“ফোকাস” : পর্ব ৩ (4-DX)

আজকে একটা গুরুত্বপূর্ণ কমন সমস্যা নিয়ে আলোচনা করবো। আমাদের প্রত্যেকের জীবনেই মৃত্যুর আগে ‘একটা কিছু করে যাওয়ার’ ইচ্ছে থাকে, তাইনা? আল্লাহ তা’আলা একেকজন মানুষকে একেক রকম মেধা ও যোগ্যতাও তো দিয়েছেন এ কারণেই, যেন সে তাকে দেওয়া যোগ্যতাটুকু কাজে লাগিয়ে উম্মাহর কিছু উপকার করে যেতে পারে। কিন্তু আমরা কজন মানুষ আমাদের জীবনের সেই অভীষ্ট লক্ষ্যটি পূরণ করতে পারি? উত্তর আসবে, অধিকাংশই ‘পারিনা’।

তার মানে এক্সিকিউটর হিসেবে আমাদের অবস্থান বেশি ভালো নয়, তাই না? এর কারণ কী? জীবন কিংবা সময়ের উপর আমাদের ভালো নিয়ন্ত্রণ নেই, ডিসিপ্লিন জানা নেই। খ্যাতিমান লেখক ক্রীস ম্যাককিসনী ও সীন কোভে এ বিষয়ের উপর একটি বেস্ট সেলিং বই লিখেছেন “The 4 Disciplines of Execution” নামে। আমরা কিভাবে আমাদের জীবনের লক্ষ্য নির্ধারণ করে তা সুষ্ঠুভাবে সমাধা করতে পারি, সে বিষয়ে ৪ টি পয়েন্টে আলোচনা করা হয়েছে, যাকে সংক্ষেপে বলা হচ্ছে ‘4 DX’ (4 Disciplines of eXecution)। তো এগুলো কেমন?

১. Focus on thr Wildly Important Goal (WIG) :

0_0POXaxmNaQkfkqEx

আপনার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্যে ফোকাস করুন। এই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্যকে সংক্ষেপে বলা হচ্ছে WIG। আমার WIG কোনটি, কীভাবে নির্ণয় করবো? সত্য বলতে, আমাদের প্রতিদিনকার Distraction of Whirlwind (প্রাত্যহিক কাজের ঘূর্ণাবর্তে) এর মধ্যে জীবনের আসল লক্ষ্যের জন্য সময় খুজে বের করা বেশ কঠিন; কারণ প্রায়োরিটি ম্যাট্রিক্সে এই কাজগুলো আর্জেন্ট শ্রেণীর না, ইম্পর্ট্যান্ট শ্রেণীর। আর আমাদের কাজের ঘূর্ণিঝড় আটকে থাকে এই আর্জেন্ট ও টাইম-ওয়েস্টার কাজের মধ্য দিয়ে।অপরদিকে কর্মশীল ও উদ্যমী মানুষদের ঝামেলা অন্য জায়গায়, তাদের মাথায় সবসময় নিত্য নতুন কাজের পরিকল্পনা বের হতে থাকে। কোন ভালো কাজই হাতছাড়া করতে তাদের মন সাড়া দেয়না, যদিও এই কাজের লিস্ট থাকে তাদের সাধ্যের বাইরে। কিন্তু আমরা আগেও বলেছি, দশটি কাজ একসাথে করলে কোনটারই মান ঠিক থাকেনা। তাই কোন কাজের মান ঠিক রাখার জন্য আমাদের ফোকাসকে যতটা সম্ভব narrow করতে হয়। আরেকটু সহজ করে বলি। আপনার এই মুহুর্তে কী কী কাজ করার পরিকল্পনা মাথায় আছে, সেগুলোর একটা লিস্ট করুন। লক্ষ্য করে দেখুন, এর মধ্যে কোন কাজটি আপনার জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, আর সেই কাজটি বিশেষ মনোযোগ ছাড়া করাও যায়না? এটিই আপনার WIG. অন্যভাবেও চিন্তা করা যায়, ৩ টি প্রশ্নের উত্তর মেলান-
i. আপনি এখন কোথায় আছেন? (Starting Line)
ii. ভবিষ্যতে নিজেকে কোন অবস্থানে দেখতে চান? (Finish Line)
iii. কতদিনের মধ্যে দেখতে চান? (Deadline)

এই প্রশ্নগুলোর উত্তর বুঝতে পারলেই আপনি আপনার WIG এ ফোকাস করতে পারবেন।

২. Act on the LEAD Measures instead of LAG measures :

0_oMmDl7Y36S2THeu6

উদ্দেশ্য সাধনের জন্য এটি চমৎকার একটি আইডিয়া। দুঃখবিলাসী মানুষেরা সাধারণত যে কাজটি করা দরকার, তা না করে সারাক্ষণ আফসোস করতে থাকে। কিন্তু সফলতার মূলমন্ত্র আসলে বিপরীত। আফসোস নয়, যে কাজটি আপনার করা দরকার, তা শুরু করতে হবে। এখানে,
LAG Measure = আপনার অভীষ্ট লক্ষ্য
LEAD Measure = লক্ষ্য অর্জনে করণীয় কাজ।

ল্যাগ নিয়ে চিন্তা করলে আপনার কাছে অসাধ্য মনে হবে, কিন্তু লীড নিয়ে শুরু করলেই একসময় আল্লাহ চাইলে ল্যাগে পৌছে যাবেন। একটা ছোট্ট উদাহরণ দেয়া যায়। আপনি অনেকদিন ধরে চাচ্ছেন আপনার ওজন কমাতে। এখানে ওজন কমানো আপনার ল্যাগ। কিন্তু এই কথা হাজার বার ভাবলেও লাভ হবেনা। ওজন কমানোর জন্য আপনাকে আজ থেকেই ডায়েট কন্ট্রোল ও এক্সারসাইজ করতে হবে। এটিই হচ্ছে লীড মেজার। এই কাজটি নিয়মিত করতে পারলেই একসময় আল্লাহ চাইলে ল্যাগ মেজার বাগে এনে ফেলবেন।

তেমনি আপনার উদ্দেশ্য যদি হয় কোন বিষয়ে একটা সিরিজ নোট লিখে তা বই আকারে প্রকাশ করা, তাহলে ভয় না পেয়ে একটি করে লেখা লিখতে হবে। একসময় আপনা-আপনিই সিরিজ পূর্ণ হয়ে যাবে, ইনশাআল্লাহ।

৩. Keep A Compelling Scoreboard :

0_XpLiLwgeIs-jhiry

কোন পরিকল্পিত কাজ শুরু করার পর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে কাজ, তা হচ্ছে কাজের অগ্রগতি মনিটর করা। তার জন্য দরকার একটি স্কোরবোর্ড মেইন্টেইন করা। এখানে আপনার প্রতিদিনের সমাধা করা কাজ টুকে রেখে সপ্তাহ শেষে তা পর্যবেক্ষণ করতে হবে, আসলেই কাঙ্ক্ষিত অগ্রগতি হচ্ছে কিনা। আর এই বোর্ডটি রাখতে হবে চোখের সামনে কোথাও, যেন তা কন্টিনিউয়াস রিমাইন্ডারের কাজ করে।
যেমনটি করা হয়ে থাকে ক্রিকেট কিংবা ফুটবল খেলায়, খেলোয়াড়রা জানে তাদের প্রতি মুহুর্তের পারফরম্যান্স স্কোরবোর্ডে উঠে যাচ্ছে, তাই সম্ভাব্য পরিমাণ সচেতন থাকার চেষ্টা করে। অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌছতে হলে এই কাজটি আমাদেরকেও করতে হবে।

৪. Create a Cadence of Accountability :

0_ZtBeB-xo2LNKHmPB

জবাবদিহিতা ছাড়া কোন কাজে দায়বদ্ধতা থাকেনা। টীম ওয়ার্কে জবাবদিহিতা থাকে টীম লীডারের কাছে, আর ব্যক্তিগত কাজের জবাবদিহিতা নিজেরই করতে হয়। এটিকে আমরা অন্যভাবে বলে থাকি ‘আত্মসমালোচনা’। অভীষ্ট লক্ষ্যে কাজ শুরু করার পর আমি শেষ পর্যন্ত লক্ষ্যে পৌছতে পারবো কিনা তা জানার জন্য, নিজেকে সবসময় মোটিভেইটেড রাখার জন্য প্রতি সপ্তাহে অন্তত একবার হলেও এই আত্মসমালোচনা করতে হবে৷ ৩ টি প্রশ্নের উত্তর মেলাতে হবে সপ্তাহান্তে-

১. গেল সপ্তাহের কাজের পরিকল্পনা পূর্ণ করতে পেরেছি কিনা?
২. তাতে আমার স্কোরবোর্ডের উন্নতি হয়েছে কিনা?
৩. সামনের সপ্তাহে আমার কাজের পরিকল্পনা কী কী?

এভাবে পরিকল্পনা করে প্রতি সপ্তাহের কাজগুলো সপ্তাহে শেষ করতে পারলে, নিজের লক্ষ্যে দাত কামড়ে লেগে থাকতে পারলে একসময় লক্ষ্যে পৌছবেনই ইনশাআল্লাহ।

লক্ষ্যে তো আমাকে পৌছতেই হবে। কারণ, কাজটি যদি হয় আল্লাহর জন্য, আর আল্লাহই আমাকে সেই কাজের যোগ্যতা ও দক্ষতা দিয়েছেন, এই যোগ্যতার ব্যাপারে আমাকে জিজ্ঞাসিত হতে হবে- মটিভেশান হিসেবে এটুকুই যথেষ্ট নয় কি? ইমাম আবু হানীফার ছাত্র ইমাম মুহাম্মাদ ইবন হাসান আশ-শাইবানি রহ. মানুষের বিভিন্ন শরয়ী বিষয়ে সমাধান দিতেন। কোন মাস’আলার গভীরে না পৌছে তিনি ফায়সালা দিতেন না। কিতাব অধ্যয়নের জন্য তিনি অধিকাংশ রাতই নির্ঘুম কাটাতেন। এক ব্যক্তি তাকে জিজ্ঞেস করেছিলো- আপনি রাতে ঘুমান না কেন? উত্তরে তিনি বলেছিলেন:

“আমি কি করে ঘুমাবো? অথচ আমাদের উপর নির্ভর করে মানুষ নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে। তারা বলে- আমাদের কোন সমস্যা দেখা দিলে তার কাছে যাবো, তিনি তার সমাধান করে দেবেন। এখন আমরাই যদি ঘুমাই, তাহলে তো দ্বীন বরবাদ হয়ে যাবে।”

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *