ভালোত্বের মূল্যায়ন

“আল্লাহ! বুবু জানিস, ঐ মেয়েকে এতদিন মনে করেছিলাম শান্তশিষ্ট, ধোয়া তুলসিপাতা, কিন্তু ভেতরে যে এত বিষ, কে জানতো! আজকেই আসল পরিচয় পাওয়া গেলো। আরো শোন, কি হইছে, আজ করছে কি…..”

ছোট্টবেলা থেকে মুরুব্বিদের মুখে শুনে আসা একটা কমন ডায়ালগ, যেটা আমার সেই বাল্যকালেও পছন্দ হতোনা, এখনও হয়না। তো যেটা বলতে চাচ্ছিলাম…..

‘ধৈর্যশীলতা’র ক্রাইটেরিয়ায় আমার দেখা পৃথিবীর মানুষগুলো মোটামুটি তিন ধাচের:
১. অধৈর্য: এদের পরিচয় নতুন করে দেয়ার কিছু নেই, এরা কথায় কথায় বিরক্ত হয়, আশেপাশের সবার উপরেই অভিযোগ, সব মানুষের উপর, সব পরিস্থিতির উপর অভিযোগ, খুব সহজেই রেগে যায়, নিজেকে স্পষ্টবাদী মনে করে সব জায়গায় অকারণে তেজ দেখায়, এরা নিজেদের সাধু মনে করলেও আশেপাশের বেশিরভাগ মানুষই এদেরকে চরম অপছন্দ করে, পারতপক্ষে এড়িয়ে চলে। এই পর্যায়ের মানুষগুলোর মধ্যে হতাশা, আক্ষেপ কিংবা অপরাধপ্রবনতাও বেশি। এরা নিজেদেরকে স্পষ্টবাদী মনে করলেও এদের জন্য ‘ঠোঁটকাটা’ টার্মটাই বেশি খাটে, কারণ এরা প্রয়োজনের চেয়ে অপ্রয়োজনীয় জায়গায়ই বেশি গলাবাজি করেন, হক্ব কথা বলার চেয়ে নাহক্ব বলে মনে কষ্ট দিতেই বেশি পারেন।

এবার আসি ধৈর্যশীলদের ভাগবিন্যাসে, এরা মূলত দুই ধরণের হয়ে থাকে:
১. পরিমিত ধৈর্যশীল: এই পর্যায়ের মানুষগুলো নিজেদের ধৈর্যের সীমা পর্যন্ত ধৈর্য ধরে, সীমা অতিক্রান্ত হয়ে গেলে স্পষ্টভাষায় প্রতিবাদের চেষ্টা করে: এরা চায় তার সমস্যার মূল্যায়ন হোক, সমাধান হোক, তাকে ধৈর্য ধরতে দেয়া হোক। এরা মাঝে সাঝে রেগে গেলেও এটাই তাদের আসল রূপ না, এরা রেগে যায় মূলত পরিস্থিতি আরও খারাপ না হয়ে এখানেই থেমে যাক, এমনটি চেয়েই। এরা নিজের ব্যাপারে ধৈর্যশীল হলেও অন্যায়ের প্রতিবাদে অকাট্য হয়ে থাকেন।

২. নীরব ধৈর্যশীল: এই পর্যায়ের মানুষগুলো ধৈর্য ধরতে থাকেন, ধরতেই থাকেন, সীমার বাইরে গিয়েও নীরব থাকেন, একটা পর্যায়ে মানুষ ভেবেই বসে: এরা বোকা, এদের কোন ইমোশন নেই…. এরপর চূড়ান্তে গিয়ে এরা বিস্ফোরিত হন: তাতে নিজেও আহত হন, আশপাশের মানুষদেরও আহত করেন। এই পর্যায়ের ধৈর্যশীলরা অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে কম পারেন, অনেক ক্ষেত্রে ব্যর্থও হন।

এবার আসি আমাদের সমাজের মূল্যায়ন প্রসঙ্গে: আমরা বলেই থাকি, দেশে যোগ্যতার মূল্য নেই তাই যোগ্য লোক তৈরি হয়না। তেমন এটাও সত্য, আমাদের সমাজে মানুষের ভালোত্বের মূল্যায়ন নেই, তাই ভালো মানুষের প্রোডাকশন তো নেইই, অল্পকিছু যা আছে তারাও একসময় আর টিকে থাকতে পারেনা। কারণ? আমাদের চিন্তাশীল দৃষ্টি কিংবা অনুধাবন করার মত শক্তিই নেই, আমরা যা চর্মচক্ষে দেখি ওটারই মূল্যায়ন করি। ঝিনুকের মলিন খোলস দেখে ছুড়ে ফেলে রঙিন খোলসের শামুকটি তুলে নেই, সুন্দর করে শোকেসে সাজিয়ে রেখে আমোদিত হই; মলিন খোলসের ভেতরে মুক্ত ছিলো কিনা তা খুঁজে দেখার ইচ্ছেটি হয়না। যাকগে সে কথা, তো সমাজের গলদটা কোথায়? ঐ যে প্রথম যে ডায়ালগটি দিয়ে শুরু করেছিলাম ওখানেই।

যে মানুষটা প্রতিমুহূর্তেই ধৈর্য হারায়, তাকে আমরা অধৈর্য বলেই চিনি। যে মানুষটা দশদিন সহ্য করার পর একাদশতম দিনে রেগে গেলো, তাকেও আমরা একই কাতারে টেনে আনি: ‘ও! এই তাহলে তোমার আসল রূপ?’ যে মানুষটা পঞ্চাশদিন ধৈর্য ধরার পর একান্নতম দিনে আউটবার্স্ট করলো, তাকেও টেনে এনে প্রথম কাতারে দাড় করিয়ে দেই: ‘আচ্ছা! এতদিনে তবে চেনা গেল তোমাকে!’

উহু, আপনি ভুল চিনলেন, আপনি যুলুম করলেন, আপনার চেনাজানার সূত্রেই ভুল আছে। আপনাকে জাজ করার আগেই এটা মাথায় রাখতে হবে: আপনি যাদের নিয়ে ডীল করছেন, এরা আপনার মতই রক্তমাংসে গড়া মানুষ, যার মাঝে আবেগ, অনুভূতি, রাগ, ক্রোধ, দুঃখ, বেদনা, হতাশা, বিদ্বেষ, অহংকার…. সব আছে। এর বাইরে যদি কাউকে এক্সপেক্ট করতে চান, তবে সে ‘ফিরিশতা’, তার আসমানে থাকার কথা, মাটির জমিনে নয়। আপনি কাউকে একদিন রাগতে দেখেই যে তাকে ‘অধৈর্য’ এর কাতারে ফেলে দিলেন, এটা পুরোপুরি ভুল হিসেব করলেন। কারন, মানুষের মধ্যে যারা নিকৃষ্ট, তারা সবচে অধৈর্য। আর যারা নিজের ইমোশনকে কন্ট্রোল করতে পারে, রাগকে দমাতে পারে, নাফসে আম্মারার সাথে যুদ্ধ করতে পারে, এরা উৎকৃষ্ট শ্রেণীর: যে মানুষটা দশদিন সহ্য করেছে, যে মানুষটা পঞ্চাশদিন ধৈর্য ধরেছে, এই দশদিন/পঞ্চাশদিন কি তাকে নফসের সাথে যুদ্ধ করতে হয়নি? এমন মানুষকি পৃথিবীতে পাওয়া যাবে, যে কোনদিনই রেগে যায়নি? যে প্রতিদিন দশবার রাগে, আর যে সহ্যের শেষসীমায় গিয়ে দশদিনে একবার রাগে, মীযানের পাল্লায় তাদের মূল্য কি সমান? কখনোই না, কক্ষণোই না। কাউকে একদিন রেগে যেতে দেখেই তাই বলে ফেলবেন না: এটাই তার আসল রূপ। হতে পারে এটা তার আসল রূপ না, আসল রূপের মূল্যায়ন না পেয়েই হয়তো সে বিকৃত রূপে আসতে বাধ্য হয়েছে। তার অভিযোগের প্রতিকার করুন, তার নীরবতাকে দুর্বলতা না মনে করে তার মতামতটাকেও প্রাধান্য দিন, সে আবার তার ‘ভালো’ রূপেই ফিরে আসবে।

আর হ্যা, যে মুহূর্তে এই ধৈর্যশীল মানুষটিকেও আপনি ‘অধৈর্য’ ট্যাগ দিয়ে দিলেন, মনে রাখবেন, আপনি তাকে অধৈর্য হওয়ার পথই বাতলে দিলেন, সে ঠিকই মনে করবে: ও আচ্ছা, আমি এত ধৈর্য ধরেও খারাপ হয়ে গেলাম? তবে এবার সত্যিই খারাপ হয়ে দেখাই। এটাই মানুষের সাইকোলজি, সমাজে ভালো মানুষগুলোর ভালো থাকার জন্য আসলে ‘ভালোত্বের’ মূল্যায়ন জরুরী, নচেৎ ভালোটা খারাপের রাজ্যে একা একা যুদ্ধ করে বেশিদিন টিকে থাকতে পারেনা। ঘাপলাটা এখানেই….

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *