মদীনায় আমাদের অবস্থানের সময় তুলনামূলক কম- ৭ দিন মাত্র। স্বভাবতই যেকোনো রাসূলপ্রেমিকের কাছে এটি একেবারেই ‘অযথেষ্ট’। মদীনা প্রতিটি মুসলিমের প্রাণের স্পন্দন এবং হৃদয়ের গহীনে লুকিয়ে থাকা এক আবেগ। এই আবেগের তাড়নায় ৭ দিন যে কীভাবে চলে যায় বোঝাই যায় না। এর মধ্যেই আমাদের যিয়ারার প্রস্তুতি শুরু হল। এখানে বলে রাখা ভাল- মক্কা হোক কিংবা মদীনা, এজেন্সির যিয়ারাহ মানে বাসে করে ‘ঐ দেখা যায় তালগাছ’ টাইপের ঘোরাঘুরি। মন খুলে সময় নিয়ে কোথাও অবস্থান করতে পারবেন না কিংবা সংশ্লিষ্ট জায়গার ইতিহাস জানা না থাকলে নতুন করে খুব বেশি জেনে নেওয়ার সুযোগ থাকবে না। এখানে ইতিহাস বলতে ভৌগোলিক ইতিহাস না বরং নববি ইতিহাস বুঝাচ্ছি। অর্থাৎ ঐ জায়গার সাথে নবীজি ও সাহাবীদের কী স্মৃতি ছিল সেটা জানা। তাই বায়তুল্লাহর মুসাফিরদের প্রতি আমার পরামর্শ- হজ যাত্রার পূর্বেই এজেন্সি থেকে জেনে নিবেন আপনাদেরকে কোথায় কোথায় ঘুরানো হবে এবং ঐ জায়গাগুলির ‘নববি ইতিহাস’ সীরাতের কোনো কিতাব থেকে দেখে নিবেন।
মসজিদে নববী থেকে খুব কাছের একটি জায়গা হল মসজিদে কুবা। আমাদের কাফেলার কিছু ভাই ছিলেন যারা পরিবার ছাড়া একা গিয়েছিলেন। তারা দলবেঁধে প্রতিদিন ফজরের পর মসজিদে নববির ‘কুবা গেট’ থেকে জনপ্রতি ২ রিয়ালের মাইক্রোবাসে করে মসজিদে কুবা চলে যেতেন, সেখান থেকে সকাল ৯টার দিকে হোটেলে ফিরে নাস্তা করতেন। রুটিনটা আমার দারুণ মনে ধরেছিল, যদিও কিছু কারণে দৈনিক কুবায় যাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি। আপনাদের যাদের পক্ষে সম্ভব হবে, আপনারা এজেন্সির বাসে করে কুবা যাওয়ার আশায় বসে না থেকে (তাদের সাথে এমনিতেই যাবেন, তাই নিজেরা এক্সট্রা আরও কয়েকবার গেলে মন্দ কী?) নিজেরাই দল বেঁধে কিংবা একা প্রতিদিন একবার কুবা চলে যেতে পারেন। এখানে মসজিদে কুবার ‘নববি ইতিহাস’ কিছুটা বলে রাখার তাড়না অনুভব করছি।
আল্লাহর পক্ষ থেকে হিজরতের নির্দেশ আসলে আবু বকর রা: কে সাথে নিয়ে রাসূল ﷺ নবুওয়াতের চতুর্দশ বছরের ৮ই রবিউল আউয়াল সোমবার কুবায় পৌঁছলেন। মদিনার মুসলিমরা মক্কা থেকে রাসূল ﷺ এর রওনা হওয়ার সংবাদ শুনেছিলেন। এজন্য তারা প্রতিদিন সকালে বের হয়ে রাসূল ﷺ এর জন্য পথ চেয়ে অপেক্ষা করতেন। অবশেষে দুপুরের রোদ যখন প্রখর হয়ে উঠত তখন তারা হতাশ হয়ে ঘরে ফিরতেন। একদিন এমন দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর যখন মুসলিমগণ ঘরে ফিরে এলেন তখন এক ইহুদি তার কোন এক কাজে একটা টিলার উপর উঠলে রাসূল ﷺ এবং তার সঙ্গীদের দেখতে পায়। এই অবস্থা দেখে সে আত্মহারা হয়ে উচ্চকণ্ঠে বলে ওঠে, “ওগো কায়লার সন্তানেরা! তোমাদের ভাগ্য সুপ্রসন্ন হয়েছে। তোমাদের বহু আকাঙ্ক্ষিত অতিথি ওই যে এসে গেছেন” (কায়লা ছিল ইয়াসরিবের এক মহিলার নাম। আওস ও খাজরাজ উভয়ই তার সন্তান/বংশধর। তাই সমগ্র মদিনাবাসীকে কায়লার সন্তান/বংশধর বলা হত)। একথা শুনেই মুসলিমগণ দৌড়ে দিলেন এবং অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে রাসূল ﷺ কে স্বাগত জানানোর জন্য এগিয়ে এলেন। এর মধ্যেই কুবার অধিবাসীদের মধ্যে শোরগোল শুরু হয়ে গেল এবং উচ্চস্বরে তাকবীর ধ্বনি শোনা গেল। মুসলিমগণ রাসূল ﷺ এর আগমনে তাঁকে খোশ আমদেদ জানানোর জন্য তাকবীর দিতে দিতে একত্রিত হলেন এবং রাসূল ﷺ এর চারদিকে ঘিরে দাঁড়ালেন।
লোকজন প্রথমে আবু বকরকে আল্লাহর রাসূল ভেবে ভুল করেছিল কারণ আবু বকরের চেহারায় বার্ধক্যের ছাপ ছিল কিন্তু সূর্যের তাপ প্রখর হয়ে উঠলে আবু বকর যখন নিজের চাদর মেলে ধরে রাসূল ﷺ এর মাথার উপরে ছায়া দিলেন তখন লোকেরা রাসূলুল্লাহ ﷺ কে চিনতে পারল। এই দিন মদিনায় এমন এক আনন্দের দিন ছিল যা ইতিহাসে মদিনাবাসী আর কখনো দেখেনি।
লোকজনের সাথে সাক্ষাত হবার পর রাসূল ﷺ আমর বিন আওফ গোত্রের সর্দার ও খ্যাতিমান ব্যক্তি কুলসুম বিন হাদামের বাড়িতে উঠলেন। সেখানে রাসূল ﷺ চার দিন অবস্থান করেন এবং এই সময়ের মধ্যেই তিনি একটি মসজিদের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করলেন এবং সেখানে সাহাবিদের নিয়ে সালাত আদায় করলেন। রাসূল ﷺ এর নবুওয়াতের পর এটা হচ্ছে মুসলিমদের স্থাপিত সর্বপ্রথম মসজিদ। এই মসজিদই হল বর্তমানের ‘মসজিদে কুবা’ যার কথা আমরা এই পর্বে বলছি।
এই মসজিদ সম্পর্কে আল্লাহ সূরা তাওবার ১০৮ নং আয়াত নাযিল করেছেন। এই আয়াতে আল্লাহ বলেন-
لاَ تَقُمْ فِيهِ أَبَدًا لَّمَسْجِدٌ أُسِّسَ عَلَى التَّقْوَى مِنْ أَوَّلِ يَوْمٍ أَحَقُّ أَن تَقُومَ فِيهِ فِيهِ رِجَالٌ يُحِبُّونَ أَن يَتَطَهَّرُواْ وَاللّهُ يُحِبُّ الْمُطَّهِّرِينَ
অর্থ: তুমি কখনো সেখানে দাঁড়াবে না, তবে যে মসজিদের ভিত্তি রাখা হয়েছে তাকওয়ার উপর প্রথম দিন থেকে, সেটিই তোমার দাঁড়াবার যোগ্য স্থান। সেখানে রয়েছে এমন লোক, যারা পবিত্রতাকে ভালবাসে। আর আল্লাহ পবিত্র লোকদের ভালবাসেন। (সূরা তাওবাহ, ৯:১০৮)
আয়াতটি নাযিল হওয়ার পর রাসূল ﷺ কুবার লোকদেরকে জিজ্ঞেস করলেন, “তোমরা কেমনভাবে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হও? আল্লাহ তার প্রশংসা করেছেন”। তখন তারা জবাবে বলল, “হে আল্লাহর রাসূল! আমরা পরিষ্কার হওয়ার জন্য ঢিলা ব্যবহার করার পর পানি ব্যবহার করি। হতে পারে আমাদের এই কাজটি আল্লাহ পছন্দ করেছেন”। রাসূল ﷺ বললেন, “হ্যাঁ, আল্লাহ এটি পছন্দ করেছেন। তোমরা এই কাজটি করতে থাকো এবং কখনো ছেড়ো না”।
বুখারী ও মুসলিমে আব্দুল্লাহ ইবনে উমার রা: থেকে বর্ণিত হয়েছে, রাসূল ﷺ প্রতি শনিবার মসজিদে কুবায় উপস্থিত হতেন। তিনি কখনো হেঁটে আবার কখনো বাহনে এসেছেন। এখানে এসে তিনি মসজিদে দু’রাকাত সালাত আদায় করতেন”।
বছরব্যাপী উমরা যাত্রীরা ছাড়াও প্রচুর সংখ্যক লোকাল মানুষ মসজিদে কুবায় আসেন সালাত আদায় করতে, বিশেষত শনিবারে। এখানে এসে সালাত আদায় করে অনেকেই দীর্ঘক্ষণ দূয়া-মুনাজাতে রত থাকেন। অদ্ভূত এক প্রশান্তি মেলে এখানে। আর কেনইবা মিলবে না, এ যে মুসলিমদের নির্মিত প্রথম মসজিদ, এই মসজিদের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছেন স্বয়ং আল্লাহর রাসূল সা:, আবু বকর এবং উমার রা:।
যা বলছিলাম, মদীনায় সিঙ্গেল ভাইদের একটি গ্রুপ প্রতিদিন সকালে কুবায় চলে যেতেন আর আমি ফজরের সালাতের পর কিছুক্ষণ মসজিদে নববী প্রাঙ্গনে বসে থেকে চলে যেতাম বাকী কবরস্থানে। পরে আমি ঠিক করি, ইনশা আল্লাহ ভবিষ্যতে যদি আবারও মদীনায় আল্লাহ আমাকে নেন তবে বাদ ফজর বাকী যিয়ারত এবং এরপর কুবায় গমন হবে আমার দৈনন্দিনের রুটিন। যাই হোক, ২০১৮ তে গিয়ে দেখেছিলাম উন্মুক্তভাবে কবরস্থানের বাউণ্ডারির ভেতর সব জায়গায় যাওয়া যায় এবং কোনো রেস্ট্রিকশন নেই। কিন্তু ২০২৩ এ এসে অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম সবাই এক লাইন করে ঢুকছে এবং ভেতরেও এক লাইনে হাঁটছে, ইচ্ছেমত সব জায়গায় যাওয়ার সুযোগ নেই। এমনকি বাকির ভেতরেও অনেক জায়গায় ব্যারিকেড দিয়ে আবার কোথাও কোথাও পুলিশ দাঁড়িয়ে থেকে যেতে বাধা দিচ্ছে। জানি না এর হেতু কী!
আমি লাইন ধরে হাঁটতে হাঁটতে মুখে আউড়াতে থাকতাম কবরস্থান যিয়ারতের দূয়া এবং সালাম দিতাম এখানে শুয়ে থাকা সাহাবায়ে কেরাম ও ইমামগণকে। প্রিয় নবীর স্ত্রীগণ, কত অসংখ্য সাহাবী, সাহাবীদের স্ত্রীগণ এবং পরবর্তী প্রজন্মের মহান ইমামদের অনেকে এখানে শুয়ে আছেন আর আমার মত অধম পাপীকে আল্লাহ এই যুগশ্রেষ্ঠ মানুষদের কবর যিয়ারতের সুযোগ দিয়েছেন- এই বিষয়টা মনে আসলেই চোখ বেয়ে ঝরঝর করে পানি চলে আসত। বাকীতে থাকাকালীন পুরোটা সময় তাই চোখ থাকত ভেজা আর মন থাকত বিষন্ন। আল্লাহর কাছে মনের গভীর থেকে শুধু দূয়া করতাম- আল্লাহ! আমার অন্তিম শয্যা তুমি এই মদীনায়, এই বাকীতেই করিও। মুসলিম উম্মাহর রত্নতুল্য সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ এই মানুষগুলোর সাথেই আমি শুয়ে থাকতে চাই ঐদিন পর্যন্ত- যেদিন এক ফুঁৎকারে সবাই কবর থেকে জেগে উঠবে। আমিও জেগে উঠতে চাই এই মানুষগুলোর সাথেই, মনের একান্ত চাওয়া- তাদের সাথেই হোক আমার হাশর নাশর। ইয়া রব, তুমি আমার চাওয়াকে পাওয়ায় পরিণত করিও। আমীন।