লিও টলস্টয়ের ছোটগল্প “How Much Land Does a Man Need”? হয়তো অনেকে পড়েছেন।

গল্পের প্রধান চরিত্র পেহম ছিল একজন কৃষক। সে মনে করতো তার যদি অনেক জমি থাকতো তাহলে তার আর কোন কিছু চাওয়ার থাকত না। এমনকি শয়তানকেও সে ভয় পেতনা।

এমতাবস্থায় ভ্রমণরত এক কৃষকের কাছ থেকে পাশের গ্রামে কিছু জমির সন্ধান পেল  যেখানে কৃষকদের চাষ করার জন্য বিনামূল্যে জমি দেওয়া হচ্ছিল । কিন্তু মানুষের যে চাওয়ার শেষ নাই। সে চিন্তা করলো আরো জমি পেলে তার আরো উপকার হত। বিভিন্ন জমিতে বিভিন্ন ধরণের ফসল ফলাদি উৎপাদন করার মোক্ষম সুযোগ পেত।

সে আরো কিছু জমির সন্ধান পেল যা তার বর্তমান জমিরও কয়েকগুণ।  কিন্তু এতেও তার তৃষ্ণা  যায় না। অধিক জমির প্রতি তীব্র আগ্রহ তাকে একপ্রকার মোহাচ্ছন্ন করে রাখল।

একসময় সে শুনল এমন এক এলাকার কথা যেখানে এক আশ্চর্য শর্তে মানুষকে জমি দেওয়া হচ্ছে। পেহম সেখানে গিয়ে জানতে পারল, মাত্র এক হাজার টাকার বিনিময়ে তাকে বিশাল জমি দেওয়া হবে। জমির পরিমাপ একটা ছোট্ট পাহাড়ের চূড়া হতে সকাল থেকে হাঁটা শুরু করে সূর্য ডোবার আগে যতটুকু এরিয়া সে ভ্রমণ করে আগের জায়গায় আসতে পারে ততটূকু। তবে একটা আপাত সহজ শর্ত জুড়ে দেয়া হল,সেটি হচ্ছে যদি সে সূর্য ডোবার আগে না আসতে পারে তাহলে তার টাকা এবং জমি দুটোই হারাবে। পেহম বেশ আশ্চর্য এবং একইসাথে লোভাতুর হল।

পরদিন পেহম পাহাড়ের চূড়া থেকে রওনা হল। দুপূর পর্যন্ত বিরাট একটা অংশ অর্ধবৃত্তাকার পথে অতিক্রম করল। সে চিন্তা করল সময় যখন আছে আরেকটু জায়গা নিজের কব্জায় আনলে মন্দ হয় না! এমন  চিন্তায় হাঁটতে হাঁটতে কখন যে বিকাল হয়ে গেল টেরই পায়নি। পেহম তড়িঘড়ি করে পাহাড়ের দিকে দৌড়াতে থাকল। ওদিকে সূর্য অস্ত যেতে আর বেশি বাকী নেই। সে দৌড়াচ্ছে তো দৌড়াচ্ছে।

 সূর্যের রক্তিম লাল বর্ণ ধারণ করল। পেহম কোনমতে পাহাড়ের পাদদেশে পৌঁছেছে। ক্লান্তিতে তার চোখ দুটো বন্ধ হয়ে আসছে। অতিকষ্টে কিভাবে যে পাহাড়ের চূড়ার উঠেছে সে নিজেও জানেনা। উঠেই সে পাহাড়ের গায়ে শুয়ে পড়েছে। বালিময় হয়ে আছে তার মুখখানি। ইতিমধ্যে সূর্য ডুবে গেছে। অন্যান্যরা দেখল পেহমের জীবন সূর্যও ডুবে গেছে ততক্ষণে। তাকে কবর দেয়ার জন্য ছয় ফিট দৈর্ঘ্যের কবর খোঁড়া হল।  একটা মানুষের জীবনে কতটুকু জায়গাইবা দরকার হয়?

মানুষ তার চাহিদার পরিসীমা জানেনা। তাই সে চাহিদার সীমানা দেয়ালের খুঁটিটিও পুঁততে পারেনা। যতই আগায়, মনে হয় সীমানাটা আরেকটু বড় হোক না! এই চাহিদা লোভ হয়ে বেলুনের মত ফুলতে থাকে। অনেকের ক্ষেত্রে ফুঁস করে ফেটে যায় কিংবা হারিয়ে যায় আকাশের নীলিমায়। আসলে কি হারিয়ে যায় নাকি পরিণতির দিকে এগিয়ে যায়। চাহিদার দৌরাত্ম মানুষকে কখনযে হারামের টানেলে ঢুঁকিয়ে নেয় তা মানুষ বুঝতেই পারে না। 

মানুষের এই ইনফিনিটি চাহিদার কথাই রাসূল বলে গিয়েছেন খুব সুন্দর উপমার ভাষায় ‘আদমসন্তানের যদি দুই উপত্যকা পরিমাণ স্বর্ণ থাকে, তাহলে সে কামনা করে- তার যদি আরেকটি উপত্যকা পরিমাণ স্বর্ণ থাকত! মাটি ছাড়া কোনো কিছুই তার মুখ পূর্ণ করতে পারবে না’! অর্থাৎ দিনশেষে উপরোক্ত গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র পেহমের মত ছয় ফিটের সংকীর্ণ কবর।

ইসলাম আপনাকে হালাল উপায়ে আয় উপার্জনের নিষেধ করেনি। তবে প্রয়োজন অনুপাতে আয়োজন। প্রয়োজন বুঝে হালাল উপার্জন করতেই হবে। কিন্তু কখনো কখনো দেখা যায় প্রয়োজন ছাড়িয়ে অধিক কিছুর সংযোজন জীবনটাকে সংগ্রামমুখর করে তোলে। নীড’কে ছাড়িয়ে গ্রীড ফুলে ফেঁপে উঠে। এমন অনেকেই আছে তারা সময়কে তাদের মেধা এবং শ্রমের মেশিনে দিয়ে টাকা উৎপাদন করতে পারে। কিন্তু এই উৎপাদনের সীমারেখা জানেনা বলে প্রায়োরিটি নির্ধারণে ব্যর্থ হয়ে অপাত্রে সময় দিয়ে যায়, প্রিয়রা হয় বঞ্চিত। সম্পর্কেগুলোতে পর্যাপ্ত পানি সিঞ্চিত করা যায় না।

অনেকে চাইলে এই দুনিয়া থেকে অনেক কিছু তুলে নিতে পারবেন। কিন্তু আপনি কতটুকু তুলবেন? রাসূল কি আব্বাস রাঃ এর সাথে এ ঘটনায় তেমন কোন জীবন দর্শনের ইঙ্গিত দিলেন?

একবার আব্বাস (রাঃ) রাসূলের কাছে কিছু চাইলেন। বদরে নিজের এবং ভাইপো’র জন্য মুক্তিপণ দিয়ে তিনি বেশ আর্থিক অসচ্ছলতায় ভুগছিলেন।

রাসূল তাকে বললেন- নাও। আব্বাস (রাঃ) যত পেরেছেন তার কাপড়ে বেঁধে নিতে লাগলেন। রাসূল তাকে বাধা দিলেননা। তিনি যখন তা কাঁধে উঠাতে যাবেন আর উঠাতে পারছিলেন না। রাসূলকে বললেন- হে রাসূল কাউকে বলুন যেন আমাকে  সাহায্য করে। রাসূল না সূচক জবাব দিলেন। আব্বাস বললেন তাহলে আপনি তা তুলতে সাহায্য করুন। রাসূল আবারো না সূচক ভংগিতে মাথা নাড়লেন।

এরপর আব্বাস তাঁর কাপড়ের মধ্য থেকে কিছু কমিয়ে আবার  উঠানোর চেষ্টা করলেন। পূর্বের মত ব্যর্থ হয়ে রাসূলকে উদ্দেশ্য করে বললেন- হে রাসূল কাউকে বলুন আমাকে যেন সাহায্য করে। রাসূল বললেন- না। অতঃপর আগের মত রাসূলের নিকট সাহায্য চাইলে তিনি প্রিয় চাচাকে আবার না বলেন।

সবশেষে আব্বাস আরও কিছু জিনিস কমিয়ে নিজে নিজে কাঁধে উঠাতে সমর্থ হন এবং তা নিয়ে বাসস্থান অভিমুখে হাঁটা ধরেন।

ঘটনাটিতে রাসূল তাঁর অনুসারীদের জন্য বেশ সূক্ষ্ম নির্দেশনা রেখে যান বলেই আমার মনে হয়।

অতিরিক্ত চাহিদায় পেহমের মত জীবনকে হুমকীর মুখে ফেলা নয় কিংবা আব্বাস (রাঃ) মত জীবনকে কষ্টের মুখে ফেলা নয়। বরং প্রয়োজনের জায়গাগুলোকে যথাযথভাবে চিহ্নিত করে আগাম লাগাম ধরতে পারলে জীবনের ক্ষেত্রগুলোকে উপভোগ করা যায়। জীবন দার্শনিক বিশ্বনবী  সহজ ও প্রাঞ্জল ভাষায় বলেছেন-

হে লোকসকল! তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং উপার্জনে সহজতা অবলম্বন করো। জেনে রেখো, যতক্ষণ পর্যন্ত কেউ তার জন্যে নির্ধারিত রিজিক পূর্ণ না করে ততক্ষণ তার কিছুতেই মৃত্যু হবে না। একটু দেরিতে হলেও তা তার কাছে পৌঁছবেই। তাই আল্লাহকে ভয় করো। উপার্জনে সহজতা অবলম্বন করো। হালাল যতটুকু তা গ্রহণ করো আর যা কিছু হারাম তা বর্জন করো।

সমাধান দিচ্ছেন- হে লোকসকল! তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং উপার্জনে সহজতা অবলম্বন করো। জেনে রেখো, যতক্ষণ পর্যন্ত কেউ তার জন্যে নির্ধারিত রিজিক পূর্ণ না করে ততক্ষণ তার কিছুতেই মৃত্যু হবে না। একটু দেরিতে হলেও তা তার কাছে পৌঁছবেই। তাই আল্লাহকে ভয় করো। উপার্জনে সহজতা অবলম্বন করো। হালাল যতটুকু তা গ্রহণ করো আর যা কিছু হারাম তা বর্জন করো। -সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ২১৪৪

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *