অনেককাল আগে এক ভারতীয় বণিক তার পারস্য বণিক বন্ধুকে একটা গান গাইতে পারা টিয়া উপহার দেয়। বণিক তাকে পারস্য দেশে নিয়ে এসে একটি সুন্দর খাঁচার মধ্যে বন্দী করে বাড়ীর সামনে ঝুলিয়ে রাখে এবং প্রতিদিন গান শুনে চিত্ত বিনোদন লাভ করে। একদিন বণিক ব্যবসার উদ্দেশ্যে আবার ভারত যাত্রার সিদ্ধান্ত নেয়। যাত্রার প্রাক্কালে স্ত্রী-পুত্র-কন্যা সবাইকে তাদের পছন্দের জিনিস সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে এবং কথা দেয় তা ভারত থেকে নিয়ে আসবে। সবাই তাদের পছন্দের ফর্দ ধরিয়ে দেয়। বণিক খুশি মনে বাড়ী থেকে বের হওয়ার সময় টিয়া’র দিকে চোখ পড়ে। সে ছোট্ট পাখিটির কাছেও তার পছন্দের জিনিসের নাম জানতে চায়। পাখিটি জবাবে বলে- “আমার কিছু লাগবে না, তবে আমার একটা বার্তা আছে, সেটা আপনাকে পৌঁছে দিতে হবে”।
বণিক আগ্রহভরে, কৌতূহলী হয়ে খুশিমনে তার বার্তা জানতে চায়। টিয়া’টি বলে-“ আপনি যখন ভারতে যাবেন তখন আমার সমগোত্রীয় পাখিদের আমার অবস্থার ব্যাপারে জানাবেন। তাদের কাছ থেকে জানতে চাইবেন এটা কি ন্যায়বিচার হয় যে তারা মুক্ত আকাশে উড়ে বেড়াবে আর আমি তাদেরই একজন হয়ে এই খাঁচার ভেতর দিন গুজরান করে যাবো”।
-আমি তোমার মেসেজ তাদের কাছে পৌঁছে দেব।
এই বলে বণিক সমুদ্র পাড়ি দিয়ে ভারতীয় উপমহাদেশে এসে ব্যবসা করল। তার স্ত্রী বাচ্চাদের পছন্দের জিনিসপাতিও ক্রয় করল। এরমধ্যে তার মনে টিয়াটির দেয়া বার্তার কথা মনে পড়ল। সে টিয়ার একটা দলকে পেল এক গাছের বিভিন্ন ডালে বসে আছে।
বণিক তাদেরকে টিয়া’র মেসেজটি দিল। এরমধ্যে একটি টিয়া হঠাৎ করে ছটফট করতে করতে ডাল থেকে পড়ে মরে গেল। বণিক এদিক সেদিক তাকালো কোন তীর এসে বিঁধল কিনা, কিন্তু তার কোন চিহ্ন পেলোনা।
তার কথা শুনে একটি টিয়া মারা গেল এই ভেবে বণিক মন খারাপ করে তার দেশে ফিরে আসলো। সবাইকে উপহার বুঝিয়ে দিয়ে যখন বণিক টিয়ার খাঁচার সামনে আসলো তখন দেখল টিয়া তার দিকে আগ্রহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। বণিক দুঃখ ভারাক্রান্ত মনে টিয়াকে পুরো ব্যাপারটি খুলে বলল।
সবশুনে হঠাৎ টিয়া’টি ছটফট করা শুরু করলো মৃতের মত খাঁচায় চিৎ হয়ে পড়ে গেল। বণিক ভাবলো টিয়ার মৃত্যুর ঘটনাটি তার টিয়াটি মেনে নিতে পারেনি তাই মরে গেছে। বণিক মনে মনে খুব কষ্ট পেল।
খাঁচা খুলে মৃত টিয়াকে বের করে যখন সে ফ্লোরে রাখল হঠাৎ টিয়াটি উড়ে এক গাছের উপর গিয়ে বসল। বণিক আশ্চর্য হয়ে বলল- তুমি বেঁচে আছো?
“আমি বেঁচে আছি এবং আমার ভাই আমার সত্যিকার বেঁচে থাকা এবং মুক্ত হওয়ার পথ বাতলে দিয়েছে। আমার সুন্দর কন্ঠের কারণে মানুষ আমাকে বন্দী করে রেখেছিল। আমি বুঝতে পেরেছি, মৃত্যুর মাধ্যমেই সত্যিকার বেঁচে থাকা সম্ভব। মৃত্যুই আমাকে মুক্তি দিয়েছে”।
‘মরার আগেই মরে যাওয়া’ কথাটার মানে আসলে কি?
বাস্তবিক মৃত্যুর পূর্বে নিজেকে মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড় করানো যায় কিভাবে?
‘নফস’ বা ‘প্রবৃত্তি’ মানুষের বিভিন্ন গতিপ্রকৃতির জন্য দায়ী। এই নফস আমাদের পার্থিব কামনার দিকে লালায়িত করে এবং সেই দিকেই নিয়ে যায়।নাফসের এই চাওয়াগুলোকে দুমড়েমুছড়ে পিষে দেয়ার নামই মৃত্যু। রুপ, সম্পদ, টাকাপয়সা মানুষের মধ্যে অদেখা এক শৃঙ্খল তৈরি করে। এই শৃঙ্খল তাকে আরো অনেকে শৃঙ্খলের মধ্যে আবদ্ধ করে ফেলে । এ থেকে মুক্তির জন্য মানুষ তার নিজের মৃত্যুকে স্বাদর সম্ভাষণ জানাতেই হবে। এক্ষেত্রে তাকে নিজেকে আল্লাহর কাছে সঁপে দিতে হবে।
একজন মৃতের ক্ষেত্রে কি হয়। সে নিজে কিছুই করতে পারে না। তাকে গোসল দেয়া হয়, কাফন পড়ানো হয় কিন্তু সে নিজের ইচ্ছেতে নয় বরং বাইরের কারো ইচ্ছেমত কাজ করে। তেমনি একজন মানুষ যখন নিজেকে রবের দরবারে সমর্পণ করে তখন তার নিজের বলতে কিছু থাকে না। আল্লাহর সিদ্ধান্তই তার সিদ্ধান্তে রুপ নেয়। আল্লাহ যখন যেভাবে যেমন চান সে নিজেকে তেমনি ভাবে উপস্থাপন করে। যেমন, আজকাল আমরা সমাজের বিভিন্ন রীতি, নিয়মের খাঁচায় আটকা পড়ে গেছি। সমাজের ছাঁচে নিজেকে সাজাতে ব্যস্ত হয় যাই। এক্ষেত্রে সমাজের চাহিদা মত নিজেকে না দেখাতে পারলে মনে হয় সমাজ আমাদের গ্রহণ করছে না। কিন্তু যদি আপনি আল্লাহর দিকে নিজেকে রুজু করে রাখেন এবং সকল ক্ষেত্রে তার কাছে লুটিয়ে পড়েন, তার নির্দেশনা অনুযায়ী নিজেকে বিলিয়ে দেন তাহলে এসবকে থোড়াই কেয়ার করার মন মানসিকতা আপনার মধ্যে তৈরি হবে যা আপনাকে সত্যিকার মুক্তি দেবে।