সত্যিকার গুরাবা

ইন্টার্নি হোস্টেলে এক বিকেলে রুম্মেটের সাথে গল্প করছি, লম্বা করে এক নিক্বাবী মহিলা দু’হাতে আপেল-কমলার ঠোঙাসহ কাকে যেন খুজতে খুজতে আমাদের দরজায় এসে থামলেন।
– নিশাত নামে কেউ থাকে এখানে?
– জ্বি আপু, আমি। আপনি…..!!
– আমাকে তুমি চিনবে না। কিন্তু আমি তোমাকে অনেক অনেকদিন ধরে খুজছি। তোমার কাছে একটা আবদার নিয়ে এসেছি, আশা করি ফেরাবে না…

তারপর আপুর সাথে অনেক কথা হলো। উনি আমাদের সিনিয়র একজন ডক্টর, বাবা-মাও ডক্টর। উনার আশেপাশে কেউই দ্বীনের পথে নেই, আল্লাহ তা’আলা কোন এক মাধ্যমে উনাকে হেদায়াতের আলো চিনিয়েছেন। প্রচন্ডরকম সাজগুজে প্রকৃতির ছিলেন একসময়, এখন আল্লাহর জন্যই নিজেকে বদলাচ্ছেন, পায়ে একটা মল এখনও পরেন, ভালো লাগে তাই। হিজাব থেকে নিক্বাবও শুরু করেছেন, দ্বীনের পথে আরও এগোনোর চেষ্টায় আছেন। আমাকে বলেছিলেন, উনি জাপান যাপেন পোস্টগ্রাড করতে, সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন। কিন্তু উনি বিবাহিত না, মাহরাম নেই। আবার ওখানে গিয়ে নিক্বাবে সমস্যা হবে কিনা, এসব নিয়ে একটু কনফিউজড। আমি বলেছিলাম, আল্লাহর কাছে দু’আ করুন, যেটা আপনার জন্য উত্তম তিনি যেন সেটাই ফায়সালা করেন।

আপু একাকী থাকতে পছন্দ করেন, অনেকটা জগৎসংসার এড়িয়েই চলেন। তাকে ফোনেও পাওয়া যায়না, মেসেজেও না৷ ধুম করে চার-পাচ মাস পার হয়ে যায়, আবার হঠাৎ একটা নতুন নাম্বার থেকে ফোন আসে।
– নিশাত, তুমি কত নং ওয়ার্ডে আছো? আমি আশেপাশেই। একটু কি সময় হবে তোমার? আমি খুব অল্প সময় নেবো তোমার…

প্রতিবার চলে যাওয়ার পর আমি আনমনে ভাবি: আল্লাহর দুনিয়ায় কত কিসিমের মানুষ! জুনিয়রের সাথে এতখানি কার্টিয়াসও কেউ হয়! হেদায়াতের জন্য এতটা ব্যাকুল কোন হৃদয়!

আপুর একটা আবদার আমি রাখতে পারিনি, শরীরের অবস্থা শেষদিকে এত খারাপ হয়ে গেলো। লজ্জায় ফোন দেয়াও হয়না, আর দেবোই বা কাকে? উনি যে উধাও মানবী!

যাহোক, ঢাকা আসার বছরখানেক পার হয়ে গেলো। আজ বিকেলে আবার হঠাৎ আননোন নাম্বার থেকে ফোন:

– নিশাত, কেমন আছো? তোমার মেয়েটা কেমন আছে? একটা বিষয় জানার জন্য ফোন দিয়েছিলাম তোমাকে। তার আগে আরেকটা কথা বলে নিই, তুমি হয়তো জানোনা, তোমার সাথে দেখা করার পর আমার অনেক বড় দুটো পরিবর্তন হয়েছে। আমি কালো বোরখা পরা শুরু করেছি। আর জাপান যাওয়ার সিদ্ধান্তটা বাতিল করেছি। জানো, কিভাবে? আমার মনে হয়েছে, আমি হয়তো এমন রংচঙ ছাড়া বোরখা বেছে নিতে পারছিনা, আমি হয়তো নিক্বাব নিয়ে সমস্যা হবে জেনেও জাপান যেতে চাইছি। কিন্তু আমার সমসাময়িক সময়েই পৃথিবীতে অনেক মানুষ আছে যারা এই কাজগুলো আল্লাহর জন্য করতে পারছে, ছাড়তে পারছে। তাহলে আমি আল্লাহর কাছে কিভাবে দোহাই দেবো যে, এই কাজটা আমার জন্য অসম্ভব ছিলো? অথবা আমার আশেপাশে কাউকে করতে দেখিনি? আমার জন্য দু’আ কোরো, নিশাত।

ফোনটা রেখে দেয়ার পর শুধু একটাই কথা মাথায় এলো: সুবহানাল্লাহ! আত্মসমর্পণের সংজ্ঞা বোধহয় এই, আনুগত্যের সত্যিকার সৌন্দর্য বোধহয় এখানেই। অথচ এই আমরা, আল্লাহর দেয়া একটা বিধান মানতে না পারলে কত ধরণের যুক্তিতর্ক খুজতে শুরু করে দিই, সুস্পষ্ট নুসূসের বিরুদ্ধে গিয়ে হলেও নফসের খাহেশাত পূরণ করতে সচেষ্ট হয়ে যাই। অথচ এই মানুষগুলো? সমাজের কেউ চেনেনা, জানেনা, অথচ ভেতরে তেজোদীপ্ত ঈমান, ‘গুরাবা’ বোধহয় এরাই…..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *