সুন্নাতের অনুসরণ ও বিদ’আতের বিসর্জন

আর রহমান ও আর রহিম আল্লাহর নামে

শিরকের মাধ্যমে যেমন তাওহীদ বিনষ্ট হয়, আল্লাহ-র আনুগত্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তেমনি বিদায়াত এর মাধ্যমে সুন্নাত বিনষ্ট হয়, রাসূলের (স) আনুগত্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়। শিরক করলে যেমন পূর্বের নেক আমল নষ্ট হয়ে যায় তেমনি বিদায়াত করলে সামনের নেক আমল কবুল হয়না। তাই বিদায়াত সম্পর্কে আমাদের স্বচ্ছ ধারণা থাকা দরকার, আর বিদায়াত কে পরিপুর্ণভাবে চিনতে হলে আগে চিনতে হবে সুন্নাতকে।   

আমরা ‘সুন্নাত’ শব্দের অর্থগত বিশ্লেষন না করে সুন্নাত বলতে আমরা সাধারণত যা বুঝে থাকি তাই আলোচনা করব। সুন্নাত বলতে আমরা সাধারণত বুঝে থাকি ‘সুন্নাতে নববী’ বা রাসুলুল্লাহ-র সুন্নাত। এখানে আমরা সুন্নাতে নববী সম্পর্কে একটা পরিষ্কার ধারণা নেয়ার পরেই পর্যায়ক্রমে ‘সুন্নাতে সাহাবা’ ও ‘সুন্নাতে খুলাফা’ সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করব ইনশাআল্লাহ।

হাদীস শাস্ত্রে সুন্নাত শব্দটি মুলতঃ সুন্নাতে নববী অর্থেই ব্যবহার করা হয়।  রাসূল (স) এর সকল কথা, কাজ ও অনুমোদনই হাদীস শাস্ত্রের পরিভাষায় সুন্নাত তথা সুন্নাতে নববী। সাহাবী ও তাবেঈন দের যুগে সুন্নাত বলতে এই অর্থই বুঝাত। এ অর্থে ফরয, ওয়াজিব, নফল, মুবাহ সবই সুন্নাতের অন্তর্ভুক্ত। তাই সুন্নাতে মুহাম্মাদী বলতে মুলত শরীয়াতে মুহাম্মাদী ই বুঝায়। বহু সংখ্যক হাদীস থেকে স্পষ্ট বুঝা যায় যে সাহাবীগণ রাসূলুল্লাহ এর সমস্থ কাজকে সুন্নাত বলে জেনেছেন, মেনেছেন। তাঁরা কখনো গুরুত্বের পার্থক্য করেননি। তাঁদের কাছে সমগ্র শরীয়াতই ছিল সুন্নাত তথা সুন্নাতে নববী। খুব সহজে তাই সুন্নাতের সংজ্ঞা এভাবে দেয়া যায়-

রাসূল(স) কোন কাজ যে পদ্ধতিতে, যে পরিমাণে, যতটুকু গুরুত্ব দিয়ে, যে সময়ে ও যে ক্ষেত্রে  করেছেন সেই কাজকে সেই পদ্ধতিতে, সেই পরিমাণে, ততটুকু গুরুত্ব দিয়ে, সেই সময়ে ও সেই ক্ষেত্রে  সম্পাদন করা বা বর্জন করাই হল সুন্নাতে নববী।

আর এর কোন রকম ব্যাতিক্রম করাই হল খেলাফে সুন্নাত। খেলাফে সুন্নাত ব্যাক্তিগত সুবিধা, অসুবিধা বা আনুষঙ্গিক কোন কারণে হলে ক্ষেত্রবিশেষে জায়েয, মুবাহ আবার গুনাহ-র কাজ হতে পারে। আবার যদি সাওয়াব এর উদ্দেশ্যে বা আল্লাহ-র নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে হয় তাহলে তা ‘সুন্নাত অপছন্দ’ করার পর্যায়ে পড়বে যা মুলতঃ বিদায়াত কারণ কস্মিনকালেও কেউ রাসূল(স) এর থেকে আল্লাহ-র বেশি নৈকট্য লাভ করতে পারে না আর তাই সুন্নাতের খেলাফ করে আল্লাহ-র নৈকট্য লাভের অর্থই হল নিজেকে রাসূলের অগ্রগণ্য মনে করা অথবা রাসূলের দিক-নির্দেশনা কে যথেষ্ট মনে না করা। আর আল্লাহ কুরআন এ বলেন-

“নিশ্চয়ই তোমাদের জন্যে রাসূলের জীবনেই রয়েছে সর্বোত্তম আদর্শ এমন প্রতিটি ব্যাক্তির জন্যে যে আল্লাহ তায়ালার সাক্ষাৎ পেতে আগ্রহী এবং পরকালের আশা করে, সর্বোপরি সে বেশি বেশি আল্লাহকে স্মরণ করে”। —(আহযাবঃ২১)—

কেউ যদি রাসূল (স) কে সর্বোত্তম আদর্শ হিসেবে দৃঢ়ভাবে মেনে নেয়ার পর ব্যাক্তিগত উদ্দীপনা, আলস্য বা শারীরিক অসুস্থতার জন্যে নফল রোযা মোটেও না রাখে, তাহাজ্জুদ মোটেও না পড়ে কিংবা হারাম দিন বাদে নিয়মিত রোযা রাখে বা সারারাত তাহাজ্জুদ পড়ে তবে তা না-জায়েয না হলেও সুন্নাতে খেলাফ কিন্তু এগুলো ‘সুন্নাত অপছন্দ’ করার পর্যায়ে পড়বে না।

এই হাদীসটি দেখা যাক- “আনাস ইবনু মালিক(রা) বলেন, “তিন ব্যাক্তি রাসুলুলাহ এর স্ত্রীগণের নিকট যেয়ে তাঁর ইবাদাত বন্দেগী সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করল। তাঁরা তাঁর ইবাদাত বন্দেগী সম্পর্কে জানালেন। মনে হল এই প্রশ্নকারী সাহাবীগণ রাসূল এর ইবাদাত-বন্দেগীকে কিছুটা কম ভাবলেন। তাঁরা বললেন, রাসূল এর সাথে কি আমাদের তুলনা হতে পারে ? আল্লাহ তাঁর পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সকল গুনাহ ক্ষমা করে   দিয়েছেন। তখন তাঁদের একজন বলল, আমি সর্বদা সারারাত জেগে নামায পড়ব। অন্যজন বললেন, আমি সর্বদা রোযা রাখব।, কখনই রোযা ভাংবো না। আরেজন বললেন, আমি কখনও বিবাহ করব না, আজীবন নারী সংসর্গ পরিত্যাগ করব রাসূল(স) এদের কথা জানতে পেরে বললেন, তোমরা এ কী ধরণের কথা বলছ ? তোমরা জেনে রাখ ! আমি তোমাদের সকলের চেয়ে আল্লাহকে বেশি ভয় করি, তাকওয়ার দিক থেকে আমি তোমাদের সবার উপরে অবস্থান করি। তা সত্ত্বেও আমি মাঝে মাঝে নফল রোযা রাখি আবার মাঝে মাঝে তা পরিত্যাগ করি। রাতে কিছু সময় তাহাজ্জুদ আদায় করি আবার কিছু সময় ঘুমাই। আমি বিবাহ করেছি, আমি স্ত্রীদেরকে সময় প্রদান করি। যে ব্যাক্তি আমার সুন্নাত অপছন্দ করল তার সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই। —(বুখারী;কিতাবুন নিকাহ-৫০৬৩)—

এটি থেকে বুঝা যায়, আবেগ বা উদ্দীপনাবশত আল্লাহ-র নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে সুন্নাতে নববী-র অতিরিক্ত কিছু স্থায়ীভাবে গ্রহণ বা বর্জন করা (যদিও তা জায়েয হয়) স্পস্টই বিদায়াত (তবে তাৎক্ষণিক ভাবে উদ্দীপনার মুহুর্তে কেউ সুন্নাতের অতিরিক্ত কিছু করলেও যদি তার স্থায়ী রীতি ও নিয়ম সুন্নাত সম্মত হয় তবে তিনি বিদায়াতী হবেন না); উপরের হাদীসগুলি থেকে পরিষ্কার হওয়া গেল যে প্রতিটি জাগতিক ও দ্বীনি কাজে রাসুল (স) এর হুবহু অনুসরনই হল সুন্নাতে নববির যথার্থ বাস্তবায়ন।

সুন্নাতে সাহাবাঃ 

নিঃসন্দেহে রাসূল (স) এর সুন্নাত বুঝা ও মানার ক্ষেত্রে সাহাবীগণ সবথেকে এগিয়ে। কিন্তু যেসব বিষয়ে সুন্নাতে নববীতে স্পষ্ট দলীল/নির্দেশনা নেই সেক্ষেত্রে ব্যাক্তিগতভাবে কোন একজন সাহাবীর কথা/কর্ম শারীয়াতের দলিল হিসেবে নেয়া যাবে কিনা তা নিয়ে ফকীহ ও ইমামগণের মধ্যে মতভেদ আছে। সাহাবীগণের ইজমা সর্বোত্তম ইজমা হিসেবে গণ্য হবে এ নিয়ে কারো কোন মতভেদ নেই। ইমাম শাফেঈ(রহিমাহুল্লাহ), ইমাম গাযালী(রহিমাহুল্লাহ) প্রমুখ বিদ্বান পণ্ডিতগণ অস্পষ্ট বিষয়ে সাহাবীদের কথা ও কাজকে অনুকরণীয় মনে করার ঘোর বিরোধীতা করেছেন। শাফেঈ আলেমগণের দাবি হল, সাহাবাগণ অন্যান্য মানুষের মতই মানুষ। তাঁদেরও ভুল হতে পারে। আবার ইমাম আবু হানিফা(রহিমাহুল্লাহ), আহমাদ বিন হাম্বল(রহিমাহুল্লাহ), ও তাঁদের অনুসারীগণ ও অন্যান্য অনেক আলেমগণের মতে, কোন বিষয়ে সকল সাহাবী ঐকমত্য পোষণ করলে বা কোন বিষয়ে কোন কোন সাহাবী কোন মত প্রকাশ করলে ও অন্যান্য সাহাবী তার বিরোধীতা না করলে ঐ সাহাবী/সাহাবীগণের মত অনুকরণীয় গণ্য হবে। তাঁদের দাবি, সাহাবীরা ভুলের ঊর্ধে না হলেও কুরআন ও হাদীসে তাঁদের পরিপূর্ণ মর্যাদার ঘোষণা আছে ও সুন্নাতে নববী বুঝা ও অনুসরণে তাঁরা অগ্রগণ্য। তাই তাঁদের বিশুদ্ধতার সম্ভাবনা বেশি।

এই বিষয়ে যথাসম্ভব সঠিক সিদ্ধান্ত হল, সাহাবীগণের সুন্নাত ও বিশেষ করে সুন্নাতে খুলাফা বা খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাত সুন্নাতে নববীর অংশ ও বাখ্যা হিসেবে গণ্য। এখানে আরো একটি কথা বলে রাখা প্রয়োজন যে রাসূলের বিশাল সংখ্যক সাহাবীর পক্ষে সর্বদা তাঁর সান্নিধ্যে থাকা সম্ভব ছিল না তাই তাঁদের অনেকেই অনেক সুন্নাতে নববী পরে জেনেছিলেন বা কেউ কেউ হয়ত জানেননি। তাই সুন্নাতে সাহাবা আমাদেরকে সুন্নাতে নববী বুঝতে সাহায্য করবে। এছাড়া সুন্নাতে নববীতে একাধিক বর্ণনা থাকলে এ বিষয়ে জানতে সাহায্য করবে সুন্নাতে সাহাবা। আল্লাহই সর্বাধিক ভাল জানেন।

সুন্নাতে সাহাবার কতিপয় দৃষ্টান্তঃ 

আব্দুল্লাহ ইবনে উমার ও অন্যান্য ২-১ জন সাহাবী কর্তৃক ১ মুষ্ঠি ধরে দাড়ি কেটে ফেলা, সুন্নাত নামায কখনো কখনো মাসজিদে আদায় করা এবং পূর্ববর্তি রাষ্ট্রপ্রধান কর্তৃক পরবর্তী রাষ্ট্রপ্রধান নির্ধারণ সুন্নাতে সাহাবার উদাহরণ।

সুন্নাতে খুলাফায়ে রাশেদিনঃ 

একটি হাদীস দেখা যাক-

“তোমরা আল্লাহকে ভয় কর। তোমাদের কর্তব্য হল শুনা ও আনুগত্য করা। তোমাদের মধ্য থেকে যারা বেঁচে থাকবে তারা অনেক মতভেদ দেখতে পাবে। তখন অবশ্য করণীয় হবে আমার এবং আমার খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাহর অনুসরণ করা। তোমরা তা দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরার মত শক্তভাবে আঁকড়ে ধরবে”। —(জামিউল বায়ান আল ইলম;২/১৮০)—

এখানে দেখা যায় রাসূল (স) আলাদাভাবে খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাতকে আঁকড়ে ধরতে বলেছেন। কেন শুধুমাত্র ‘খুলাফায়ে রাশেদীন’ এর উল্লেখ করা হল তা নিয়ে ওলামাদের মধ্যে ২ টি মত আছে-

১/ তাঁরা রাসূলের জীবনের শেষ পর্যন্ত তাঁর একান্ত সান্নিধ্যে ছিলেন। তাই ‘সুন্নাতে নববী’-র বাখ্যায় তাঁরা অধিক অগ্রণী ছিলেন।

২/ যুগে যুগে জাগতিক কর্মকাণ্ডের পরিবর্তনের সাথে সাথে মুসলিম সমাজে উদ্ভূত রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক সমস্যার সমাধান খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাতে পাওয়া যায়।

যুদ্ধবিগ্রহ, রাষ্ট্র পরিচালনা, সমাজের শান্তি ও  নিরাপত্তা, শৃংখলা বিধান, নতুন অপরাধ প্রবণতা ও তা দমন, শিষ্টের পালন ও দুষ্টের দমনে তারাই উম্মাতের অনুকরণীয় আদর্শ।

আল্লাহই এই ব্যাপারে সবচেয়ে ভাল জানেন।

সুন্নাতে খুলাফায়ে রাশেদিনের কিছু দৃষ্টান্তঃ 

যাকাত অস্বীকারকারীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা, কুরআন একত্রিত করে বাইণ্ডীং এর নির্দেশ ও হাদীস সংরক্ষণের জন্য বর্ণনার ক্ষেত্রে  সাক্ষী গ্রহণের নিয়ম প্রচলন সুন্নাতে আবি বাকর। হিজরী সাল গণনা শুরু, বিভিন্ন শহরে নিয়মিত কাজী ও বিচারক নিয়োগ, প্রশাসনে দফতর সৃষ্টি, ডাক ব্যাবস্থা চালু, অপরাধ দমনে সুন্নাতে নববীর আলোকে শাস্তির পরিমাপ নির্ধারণ ও জামায়াতের সাথে তারাবীহ আদায় সুন্নাতে উমার। কুরানের সংকলিত কপি বিভিন্ন রাষ্ট্রে প্রেরণ, জুমুয়ার দিনে প্রথম আযান প্রচলন ইত্যাদি সুন্নাতে ওসমান ও  কুরানে স্বরচিন্হ প্রদান সুন্নাতে আলী-র নমুনা।

উপরের আলোচনা থেকে আশা করি সুন্নাত সম্পর্কে কিছুটা পরিষ্কার ধারণা পাওয়া গেছে। এবার আমাদের ২য় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যা কিনা সুন্নাতের একেবারেই বিপরীত তা নিয়ে কিছু বলা যাক।

বিদায়াত শব্দের পরিচয়ঃ  

বিদায়াত শব্দের আভিধানিক অর্থ- ‘নতুন সৃষ্টি; যার কোন পূর্ব দৃষ্টান্ত ছিল না’; কিন্তু শুধু এই আভিধানিক অর্থই বিদায়াতের সাথে পরিচিত হওয়ার জন্য যথেষ্ট নয়। বিদায়াতকে পরিপূর্ণরূপে চিনতে হলে আমাদের জানতে হবে বিদায়াতের শার’ঈ অর্থ। শার’ঈ অর্থে পণ্ডিতগণ কম-বেশি প্রায় একই রকম সংজ্ঞা দিয়েছেন। সহজভাবে বলা যায়- ইসলামের ভিতর, আল্লাহর নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে বা সওয়াব হাসিলের জন্যে এমন কিছু করা যা রাসূল(স) করেননি, করতে বলেননি, কেউ করলেও তাকে সমর্থন করেননি এবং যা ইসলামের মূলনীতির (কুরআন ও সুন্নাতে নববী, সুন্নাতে সাহাবা এবং সুন্নাতে খুলাফায়ে রাশেদিন ও সলফে সালেহীন এর আমল) এর উপর প্রতিষ্ঠিত নয়।

প্রথম ২ টি শর্ত একটি আরেকটির সাথে জড়িত। মানুষ ইসলামের নামে যা করে তা মুলত আল্লাহর নৈকট্য হাসিলের জন্যেই করে আর আল্লাহর নৈকট্য হাসিলের  জন্য যা করে তা মুলতঃ ইসলামের নামেই করে। তাই প্রথম ২ টি শর্তের যে কোন একটি পূরণের পর পরের ৪ টি শর্তের যে কোন একটির সাথে মিলে গেলে বিদায়াত হবে না, কিন্তু ৪ টি শর্তের কোনটিই না মিললে তা বিদায়াত বলে গণ্য হবে।

উপরের শর্তগুলো থেকে সহজেই বিদায়াত চেনা যাবে। তবে বিদায়াত চেনার আরো কিছু মূলনীতি আছে। ডঃ মঞ্জুরে এলাহী তাঁর ‘বিদায়াত পরিচিতির মূলনীতি’ শীর্ষক বইয়ে বিদায়াত চেনার ১৫ টি মূলনীতি উল্লেখ করেছেন। সংক্ষেপে এগুলো হল-

১/ অতিরিক্ত দূর্বল, জাল বা মিথ্যা হাদীসের উপর ভিত্তি করে আমল করলে তা বিদায়াত বলে গণ্য হবে (যেমন- শবে মিরাজের রাতে বিশেষ ফযীলতের দোহাই দিয়ে বা শবে বরাতে ১০০ রাক্যাত সালাত বিশেষ নিয়মে আদায় করা বিদায়াত কারণ এই সঙ্ক্রান্ত হাদীসটি জাল ),

২/ শরীয়তের দলীল ছাড়া নিছক মনগড়া মতামতের উপর ভিত্তি করে কোন ইবাদাত করলে তা বিদায়াত হবে (যেমন- মুরাকাবা-মুশাহেদা কিংবা ‘বুজুর্গানে দ্বীন’ এর   স্বপ্নের বা কারামতের দোহাই দিয়ে নতুন ইবাদাত চালু করা),

৩/ কোন বাধা বিপত্তি ছাড়াই রাসূল (স) স্বেচ্ছায় যেসব আমল ও ইবাদাত (করা, বলা বা অনুমোদন দেয়া) থেকে বিরত থেকেছেন সেসব আমাল ও ইবাদাত করলে তা বিদায়াত হবে (যেমন- ৫ ওয়াক্ত ও জুমুয়ার সালাত ছাড়া অন্যান্য সালাতে আযান দেয়া, নামাজের শুরুতে মুখে নিয়ত উচ্চারণ করা ইত্যাদি),

৪/ সলফে সালেহীনদের কেউ কোন আমল না করলে বা নির্দেশনা না দিলে বা এ বিষয়ে কিছু লিপিবদ্ধ করে না গেলে পরবর্তী জমানার কেউ তা চালু করলে তা বিদায়াত হবে (যেমন- ঈদে মিলাদুন্নাবী, শবে বরাত, শবে মিরাজ উদযাপন ইত্যাদি),

৫/ যেসব ইবাদাত শরীয়তের মূলনীতি ও লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের বিপরীত সেগুলো সবই বিদায়াত (যেমন- ২ ঈদের সালাত ও জানাযার সালাতে আযান দেয়া কেননা আযান শুধু ফারয সালাতের সাথেই খাস ও জানাযার সালাতে সবার অংশগ্রহণ আবশ্যিক নয়, আযানের আগে মাইকে দরূদ পাঠ কারণ আযানের উদ্দেশ্য মানুষকে সালাতে আহবান করা, দরূদ পাঠের সাথে আযানের উদ্দেশ্যের কোন সম্পর্ক নেই),

৬/ প্রথা ও মু’আমালাত বিষয়ক কোন কাজে শরীয়তের নির্দেশনা ছাড়াই আল্লাহর নৈকট্য লাভের আশা করলে তা বিদায়াত হবে (এ বিষয়ে একটু পরেই আমরা কিছুটা বিস্তারিত আলোচনা করব ইনশাআল্লাহ),

৭/ যে সকল ইবাদাতের সময়, পদ্ধতি ও স্থান শরীয়াত নির্ধারিত করে দিয়েছে সেসবের সময়, পদ্ধতি ও স্থান কোন শরীয়তি দলিল ছাড়াই পরিবর্তন করে নিলে তা বিদায়াত হবে (যেমন- জিলহাজ্জ মাসের ১০ তারিখের পরিবর্তে ১ তারিখে কুরবানী করা, মাসজিদ ছাড়া অন্য কোথাও ইতিকাফ করা, দিনে ৬ ওয়াক্ত ফারয নামায আদায় করা ইত্যাদি),

৮/ আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (স) যে সকল কাজ নিষেধ করেছেন সেসব কাজের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য লাভের আশা করলে তা বিদায়াত হবে (যেমন- গান-বাদ্য ও নাচের মাধ্যমে যিকির করা ইত্যাদি),

৯/ কোন উন্মুক্ত ইবাদাতকে শরীয়তের দলীল ছাড়া কোন নির্দিষ্ট স্থান, কাল বা সংখ্যা দ্বারা সীমাবদ্ধ করলে তা বিদায়াত হবে (যেমন- কুরআন খতম বা নফল নামায বা সাদাকা করা সওয়াবের কাজ ও শরী‍য়ত এগুলোর জন্যে ধরাবাঁধা স্থান, কাল বা সংখ্যা দেয়নি কিন্তু কোন নির্দিষ্ট দিন বা সময়কে এসবের জন্যে নির্দিষ্ট করে নিলে ও তা নিয়মিত করতে থাকলে),

১০/ শরীয়াত অনুমোদিত পরিমাণের চেয়ে অতিরিক্ত বা বাড়াবাড়ি করে আল্লাহ-র নৈকট্য হাসিলের চেষ্টা করলে তা বিদায়াত হবে (যেমন- সারারাত জেগে তাহাজ্জুদ আদায় কে নিয়মিত আমাল বানিয়ে নিলে বা সারা বছর নিরবচ্ছিন্নভাবে রোযা রাখলে, এই ব্যাপারে সুন্নাহর পরিচিতি অংশে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে),

১১/ যেসকল আকীদা, মতামত ও বক্তব্য কুরআন ও সুন্নাহ বিরোধী অথবা সলফে সালেহীনদের ইজমার সাথে সাংঘর্ষিক সেসব বিদায়াত বলে গণ্য হবে (সহজভাবে বলা যায় কুরআন ও সুন্নাহর উপর নিজের মতামতকে অগ্রাধিকার দিয়ে কিছু করা যেমন-ভ্রান্ত ফির্কাগুলির আকীদা),

১২/ যেসব আকীদা কুরআন ও সুন্নাহ তে আসেনি কিংবা সাহাবায়ে কেরাম ও তাবেঈ, তাবা-তাবেঈ থেকে বর্ণিত হয়নি সেগুলো বিদাতী আকীদা হিসেবে গণ্য হবে (যেমন-সুফী তরিকা, পীরবাদ ইত্যাদি),

১৩/ দ্বীনের ব্যাপারে ঝগড়া, বিবাদ ও অহেতুক তর্ক এবং বাড়াবাড়ি প্রশ্ন বিদায়াত হিসেবে গণ্য হবে (যেমন- কুরানের মুতাশাবিহাত আয়াত গুলা নিয়ে অহেতুক বিতর্ক করা, আল্লাহর গূণাবলী সম্পর্কে অহেতুক প্রশ্ন করা যেমন- আল্লাহ কীভাবে আরশে সমাসীন হলেন ? ইত্যাদিও বিদায়াত। আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের আকীদা হল আল্লাহ-র গূনাবলি সম্পর্কে কুরআন ও হাদীসে যা এসেছে ঠিক সেভাবেই মেনে নিতে হবে, এই ব্যাপারে নিজে থেকে কল্পনাপ্রসূত কোন মত বা বাখ্যা দেয়া যাবে না বা অহেতুক প্রশ্ন করা যাবে না),

১৪/ দ্বীনের স্থায়ী ও প্রমাণিত অবস্থান এবং শরীয়াত কর্তৃক নির্ধারিত সীমারেখা পরিবর্তন করা বিদায়াত (যেমন- চুরি, ব্যাভিচার কিংবা যিহারের শরীয়াত নির্ধারিত শাস্তি পরিবর্তন করা),

১৫/ অমুসলিমদের মধ্যে খাস যে সকল প্রথা চালু রয়েছে মুসলিমদের মধ্যে সেগুলো চালু করা ও পালন করা বিদায়াত (যেমন- জন্ম উৎসব, নববর্ষ উৎসব  ইত্যাদি পালন করা)

বিদায়াতের শ্রেণিবিভাগ সঙ্ক্রান্ত বহুল আলোচিত ভ্রান্তির অপনোদনঃ 

বিদায়াতকে সাধারণভাবে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে শ্রেণিবিভাগ করা যায়। যেমন- হাকীকী বিদায়াত (মৌলিক বিদায়াত) ,ইদাফী বিদায়াত (সংযুক্ত বিদায়াত) ,শিরকী বিদায়াত, হারাম বিদায়াত  ইত্যাদি।আবার শাফেঈ মাযহাবের আলেমগণের কেউ কেউ বিদায়াতকে শরীয়াতের বিভিন্ন পর্যায় অনুসারে ভাগ করেছেন; যেমন- ওয়াজিব বিদায়াত, মুস্তাহাব বিদায়াত, মুবাহ বিদায়াত, মাকরুহ বিদায়াত ও হারাম বিদায়াত ইত্যাদি। তবে বিদায়াতের যে শ্রেণিবিভাগ নিয়ে মতপার্থক্য ঘটেছে তা হল-

# বিদায়াতে হাসানাহ (উত্তম বিদায়াত) 

#বিদায়াতে সাইয়্যিয়াহ (নিকৃষ্ট বিদায়াত) ।

সর্বপ্রথম ইমাম শাফেঈ(রহিমাহুল্লাহ) ও পরবর্তীকালে তাঁর অনুসারীগণ ও আরো পড়ে অন্যান্য মাযহাবের কোন কোন অনুসারী বিদায়াতকে ভাল ও মন্দ এই ২ ভাগে ভাগ করেছেন। আবার পররবর্তীতে ইমাম আবু হানিফা, ইমামা মালিক, ইমাম ইবনু হাজার আস্কালানী, ইমাম ইবনু তাইমিয়াহ, ইমাম রজব, ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল (রহিমাহুল্লাহ) প্রমুখ বিদ্বান মনীষীগণ বিদায়াতের এই শ্রেণিবিভাগকে নিন্দনীয় মনে করেছেন। তবে একটু গভীরভাবে পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, এই শ্রেণিবিভাগ সঙ্ক্রান্ত মতভেদ হয়েছে বিদায়াতের অর্থ ভিন্নভাবে গ্রহণ করার কারণে, মূল বিষয়ে তাদের মধ্যে কোন মতভেদ নেই।

[বিদাআতকে ভাল ও মন্দ শ্রেণিতে ভাগ করার পক্ষে ও বিপক্ষে

আলিমগণের দলীল ও তার বিস্তারিত পর্যালোচনা দেখুন- ডঃআহমদ আলী রচিত ‘বিদায়াত’, খণ্ড-১;পৃষ্ঠাঃ৬৭-৯৫]

মতভেদের মূল কথাঃ 

বিদায়াত কে ভাল ও মন্দে ভাগ করা সংক্রান্ত মত পার্থক্য একটু ভালভাবে দেখলেই বুঝা যায় যেসব পণ্ডিত বিদায়াতকে ভাল ও মন্দে ভাগ করেছেন তারা মুলত বিদায়াতের আভিধানিক অর্থকে গ্রহণ করেছেন আর যারা এর বিরোধীতা করেছেন তারা শার’ঈ অর্থকে গ্রহণ করেছেন। যেসব পণ্ডিত বিদায়াত বিভাজনের পক্ষে তারাও কখনোই শরীয়াতের ব্যাপারে বিদায়াতকে প্রশ্রয় দেননি। মত  পার্থক্য ঘটেছে মুলত ভিন্নভাবে অর্থ গ্রহণের কারণে। যেসব আলিম বিদায়াত বিভাজনের পক্ষে তারা যেটাকে বিদায়াতে সাইয়্যিয়াহ বলেছেন তাকেই অপরপক্ষের আলিমগণ বিদায়াত বলেছেন। যেমন- শাফেঈ মাযহাবের আলেম ইমাম আবু হামিদ গাযালী (রহিমাহুল্লাহ) বলেন- “যে বিদায়াত কোন প্রবর্তিত সুন্নাতকে বাধাগ্রস্থ বা ক্ষতিগ্রস্ত করে সেই বিদায়াতই শুধু নিষিদ্ধ”।—(এহিয়াউ উলুমিদ্দীন;২/৩৩২)—

তিনি আরো বলেন-“ সকল নতুন কর্ম বা বিষয়ই নিষিদ্ধ নয়। বরং যে বিদায়াত কোন প্রতিষ্ঠিত ও প্রতিপালিত সুন্নাতের বিপরীতে উদ্ভাবিত এবং শরীয়তের কোন কর্মকে তার কারণ বিরাজমান থাকা সত্ত্বেও ব্যাহত করে বা নষ্ট করে শুধুমাত্র সেই বিদায়াতই নিষিদ্ধ”। —(এহিয়াউ উলুমিদ্দীনঃ২/৪-৫)—

অর্থাৎ শারঈ ব্যাপারে নতুন প্রচলনের তারাও বিরোধী ছিলেন।

বিদায়াতের বিভাজন সম্পর্কে ওলামাদের চূড়ান্ত বক্তব্যঃ 

কোন বিষয় শরীয়তের দৃষ্টিতে মুবাহ, মুস্তাহাব বা জায়েয প্রমাণিত হলে তাকেতো বিদায়াত বলার প্রয়োজনই নেই। উপরন্তু এগুলোকে বিদায়াত আখ্যা দেয়া আবার দলিল প্রমাণ দিয়ে ওয়াজিব/মুবাহ/মুস্তাহাব প্রমাণ করা-এ যেন পরস্পর বিরোধী দুটি  বিষয়কে একত্রিত করার শামিল। প্রথম পক্ষের আলিমগণ বিদায়াতে হাসানাহ বলতে যা বুঝিয়েছেন ২য় পক্ষের আলিমগণ তাকেই ‘সুন্নাতে হাসানাহ’ বলেছেন। তাঁদের মতে- প্রত্যেক  বিদায়াতই ভ্রান্ত ও খারাপ আর নতুন কিন্তু ভাল বিষয়গুলো বিদায়াতে হাসানাহ নয় বরং ‘সুন্নাতে হাসানাহ’(নতুন প্রচলিত সুন্দর কিছু)-র মধ্যে শামিল হবে। কারণ এগুলো তো দ্বীনের নামে ও আলাহর নৈকট্য অর্জনের জন্য করা হয় না। যেমন- ইন্টারনেট, ফেসবুক(!), টেলিভিশন, রেডিও, কম্পিউটার ইত্যাদি। এই ব্যপারে একটু পরেই আলোচনা করব ইনশা আল্লাহ। মুলতঃ বিদায়াতকে ২ ভাগে ভাগ করাও একটা বিদায়াত এবং বিদায়াতের এ দুয়ার দিয়ে অসংখ্য মারাত্নক বিদায়াত ইসলামে প্রবেশ করে দ্বীনী মর্যাদা লাভ করেছে। বড় সওয়াবের কাজ মনে করে সমাজের বুকে শেকড় মজবুত করে গেড়ে বসেছে। এতে বরং রাসূল(স) এর আদেশকে অমান্য করে এমন কিছু বিষয়কে ইসলামী শরিয়তের অন্তর্ভুক্ত করা হল যাকে রাসূল নিজে গুমরাহী বলেছেন। তাই দেখা যায় পণ্ডিতগণ কোন কোন বিদায়াতকে সৎ নিয়তে হাসানাহ বললেও (আভিধানিক অর্থে) কিছু মানুষ এর ভুল বাখ্যা করে নিজেরা গোমরাহ হয়েছে, অন্যকেও গোমরাহ করেছে। তাছাড়া যখনই কোন বিদায়াত চালু হয়  তখনই একটি সুন্নাতের মৃত্যু হয়। অর্থাৎ বিদায়াতের শ্রেণীবিভাগ যেমন সুন্নাতের মহব্বত ও অনুসরণ কমিয়ে দেয়, তেমনি অন্তহীন সমস্যার সৃষ্টি করে। তাই বিদায়াতকে বিভাজিত না করে সুন্নাতকে আঁকড়ে ধরাই নিরাপদ।

কতিপয় ভ্রান্তির অপনোদনঃ  

১/ উমার(রা) কর্তৃক উত্তম বিদায়াত (বিদায়াতে হাসানাহ) শব্দটি ব্যাবহারঃ

কেউ কেউ মনে করেন উমার (র) প্রথম বিদায়াত চালু করেন তাই তাদেরও করতে সমস্যা নেই আবার অনেক সুন্নাহ প্রেমিক মুসলিম এর প্রকৃত বাখ্যা না জানার জন্য দ্বিধায় থাকেন। আসুন আমরা একে বিদায়াতের সংজ্ঞা  দিয়ে যাচাই করি- তারাবীহ নামায তো নিঃসন্দেহে ইসলামের একটা ইবাদাত ও তা আল্লাহ-র সন্তুষ্টির জন্যেই করা হয়। অর্থাৎ বিদায়াত হবার জন্যে ১ম ২টা শর্তই সিদ্ধ হল !! এবার পরেরগুলা দেখা যাকঃ ৩য় শর্ত- রাসূল (স) করেননি।

নিচের হাদীসটি দেখুন-

“আয়েশা(রা) বলেন, “নাবী মাসজিদে নিজের (তারাবিহ) নামায পড়ছিলেন। বহু লোক তাঁর সঙ্গে নামায পড়ল। দ্বিতীয় রাত্রিতেও অনুরূপ হল। এমনকি এ নামাযে খুব বেশি লোক শরীক হতে লাগল। অতঃপর ৩য় বা ৪র্থ রাত্রে যখন লোকেরা পূর্বের ন্যায় একত্রিত হল তখন রাসূল তাদের কাছে গেলেন না। পরের সকালে তিনি তাদের উদ্দেশ্য করে বললেন, তোমরা যা করেছ আমি তা লক্ষ্য করেছি। আমি তোমাদের সাথে নামাজের জন্য আসিনি শুধু একটি কারণে; তা হলঃ আমার ভয় হচ্ছে যে; এভাবে জামায়াতবদ্ধ হয়ে (তারাবীহ) নামায পড়লে হয়ত তা তোমাদের উপর ফারযই করে দেয়া হবে।(আয়িশা (রা) বলেন,) এ ঘটনা ছিল রমাদান মাসের”। —(বুখারীঃ২০১২; মুসলিমঃ৭৬১)—

এই হাদীস থেকে স্পস্ট প্রমাণিত হয় যে জামায়াতে তারাবীহ পড়া রাসূল (স) এর সুন্নাত, তিনি নিজে এটি করেছেন, সাহাবীরা করলেও নিষেধ করেননি বরং নিরবে থেকে সমর্থন করেছেন। অর্থাৎ বিদায়াতের ৩য়, ৪ র্থ ও ৫ম শর্ত পূরণ করেনি। তাই সংজ্ঞা থেকে প্রমাণিত হয় যে জামায়াতে তারাবীহ নামায পড়া বিদায়াত নয় এবং উমার (রা) কোন বিদায়াতের উদ্ভব ঘটাননি। তিনি এটিকে বিদায়াত বলেছেন শুধুমাত্রই আভিধানিক অর্থে। কারণ রাসূল (স) যে জামায়াতে তারাবীহ আদায় করেছেন তা উমার(রা) এর না জানার কথা নয়। উপরন্তু রাসূল (স) এর সময় শরীয়তের বিধান প্রবর্তিত হচ্ছিল তাই তখন রাসূল জামায়াত বন্ধ করে দেন। কিন্তু তাঁর মৃত্যুর পর যেহেতু আর শরীয়তের বিধান নাযিল হওয়ার কোন সুযোগ ও সম্ভাবনা নেই বরং জামায়াতে নামায আদায়ে অতিরক্ত সওয়াব পাওয়া যাবে এই চিন্তা করে উমার(রা) তারাবীহের নামায জামায়াতে আদায় করার সিদ্ধান্ত নিলেন। এই কাজ করে তিনি কোন বিদায়াতের প্রচলন তো করেনইনি উপরন্তু মৃতপ্রায় সুন্নাতকে জাগ্রত করলেন।

২/ উসমান(রা) কর্তৃক জুমুয়ার দিনের প্রথম আযান প্রচলনঃ

একটি হাদীস দেখুন-

সায়েদ ইবনু ইয়াযীদ (রা) বলেন, “রাসূল(স), আবূ বকর ও উমারের (রা) যুগে জুমুয়ার আযান ছিল একটিই। যখন ইমাম মিম্বারের উপর বসতেন তখন মুয়াজ্জিন আজান দিতেন উসমান (রা) এর যুগে যখন মদীনার লোকসংখ্যা খুব বেড়ে গেল তখন তিনি প্রথমে অতিরিক্ত একটি আযানের ব্যাবস্থা করলেন। এই আযানটি মদীনার যাওরা নামক বাজারে প্রদান করা হত। পরবর্তী যুগে এভাবেই জুমুয়ার আযান উসমান এর নিয়মেই চালু থাকল। ইবনু মাজাহ-র বর্ণনায় বলা হয়েছে যেঃ উসমান যে আযানটি চালু করেন তা মদীনার যাওরা বাজারের একটি ঘরের ছাদের উপর থেকে প্রদান করা হত।“ —(বুখারী;কিতাবুল জুমুয়াহ;৯১২,৯১৩,৯১৬)—

এখান থেকে দেখা যায়, জুমুয়ার দিনের প্রথম আযান রাসূল এর যুগে ছিল না। কিন্তু রাসূল এর সাথে আজীবন থেকে ও তাঁর সুন্নাতকে নিকট থেকে দেখে উসমান (রা) মুসলিমদের জন্যে জুমুয়ার খুতবার গুরুত্ব  উপলব্ধি করেছিলেন, উপরন্তু রাসূল (স) এর যুগে জনবসতি কম ছিল, ফলে পরে জনবসতি বেড়ে যাওয়ায় তাদেরকে আযানের মাধ্যমে সালাতের কথা মনে করিয়ে দেওয়াই উসমান (রা) এর কাছে যৌক্তিক মনে হয়েছিল। সুন্নাতে নববীর এই বাখ্যার অধিকার শুধু খুলাফায়ে রাশেদীনের ছিল। তাঁর কর্মের আলোকে কেউ এখন কোন নামাযে অতিরিক্ত আযান চালু করলে কেউ তা মেনে নিবে না। কিন্তু উসমান (রা) এর যুগে তাঁর এই সিদ্ধান্ত বিদ্যমান সাহাবায়ে কেরামসহ সকলেই মেনে নেন। তা সত্ত্বেও কোন কোন সাহাবী এবং কোন কোন তাবেঈ এই প্রথম আযানের ব্যাপারে কিছুটা আপত্তি রাখতেন। কারণ, সুন্নাতে নববী তাদের কাছে সবথেকে বড় দলীল। আমরা পরবর্তী যুগের মানুষেরা খুলাফায়ে রাশেদীনের কোন কাজকে বিদায়াত বলতে পারি না যেখানে স্বয়ং রাসূল তাঁদেরকে অনুসরণ করতে বলেছেন।

৩/ ইজমা, কিয়াস ও ইজতিহাদ কি বিদায়াত ?

ইজমা, কিয়াস ও ইজতিহাদ বিদায়াত নয়। কারণ এ জন্যে যে, এগুলো ইসলামী ব্যাবস্থায় কিছুমাত্র নতুন জিনিষ নয়। বরং সুন্নাতে সাহাবা ও সুন্নাতে খুলাফায়ে এগুলোর পূর্ণ প্রয়োগ দেখা যায়। অনেকে ভাবেন ইসলাম তো পরিপূর্ণ দ্বীন। এতে নতুন সিদ্ধান্ত কীভাবে গ্রহণীয় হতে পারে ? আসল কথা হল দ্বীন নিজস্ব দিক দিয়ে এবং মৌলিক বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ। যুগে যুগে মুসলিম সমাজকে নতুন নতুন সমস্যার মুখোমুখি হতে হবে এটাই স্বাভাবিক । এসবের সমাধান আবার স্থান, কাল, সমাজভেদে ভিন্ন ভিন্ন হবে। তাই সবকিছুর আলাদাভাবে বিস্তারিত বিবরণ না দিয়ে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (স) কিছু সাধারণ বিধান ও মূলনীতি প্রণয়ন করেছেন যেগুলোর উপর ভিত্তি করে শারীয়াত নির্ধারিত ইজতিহাদের নীতিমালা অনুসরণ পূর্বক অন্যান্য সকল বিষয়ের সমাধান বের করতে হবে। তবে সমাধান খুঁজতে যেয়ে কখনই ইসলাম নির্ধারিত সীমারেখার বাইরে যাওয়া যাবে না। এটি ইসলাম সমর্থন করবে না।

নব-উদ্ভাবন জায়েয যেখানেঃ 

১/ জাগতিক ও অভ্যাসমূলক কর্মকাণ্ডে, উপকরণ ও জনস্বার্থেঃ

মু’আমালাত ও আদাত বা জাগতিক, পার্থিব ও স্বাভাবিক মানবীয় কর্ম যা মুলত মানবীয় প্রয়োজনে করে থাকে সকল ধর্মের বা ধর্মহীন মানুষেরা। এ ধরণের কাজ শরীয়াতের দৃষ্টিতে জায়েয বা নাজায়েয হবে কিন্তু এগুলোকে বিদায়াত বলা বাতুলতা। আবার মুয়াযযিনের আযান দূরে পৌঁছে দেয়ার উদ্দেশ্যে মাইক ব্যাবহার, ইমামের খুতবা, কিরায়াত ও তাকবীর শুনার জন্য লাউড স্পীকার ব্যাবহার, কুরআন মুখস্থ করার উদ্দেশ্যে মাদ্রাসা-মক্তব গুলোতে সম্মিলিতভাবে কুরয়ান পড়া এসবই নব উদ্ভাবিত হলেও জায়েয কারণ এগুলো মুলত ইবাদাতের পদ্ধতি পরিবর্তন করছে না বরং যুগের পরিবর্তনে পরিপূর্ণ সুন্নাতি নিয়মে ইবাদাত পালনে সাহায্য করছে যা জনস্বার্থেও (মাসালিহ মুরসালাহ) ব্যবহ্রত হচ্ছে। তাই এগুলোকে ‘সুন্নাতে হাসানাহ’ বলতে হবে। একইভাবে মুসলিম উম্মাহ-র স্বার্থ রক্ষা ও সামাজিক কল্যাণ লাভের জন্যে শরীয়াত সম্মত জাগতিক উপকরণ ও উপাদান উদ্ভাবন করলেও তা ‘সুন্নাতে হাসানাহ’ বলে গণ্য হবে। এগুলি ইবাদাত নয়, ইবাদাতকে সুন্নাতি নিয়মে পালনের উপকরণ ও উপাদান মাত্র। তবে এগুলি কে ইবাদাতের অংশ হিসেবে বা সাওয়াবের মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করলে তা বিদায়াতে পরিণত হবে। আবার ইবাদাতের নিয়তে না করলেও যদি শরীয়াত নির্ধারিত সীমারেখার বাইরে যায় তবে নিষিদ্ধ হবে এবং করলে গুনাহ হবে।

২/ নতুন পরিস্থিতিতে ইজতিহাদঃ

এ নিয়ে পূর্বে আলোচনা করা হয়েছে।

৩/ পরিত্যক্ত সুন্নাত পালনঃ

যদি কোন কাজ রাসূল ভালো জেনেছেন বা করেছেন কিন্তু  বিশেষ কারণে তিনি নিয়মিত করেননি বা পূর্ণ করেননি সেগুলো পরবর্তিতে সুন্নাতের নিয়ম মত পালন করা যাবে। যেমন- তিনি কুরআন লিখাতেন, সংকলন করাতেন কিন্তু তাঁর জীবদ্দশায় তা একত্রে সংকলিত করতে বা বাইণ্ডীং করাতে পারেননি কারণ পরে ওহী আসলে আবার বাইণ্ডিং খুলতে হত। একইভাবে রাসূলের জীবদ্দশায় কুরানের সাথে মিশে যাওয়ার আশঙ্কায় হাদীস লিখা হয়নি। মৃত্যুর পর হাদীস গ্রন্থাকারে সংকলিত হয়। উমার (রা) এর নির্দেশে জামায়াতে তারবীহের নামায আদায় পুনরায় শুরু হয়। এগুলি সবই পরিত্যাক্ত সুন্নাত পালনের উদাহরণ।

বর্তমানে আমরা অনেকেই খাওয়ার পর মিষ্টি খেয়ে একটা ঢেকুর তুলে নিজেদের ‘আহলুস সুন্নাত’ দাবি করে মনে কিছুটা প্রশান্তি পাই ও অন্যদের বিদায়াতী কাজ দেখে তিরষ্কার করি। কিন্তু আমাদের আকীদা, কথা ও কাজ-কর্মে এমন সব বিদায়াত ঢুকে আছে যে আমরা নিজেদের ‘আহলুস সুন্নাত’ দাবি করলেও মুলত আমরাই ‘আহলুল বিদায়াত’; আল্লাহ আমাদের সবাইকে বিদায়াত চেনার, তা থেকে ফিরে আসার, তা চিরতরে বর্জন করার ও সহীহ সুন্নাত মোতাবেক জীবন যাপন করার তৌফিক দিক। আমীন।

[এই নোটের কোন একটি মন্তব্য, বাখ্যা, বিশ্লেষণ ও তথ্যও আমার মনগড়া নয়, আমি পণ্ডিতগণের মন্তব্য, বাখ্যা, বিশ্লেষণ ও তথ্য অনুসরণ করেছি মাত্র। এই নোটের ২য় পর্বে আমাদের সমাজে আকীদা ও কথায় প্রচলিত বিদায়াত এবং ৩য় পর্বে ইবাদাতের মধ্যে প্রচলিত বিদায়াত নিয়ে আলোচনা করব ইনশা আল্লাহ]

সহায়ক গ্রন্থঃ 

১/ আল-কুরআন

২/ সহীহ হাদীস

৩/এহইয়াউস সুনান (ডঃ খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর)

৪/ বিদায়াতঃ১ম খণ্ড (ডঃ আহমদ আলী)

৫/ সুন্নাত ও বিদায়াতঃ মাওলানা আব্দুর রহিম

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *