শ্রেষ্ঠ হতে চাই

শ্রেষ্ঠ হওয়ার বাসনা মানুষের মধ্যে একটি সহজাত ব্যাপার হিসেবেই সৃষ্টিকর্তা নির্ধারন করে দিয়েছেন। মানুষ সবসময় নিজেকে ছাড়িয়ে যেতে চায়। কোন মানুষকে যদি তার চেয়ে শ্রেষ্ঠত্বের অবস্থান হাতছানি না দেয় তাহলে তার জীবনের চ্যালেঞ্জিং মনোভাব শেষ হয়ে যায়, হারিয়ে ফেলে কাজ করার উদ্যম। ছোটবেলা থেকেই একটা কথা শুনে আসছি । “মানুষ আশরাফুল মাখলুকাত” অর্থাৎ মানুষ সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব। মৌলভী থেকে শুরু করে সকল শ্রেনীর মানুষ এ কথাটি বলে থাকেন। আপাত দৃষ্টিতে কথাটিতে কোন সমস্যা নেই মনে হলেও, একদিন কোরআন পড়তে গিয়ে আমি ব্যাপারটি নিয়ে কিছুট সন্দিহান হয়ে পড়ি। সূরা বায়্যিনাহ পড়ার সময় আমার সমস্যার শুরু।আল্লাহ এ সুরায় বলছেন-

“অন্যদিকে যারা ঈমান এনেছে ও সৎকর্ম করেছে তারাই সৃষ্টিকুলের মধ্যে শ্রেষ্ঠ” । (সূরা বায়্যিনাহ-৭)

এ আয়াতে আল্লাহ সৃষ্টির সেরা হওয়ার দুইটা বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করেছেন। এ আয়াত পড়ার পর আমি দু একজন বড় ইসলামিক স্কলারের সাথে কথা বলি। তাদের কাছে জানতে চাই কোরান কিংবা হাদীসের কোথাও কি লেখা আছে মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব? আমি কোনো জবাব পাইনি। কারো দৃষ্টিগোচর হলে আমাকে জানাবেন। এ আয়াত দ্বারা বুঝা যায় সকলকে গড়পরতা সমান করা যাবে না, বরং তারাই সেরা যাদের মধ্যে এ দুটি বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান। ঈমান ও সৎকর্ম। দুটি জিনিস খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আল্লাহ বিভিন্ন জায়গায় মানুষের মুক্তির জন্য এ দুটি বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করেছেন। যেমন আল্লাহ কোরানে সূরা তীনে মানুষের সর্বনিম্ন অবস্থান জানানোর পর এ দুটি বৈশ্যিষ্টের মানুষকে সে অবস্থান থেকে অব্যাহতি দিয়েছেন। অপর দিকে আপনি যদি সূরা আসর পড়েন তাহলে সেখানেও দেখবেন যে চারটি বৈশিষ্ট্যের মানুষকে আল্লাহ ধবংসের সম্মুখীন হবে না বলে ঘোষনা দিয়েছেন তার মধ্যে দুটি বৈশিষ্ট্য এই ঈমান ও সৎকর্ম বা আমল। আল্লাহ যে সকল জিনিসের প্রতি ঈমান আনতে বলেছেন সেগুলো সবগুলোর প্রতি পরিপূর্ন ঈমান আনতে হবে। শুধুমাত্র আল্লাহ বিশ্বাসকে ঈমান বলে না। তাইতো আল্লাহ ঈমানদারদেরকে উদ্দেশ্য করে বলছেন-

“হে ঈমানদারগণ, আল্লাহর উপর পরিপূর্ণ বিশ্বাস স্থাপন কর এবং বিশ্বাস স্থাপন কর তাঁর রসূলও তাঁর কিতাবের উপর, যা তিনি নাযিল করেছেন স্বীয় রসূলের উপর এবং সেসমস্ত কিতাবের উপর, যেগুলো নাযিল করা হয়েছিল ইতিপূর্বে। যে আল্লাহর উপর, তাঁর ফেরেশতাদের উপর, তাঁর কিতাব সমূহের উপর এবং রসূলগণের উপর ও কিয়ামতদিনের উপর বিশ্বাস করবে না, সে পথভ্রষ্ট হয়ে বহু দূরে গিয়ে পড়বে”। (সূরা নিসা-১৩৬)

অপরদিকে আমল বা সৎকর্ম হচ্ছে ঈমানেরই বহিঃপ্রকাশ।আপনার ঈমান যত মজবুত হবে আপনার আমল ততোসুন্দর ও ততো অধিক হবে। ঈমান ও সৎকাজের সম্পর্ক বীজ ও বৃক্ষের মত।বীজ না থাকলে যেমন মাটি থেকে বৃক্ষ জন্মাতে পারেনা তেমনি বীজ থাকার পরও বৃক্ষ না জন্মানোর মানে হলো মাটির ভেতর বীজের সমাধি রচিত হয়েছে।ওই বীজ বৃক্ষ জন্মানোর জন্য পরিপুষ্ট নয়।তাই মানুষের মুক্তি ও শ্রেষ্ঠত্বের জন্য এ ঈমান ও আমলের উপস্থিতি অবশ্যম্ভাবী।

আল্লাহ কোরআনে বলেছেন-

“কিতাবীদের মধ্যে যারা কুফরী করে তারা এবং মুশরিকরা স্থায়ীভাবে নরকাগ্নির মধ্যে অবস্থান করবে তারাই সৃষ্টির অধম”। (সুরা বায়্যিনাহ-৬)

“তারা চতুষ্পদ জন্তুর মত; বরং তাদের চেয়েও নিকৃষ্টতর”। (সূরা আরাফ-১৭৯)

যারা আল্লাহ কে বিশ্বাস করেনা ও অমান্য করে তারা মুলত পশুর চেয়ে অধম।কারন পশুর বুদ্ধি,চিন্তা ও স্বাধীন কর্মশক্তি নেই,কিন্তু এদের এগুলো থাকার পরও আল্লাহকে অবিশ্বাস করে।

এসকল আয়াত পড়ার পর আমার মনে হয়েছে মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব এ কথাটি আসলে ঠিক না।কারন মানুষকে কিছু বৈশিষ্ট্যের অনুপস্থিতির জন্য আল্লাহ পশুর চেয়ে নিকৃষ্ট বলে আখ্যায়িত করেছেন। তাই বলা উচিত  যার ঈমান আছে ও সৎকর্ম করে সেই সৃষ্টির সেরা জীব। অন্য কথায় যে নিজের ইচ্ছাকে স্রষ্টার কাছে পুরোপুরি সঁপে দিয়ে ভাল কাজ করে সেই সৃষ্টির সেরা। রাম,সাম,যদু,মধু,সলিমুদ্দি, কলিমুদ্দি, টম,ডিক এন্ড হেরী সবাইকে একই বস্তায় ভরে সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ বলা ইসলামের জ্ঞান বিরোধী বলেই আমার মনে হয়। বরং আল্লাহর দেয়া বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতেই তাদের অবস্থান নির্ধারন করতে হবে।

২।

এ জিনিসটি একদিন এক ভাইকে বুঝালে তিনি উত্তর দিলেন- মানুষকে আশরাফুল মাখলুকাত বলা যায় এ অর্থে যে তার সৃষ্টি প্রক্রিয়া সবচেয়ে জটিল। ফলে সে অন্য সৃষ্টি থেকে আলাদা এবং এ জটিলতাই তার শ্রেষ্ঠত্বের কারন। এ কথা শুনার সাথে সাথে আমার কোরআনের অন্য একটি আয়াত মনে পড়ে গেল। আয়াতটি হল-

“মানুষের সৃষ্টি অপেক্ষা নভোমন্ডল ও ভূ-মন্ডলের সৃষ্টি কঠিনতর। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ বোঝে না”। (সূরা মুমিন-৫৭)

এ আয়াতে মানুষের চেয়ে  নভোমন্ডলের সৃষ্টিকে কঠিনতর বলছে।আয়াতটি তাকে শুনানোর পর আমি বললাম “আপনার  যুক্তি এ আয়াতের সাথে কিছুটা সাংঘর্ষিক বলে মনে হচ্ছে”। এটা শুনার পর তিনি আর কথা বললেন না।

৩।

মহানবী,বিশ্বনবী,ন্যায়বিচারের প্রতিষ্ঠাতা,মানবতার ধারক ও বাহক মুহাম্মদ (সঃ)কে আল্লাহ আমাদের জন্য অনুসরনীয় আদর্শ হিসেবে সৃষ্টি করেছেন।আল্লাহর আদেশ যেমন মানতে হবে তেমনি নবীর আদেশ মানা ও আমাদের জন্য ফরয।আল্লাহ কোরআনে যতস্থানে  তাঁর অনুসরন করার কথা বলেছেন সাথে সাথে নবীকেও অনুসরন করার কথা বলেছেন।কোরানের বিভিন্ন স্থানে আল্লাহ “আতিউল্লাহ ওয়া আতিউর রাসুল” কথাটি বলেছেন।কোথাও শুধু আতিউল্লাহ অর্থাৎ “আল্লাহকে অনুসরন কর” বলেননি।নবীকে সর্বোচ্চ সম্মানে সম্মানিত করেছেন।আল্লাহ কোরানে বলেন-

“যারা আল্লাহ ও শেষ দিবসের আশা রাখে এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণ করে, তাদের জন্যে রসূলুল্লাহর মধ্যে উত্তম নমুনা রয়েছে”। (সূরা আহযাব-২১)

“আপনি অবশ্যই মহান চরিত্রের অধিকারী”। (সূরা কালাম-৪)

তাই নবী (সঃ) হলেন ১০০% শ্রেষ্ঠ মানব, শ্রেষ্ঠ মুসলিম।১০০% সুন্দর চরিত্রের মানব।মানব শ্রেষ্ঠত্ব পরিমাপের জন্য তিনিই হলেন স্কেল। আমাদের দ্বারা কখনও ১০০% হওয়া সম্ভব নয়।তাই বলে নবীকে অনুসরন আনা করে আমরা বসে থাকব?না। এ শ্রেষ্ঠত্বের মঞ্জিলের দিকে আল্লাহ সকলকে দৌড়াতে বলেছেন।তাই আল্লাহর আদেশ অনুযায়ী নবী (সঃ) কে অনুসরন করে যেতে হবে। এ দৌড়ে যারা সবচেয়ে এগিয়ে ছিলেন তারা হলেন সাহাবারা।আমরা যে যতবেশি তাঁকে অনুসরন করব ততবেশি এ শ্রেষ্ঠত্বের দৌড়ে এগিয়ে থাকব। যেহেতু আমাদের ক্ষেত্রে কখনও এটা পুরোপুরি অর্জন করা সম্ভব নয় তাই আমাদের এ চেষ্টা কখনও থামবে না,আমাদের উদ্যম কখনো কমবে না।আমৃত্যু আমরা পূর্ন উদ্যমে আমাদের এ প্রতিযোগিতা করে যাব।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *