ‘উলামাগণ নিজের মাজহাবকে যেকোন মুল্যে বিজয়ী করার এবং পুরষ্কার নেওয়ার মানসে বিতর্ক করতেন। এই সময়ে বিতর্কে জেতার জন্য অনূদিত গ্রীক শাস্ত্রের সাহায্যও তারা নিতেন। এভাবে অনেক অপ্রয়োজনীয় ও অবাস্তব ফিক্বহী সমস্যা ও তার বিতর্কভিত্তিক সমাধান এই সময়ের ফিক্বহ গ্রন্থগুলিতে স্থান পায়। আর এভাবেই এই পর্যায়ে Hypothetical Fiqh এক নতুন মাত্রা লাভ করে এবং বিভিন্ন মাজহাবের মধ্যে উল্লেখযোগ্য দূরত্ব ও নিজ মাজহাব এর অন্ধ অনুসরণের প্রবণতা সৃষ্টি হয় যা পরবর্তী যুগগুলিতে আরো ব্যাপক আকার লাভ করে।
এই সময়ে ইসলামী আইনের উৎসঃ
(১) কুরআনঃ
কুরআন ইসলামী আইনের সর্বপ্রথম উৎস এই ব্যাপারে ‘উলামাগণের মধ্যে কোন মতভেদ ছিল না। তবে কিছু আয়াতের বাখ্যা নিয়ে ‘উলামাগণের ইখতিলাফ ছিল।
(২) সুন্নাহঃ
কুরআনের পরেই সুন্নাহ ইসলামী আইনের দ্বিতীয় প্রধান উৎস। তবে ‘উলামাগণ সুন্নাহর গ্রহণযোগ্যতা ও প্রয়োগের ক্ষেত্রে কিছু শর্ত জুড়ে দিয়েছিলেন (যা আমরা পরবর্তী পর্বগুলিতে দেখব ইনশাআল্লাহ)।
(৩) সাহাবাগণের মতামতঃ
একে দুইটি ভাগে ভাগ করা যায়। সকল সাহাবী যখন কোন বিষয়ে একমত পোষণ করেন তখন তাকে বলা হয় ‘ইজমা’ এবং কোন বিষয়ে সাহাবাগণের ব্যাক্তিগত অভিমতকে বলা হয় ‘রায়’। উভয়টিই এই সময়ে ইসলামী আইনের তৃতীয় উৎস হিসেবে বিবেচিত হয়।
(৪) কিয়াসঃ
কুরআন ও সুন্নাহর উপর ভিত্তি করে কোন বিষয়ে ইজতিহাদ করাকে বলা হয় ‘কিয়াস’। যেমন- মারিজুয়ানা রাসূল (সা.) এর সময় ছিলনা কিন্তু এটিকে হারাম বলা যায় নিচের হাদীসের উপর ভিত্তি করে-
“Every Intoxicant is Khamr and every form of Khamr is Haram”. [Sahih Muslim, no-4963]
(৫) ইসতিহসানঃ
কোন বিষয়ে কিয়াস এর ভিত্তিতে প্রাপ্ত সমাধান কখনো কখনো বাস্তবতা ও মানুষের প্রয়োজনের সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ণ হতে পারে। এক্ষেত্রে বাস্তবতা ও মানুষের প্রয়োজনের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ সিদ্ধান্ত কিয়াস এর উপর অগ্রাধিকার পায়। একেই বলা হয় ‘ইসতিহসান’। বিভিন্ন মাযহাবের ‘উলামাগণ একে বিভিন্ন নামে অভিহিত করে [‘ইসতিসলাহ’, ‘ইসতিসহাব’ ইত্যাদি] ইসলামী আইনের উৎস হিসেবে গ্রহণ করেছেন। একটি উদাহরণ দিয়ে ব্যাপারটি পরিষ্কার বুঝা যায়। রাসূল(সা.) বলেছেন-
“Whoever sells food should not do so until he has it in his own possession”.
[Muwatta Malik, no-1324]
এখন ধরা যাক, কেউ একটি নৌকা কিনবে। উপরোক্ত হাদীসের ভিত্তিতে কিয়াস করে বলা যায়, নৌকা বিক্রেতার কাছে একটি সম্পূর্ণ নৌকা প্রস্তুত না থাকা পর্যন্ত সে তা বিক্রি করতে পারবে না বা তার বিনিময়ে কোন টাকা নিতে পারবে না। কিন্তু এটি অবাস্তব সিদ্ধান্ত। নৌকা বিক্রেতা তার ক্রেতার কাছ থেকে কিছু টাকা অগ্রিম নিয়ে নৌকা তৈরীর যাবতীয় সরঞ্জাম কিনে নৌকা বিক্রি করে বাকি টাকা নিবে এটাই বর্তমান সময় ও প্রয়োজনের আলোকে বাস্তব। এখানে কিয়াস থেকে প্রাপ্ত ফলাফল অপ্রয়োগযোগ্য। এটাই হল ইসতিহসান।
(৬) ‘উরফ (Custom):
কোন নির্দিষ্ট অঞ্চলের প্রচলিত রীতিনীতি কখনো কখনো ঐ অঞ্চলের ইসলামী আইনের উৎস হিসেবে বিবেচিত হয় যতক্ষণ তা ইসলামী শারী’আহর সাথে সাংঘর্ষিক না হয়। যেমন- ইসলামী শারী’আহ বিয়েতে মাহর ঠিক কখন এবং কত সময়ের মধ্যে পরিশোধ করতে হবে তা সুনির্দিষ্টভাবে বলে দেয়নি। মিশরের রীতি অনুযায়ী মাহর এর কিছু অংশ বিয়ের অনুষ্ঠানের আগে পরিশোধ করতে হয় এবং বাকি অংশ শুধুমাত্র মৃত্যু বা ডিভোর্স এর ক্ষেত্রেই পরিশোধ করতে হয়। এটিই ঐ অঞ্চলের মাহর সংক্রান্ত আইন।
এভাবে এই সময়ে ইসলামী আইনের উৎসসমূহের প্রণালীবদ্ধকরণ এবং শ্রেণীবিভাগ করা হয়। এর অনেক ভাল দিক থাকলেও এর ফলে পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন মাজহাবের মধ্যে দূরত্ব বাড়তে থাকে। যেমন সুন্নাহর গ্রহণযোগ্যতার শর্ত হিসেবে ভিন্ন ভিন্ন মাযহাবের ‘উলামাগণ ভিন্ন ভিন্ন শর্ত দিয়েছিলেন এবং এর ফলে একই বিষয়ের সমাধানে মতপার্থক্য বাড়তে থাকে। এছাড়াও হানাফী মাযহাবের উৎস হিসেবে ‘ইসতিহসান’ বিবেচিত হলেও মালিকি মাযহাবে একে অগ্রহণযোগ্য বলা হয় তবে একই বিষয়টি তারা ‘ইসতিসলাহ’ নামে গ্রহণ করে। আবার আবার শাফিঈ মাযহাবে ইসতিহসান ও ইসতিসলাহ উভয়কে প্রত্যাখান করে ‘ইসতিসহাব’ নামে একই পদ্ধতি গ্রহণ করা হয়। এই সময়ের প্রথম শতকের উল্লেখযোগ্য দিক হল বিভিন্ন মাজহাবের ‘উলামাগণের মধ্যে পারস্পরিক মত বিনিময় এবং তাদের মধ্যে বিদ্যমান Flexibility আর দ্বিতীয় শতকের উল্লেখযোগ্য দিক হল বিভিন্ন মাযহাবের ‘উলামা ও অনুসারীদের মধ্যে সৃষ্ট Rigidity যা পরবর্তী সময়ে ভয়াবহ রূপ ধারণ করে।