يٰٓاَيُّهَا النَّاسُ اتَّقُوْا رَبَّكُمْۚ اِنَّ زَلْزَلَةَ السَّاعَةِ شَيْءٌ عَظِيْمٌ
অর্থ: “হে মানুষ! তোমরা তোমাদের প্রতিপালককে ভয় কর, কিয়ামাতের কম্পন এক ভয়ানক জিনিস”। (সূরা হজ, ০১)
কখনও কি ভেবেছেন কেন আল্লাহ সূরা হজ শুরু করেছেন কিয়ামতের বর্ণনা দিয়ে? এবং এই সূরার একটি উল্লেখযোগ্য অংশে রয়েছে হজ ও কিয়ামতের বর্ণনা। একটু গভীরভাবে তলিয়ে দেখলেই পরিষ্কার হয়ে যায় হজ এবং কিয়ামত কতটা সাদৃশ্যপূর্ণ এবং এই দুই এর মাঝে কি গভীর মিল রয়েছে! মূলত হজের প্রতিটা কার্যক্রমই হল কিয়ামতের একেকটি ধাপের ক্ষুদ্র নমুনা এবং আমাদের জন্য রিমাইণ্ডার।
বাংলাদেশ পর্বে আমাদের সর্বশেষ ট্রেনিং সেশনে শেফার্ডস এর তারেক ভাই এই বিষয়টা খুব দারুণভাবে আলোচনা করলেন। একদিকে আসন্ন হজের উত্তেজনা এবং অন্যদিকে কিয়ামতের এই সাদৃশ্য আমাকে দারুণভাবে আলোড়িত করল। দীর্ঘদিন পর কোনো ইসলামিক লেকচার শুনে আমার চোখে পানি আসল। হজ-পূর্ব সময়ে যত লেকচার ও ট্রেনিং সেশন আমি এটেণ্ড করেছিলাম সবগুলির মধ্যে এই সেশনটি আমার মনে সবচেয়ে বেশি রেখাপাত করল। পরবর্তীতে বিষয়টি নিয়ে আরেকটু ঘাঁটাঘাটি করলে আরও দারুণ কিছু পয়েন্ট পেয়ে যাই। এই অধ্যায়ে এই বিষয়টা নিয়েই আলাপ করতে চাই। হজের যাওয়ার আগে থেকে শুরু করে ফিরে আসা পর্যন্ত এই কথাগুলি মাথায় গেঁথে নেওয়া প্রয়োজন।
কাবা নির্মাণের পর ইব্রাহীম আ: আল্লাহর নির্দেশে মানবজাতিকে হজের দিকে আহ্বান করেন। ইব্রাহীম আ: এর বিশ্বজনীন আহ্বান আল্লাহ কুরআনে তুলে ধরেছেন এভাবে-
وَاَذِّنْ فِى النَّاسِ بِالْحَجِّ يَأْتُوْكَ رِجَالًا وَّعَلٰى كُلِّ ضَامِرٍ يَّأْتِيْنَ مِنْ كُلِّ فَجٍّ عَمِيْقٍ ۙ
অর্থ: “আর মানুষের মাঝে হাজ্জের ঘোষণা দাও, তারা তোমার কাছে আসবে পায়ে হেঁটে, আর সব (পথক্লান্ত) শীর্ণ উটের পিঠে, বহু দূরের গভীর পর্বত সংকুল পথ বেয়ে…” (সূরা হজ, ২৭)
এই আহ্বানের মাধ্যমেই সারাবিশ্ব থেকে দলে দলে মক্কায় এসে মুসলিমদের হজ সম্পাদন শুরু হয়। হজ পরিণত হয় সমগ্র বিশ্বের মুসলিমদের এক মিলনমেলায়। কিয়ামতের দিবসও হজের মত এমন একটি আহ্বান দিয়েই শুরু হবে, এই আহ্বান করা হবে শিঙ্গায় ফুঁ দেওয়ার মাধ্যমে। কুরআনের অসংখ্য আয়াতে আল্লাহ কিয়ামতের সূচনার এই ফুৎকারের কথা বলেছেন-
وَنُفِخَ فِي ٱلصُّورِ فَصَعِقَ مَن فِي ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَمَن فِي ٱلۡأَرۡضِ إِلَّا مَن شَآءَ ٱللَّهُۖ ثُمَّ نُفِخَ فِيهِ أُخۡرَىٰ فَإِذَا هُمۡ قِيَامٞ يَنظُرُونَ ٦٨ وَأَشۡرَقَتِ ٱلۡأَرۡضُ بِنُورِ رَبِّهَا وَوُضِعَ ٱلۡكِتَٰبُ وَجِاْيٓءَ بِٱلنَّبِيِّۧنَ وَٱلشُّهَدَآءِ وَقُضِيَ بَيۡنَهُم بِٱلۡحَقِّ وَهُمۡ لَا يُظۡلَمُونَ
অর্থ: “আর শিঙ্গায় ফুঁক দেওয়া হবে। ফলে আল্লাহ যাদেরকে ইচ্ছা করেন তারা ছাড়া আসমানসমূহে যারা আছে এবং পৃথিবীতে যারা আছে সকলেই বেহুঁশ হয়ে পড়বে। তারপর আবার শিঙ্গায় ফুঁক দেওয়া হবে, তখন তারা দাঁড়িয়ে তাকাতে থাকবে। আর যমীন তার রবের নূরে আলোকিত হবে, আমলনামা উপস্থিত করা হবে এবং নবী ও সাক্ষীগণকে আনা হবে, তাদের মধ্যে ন্যায়বিচার করা হবে। এমতাবস্থায় যে, তাদের প্রতি যুলম করা হবে না”। [সূরা আয-যুমার. ৬৮-৬৯]
وَنُفِخَ فِي ٱلصُّورِ فَإِذَا هُم مِّنَ ٱلۡأَجۡدَاثِ إِلَىٰ رَبِّهِمۡ يَنسِلُونَ
অর্থ: “আর শিঙ্গায় ফুঁক দেওয়া হবে, তৎক্ষণাৎ তারা কবর থেকে তাদের রবের দিকে ছুটে আসবে”। [সূরা ইয়াসীন, ৫১]
یَّوۡمَ یُنۡفَخُ فِی الصُّوۡرِ وَ نَحۡشُرُ الۡمُجۡرِمِیۡنَ یَوۡمَئِذٍ زُرۡقًا
অর্থ: যেদিন শিংগায় ফুঁক দেয়া হবে, আর সেদিন আমি অপরাধীদেরকে দৃষ্টিহীন অবস্থায় সমবেত করব। (সূরা ত্ব-হা, ১০২)
হজের সূচনা এবং কিয়ামতের সূচনা এভাবে একইসূত্রে গাঁথা।
ঐ হাদীসটি নিশ্চয়ই মনে আছে যেখানে
“নবীজি বলেছিলেন- কিয়ামতের দিন সকলে উলংগ ও খৎনাহীন অবস্থায় উঠবে। তখন মা আয়িশা বলেছিলেন- তাহলে এটাতো খুবই লজ্জার বিষয় হবে। নবীজি বললেন, ঐ সময় কেউ কারো দিকে তাকানোর মতও ফুরসত পাবে না। সবাই নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত থাকবে। (সহীহ: বুখারী ৩৪৪৭, মুসলিম ৫৬-(২৮৫৯), তিরমিযী ২৪২৩)
সমগ্র হজটাই যেন এই হাদীসের বাস্তব প্রতিফলন।
কিয়ামতের ময়দানের সাথে হজের ময়দানের পার্থক্য শুধু এতটুকুই যে হজের সময় আপনি উপস্থিত হবেন মাত্র দু’টুকরো কাপড়ে। দুনিয়ায় আপনার স্ট্যাটাস যত আহামরিই হোক না কেন, আপনি যত সম্পদেরই অধিকারী হোন না কেন কিংবা পোশাক-আশাক নিয়ে যত সৌখিনই হোন না কেন হজের সময় আপনি ‘মন চাহে’ পোশাক পরতে পারবেন না, দু’টুকরো কাফনসদৃশ সাদা কাপড়ই আপনার ভরসা। আবার হজের দিনগুলিতে ক্রমাগত সফর এবং একটির পর একটি ব্যস্ততার কারণে প্রায় সময়ই ইহরামের কাপড় ঢিলে হয়ে যাবে, উপরের অংশ অনাবৃত হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিবে, অনেক সময় হয়েও যাবে এবং আপনাকে টেনেটুনে কাপড় ঠিক করতে হবে। এ যেন কিয়ামত দিবসের অনাবৃত শরীরের কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। আবার আপনি দুনিয়ায় যত আলিশান বাড়িতেই থাকেন না কেন, হজের ৬টি দিন আর দশজন সাধারণ মানুষের মতই ধুলিধুসরিত হয়ে কখনও তাঁবুতে গাদাগাদি করে আবার কখনও খোলা ময়দানে খালি আকাশের নিচে চাদর বিছিয়ে থাকতে হবে।
হ্যাঁ, বিত্তশালী হলে আপনি ৫* প্যাকেজে যেতে পারবেন, তাতে ভিভিআইপি ট্রিটমেন্ট পেতে পারেন এবং লাক্সারি কমফোর্টও হয়ত আপনি ‘এফোর্ড’ করতে পারবেন কিন্তু এই সকল ‘লাক্সারি’ মীনায় যাওয়ার আগ পর্যন্তই। দেখুন, আল্লাহ কীভাবে একজন হাজীকে ধাপে ধাপে হীন থেকে হীনতর স্তরে নিয়ে আসছেন- হারাম থেকে ‘জিরো কিলো’-র ৫* স্টার হোটেল থেকে নিয়ে আসলেন মীনার তাঁবুতে- যেখানে অন্তত আপনার একটি বিছানা-বালিশ আছে আর মাথার উপরে ছাদ আছে, সেখান থেকে আরাফায় যেখানে আপনার নির্দিষ্ট বিছানাও নেই তবে মাথার উপরে ছাদ অন্তত আছে, সেখান থেকে মুযদালিফায়- খোলা আকাশের নিচে ধু ধু প্রান্তরে শুয়ে রাত কাটাতে হবে আপনাকে। এখানে নেই কোনো বিছানা-বালিশ, নেই কোনো ছাদ, নেই কোনো তাঁবু। পাথুরে ময়দানের উন্মুক্ত ভূমিতে একটি চাদর বিছিয়ে রাত কাটাতে হবে। শিঙ্গায় ফুৎকারের সাথে সাথে কবর থেকে যেমন মানুষ নগ্ন শরীরে উঠে দাঁড়াবে তেমনি মুজদালিফার প্রাঙ্গন থেকেও ভোরবেলা সেই দু’টুকরো সাদা কাপড়ে আপনি উঠে বসবেন। কবর থেকে দাঁড়িয়ে মানুষ হাশরের ময়দানে ছুটবে এবং চূড়ান্ত বিচারের প্রস্তুতি নিবে তেমনি মুজদালিফা থেকেও হজের বাকি কাজগুলো সম্পন্ন করার প্রস্তুতি হিসাবে মীনার উদ্দেশ্যে রওনা দিতে হবে। কবর থেকে উঠে যেমন ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন মানুষের গন্তব্য হবে বিচারের মাঠ, তেমনি মুজদালিফা থেকেও লাখ লাখ মানুষের গন্তব্য একটাই- মীনার তাঁবু। হাশরের ময়দানের অভিজ্ঞতা এর চেয়ে ভালো আর কোথায় পাবেন বলুন!
মৃত্যুর পর থেকে নিয়ে হাশরের ময়দান- এই পুরোটা যাত্রায় নিঃসন্দেহে মানুষ থাকবে অত্যন্ত পেরেশানির মধ্যে। প্রাণ হরণকারী ফেরেশতার সাক্ষাৎ, কবরের সাওয়াল-জবাব অতঃপর শান্তি অথবা শাস্তির ফায়সালা, কবর থেকে উঠে দাঁড়ানো, বিচারের মাঠের উদ্দেশ্যে যাত্রা, সেখানে একে একে সকল নবীর কাছে ছুটে বেড়ানো বিচার শুরুর অনুরোধ নিয়ে, এরপর মীযান, বিচার, বিচারের পর পুলসিরাত- এই যে পুরোটা সময় মানুষ থাকবে অত্যন্ত ‘haste’ এর মধ্যে, কোথাও যেন দু’দণ্ড বিশ্রাম নেই, শুধুই ছুটে বেড়ানো, শুধুই পথ চলা-নতুন নতুন গন্তব্যে।
হজের দিনগুলোও ঠিক এমনি- ৮ই যিলহজ সকালে রওনা দেবেন মীনার উদ্দেশ্যে (অবশ্য প্রচণ্ড ভীড়ের কারণে এখন এজেন্সিগুলো ৭ই যিলহজ রাতেই মীনার উদ্দেশ্যে রওনা দেয়), সেখান থেকে ৯ই যিলহজ চলে যাবেন আরাফায়, আরাফা থেকে ঐদিনই মাগরিবের পর চলে যাবেন মুযদালিফায় এবং পরদিন ১০ই যিলহজ মুযদালিফা থেকে পুনরায় ফিরে আসবেন মীনায়, মীনা থেকে ঐদিন পাথর মারতে যাবেন জামারায় এবং জামারা থেকে মক্কায় গিয়ে ফরয তাওয়াফ ও সাঈ শেষ করে পুনরায় মীনার তাঁবুতে ফিরে আসবেন। পরের দুই দিন ১১ ও ১২ই যিলহজ (১৩ই যিলহজ মীনায় অবস্থান করা ঐচ্ছিক) একইভাবে পাথর মেরে মীনায় অবস্থান করবেন। বুঝতেই পারছেন- হজের দিনগুলোতে কোথাও যেন দু’দণ্ড বিশ্রাম নেই, একের পর এক ছুটে চলা নতুন নতুন গন্তব্যে নতুন কোনো উদ্দেশ্যে। মৃত্যু থেকে নিয়ে হাশরের মাঠে উপস্থিত হওয়ার সাথে কি এর কোনো সাদৃশ্য খুঁজে পাচ্ছেন? সাফা-মারওয়ার মাঝে সাঈ করতে গিয়ে একদিকে যেমন মা হাজেরা ও ইসমাঈল আ: এর স্মৃতি আমাদের মনে পড়ে যায় তেমনি মনে পড়ে যায় কিয়ামতের ময়দানের দিশেহারা ছুটোছুটির কথা।
মীনা-আরাফা-মুজদালিফার ধুধু প্রান্তরে চারিদিকে লক্ষ লক্ষ মানুষ অথচ আপনি কাউকে চিনেন না, কারও দিকে দেখার সময় নেই। পুরোটা সময় নিজেকে নিয়েই ব্যস্ততা, নিজের হজের কবুলিয়্যাত নিয়েই চিন্তা-ঠিক যেন কিয়ামতের ময়দানের ‘ইয়া নাফসি’ অবস্থারই বাস্তব প্রতিফলন। এই উপলব্ধি সবচেয়ে ভালো হয় আরাফার ময়দানে- এখানে অবস্থানের সময় অল্প (যোহর থেকে মাগরিব) আর এখানকার সুবিশাল ফযীলত এবং দূয়া কবুলের নিশ্চিত ওয়াদা-সব মিলিয়ে আশেপাশের কারও দিকে সময় নিয়ে তাকানোর ফুরসত মেলা ভার।
মুজদালিফায় তীব্র পানির কষ্টে এই ‘আত্মকেন্দ্রিকতা’র সামান্য নমুনা দেখেছি। আমরা ময়দানের যেখানে অবস্থান নিয়েছিলাম সেখানে পানি ছিল না, আমাদের বাসেও পানির কোনো এক্সট্রা বক্স দেওয়া হয়নি। আবার আমরা ধরেই নিয়েছিলাম মুজদালিফায় পানি তো পাবোই তাই আর এক্সট্রা পানি সাথে নিইনি। মনে আছে- তীব্র পানির কষ্টে এক আন্টি আমাদের হোয়াটস এপ গ্রুপে লিখেছিলেন- Feeling like karbala. বস্তুত তখন আমাদের সকলেরই অবস্থা কারবালার মত! সামান্য এক চুমুক পানির জন্য চারিদিক ছুটে বেড়াচ্ছি। আমাদের থেকে কিছু দূরেই একটা আফ্রিকান কাফে,ম ম০১ললা পেলাম- তারা নিজেদের মধ্যে পানির বোতল বিতরণ করছে। ছুটে গেলাম তাদের কাছে, অনেক অনুনয়-বিনয় করলাম কিন্তু পেলাম না। দেখলাম আমাদের গ্রুপের কয়েকজন আন্টি তখন পানির জন্য কাতর হয়ে পড়েছেন। এই দৃশ্য দেখে আর স্থির থাকা গেল না। আমরা সময়বয়সী ৩ জন পানির সন্ধানে বের হলাম। প্রায় দু’কিলোমিটার হেঁটে এক লরির দেখা পেলাম। সেখান থেকে দু’জন যুবক পানি বিতরণ করছে-একজন দিচ্ছে পানির বোতল, আরেকজন দিচ্ছে পানির বক্স (প্রতিটি বক্সে ৮-১০টার মত বোতল আছে)। আমরা সেখানে প্রথমে বোতল নিয়ে ইচ্ছামত পানি পান করলাম, পিপাসা পুরোটা মিটিয়ে এক পর্যায়ে দেখি পানি খেতে গেলে পেট ব্যাথা করে! তখন তিনজন তিন বক্স পানি মাথায় নিয়ে ফিরে চললাম আমাদের গ্রুপের স্থানে। যেতে যেতে দেখি আমাদের গ্রুপের এক আংকেলও এদিকে আসছেন পানি নেওয়ার জন্য, দ্রুত তিনি গিয়ে কোত্থেকে যেন এক বক্স জুস ম্যানেজ করে ফেললেন। আমরা পানি আর জুস নিয়ে ফিরে আসলাম- প্রথমেই আন্টি ও আপাদেরকে, এরপর আংকেল ও ভাইদের পানি দিলাম। সেদিন আন্টিদের মুখ থেকে যে দূয়া শুনেছি তা হয়ত আজীবন মনে থাকবে।
মীনা থেকে জামারায় পাথর মারতে যাওয়ার সময় খুবই মর্মাহত হলাম কিছু দৃশ্য দেখে। তীব্র গরমে পাহাড়ি ঢাল বেয়ে ওঠার সময় স্থানে স্থানে অনেক মানুষ কাহিল হয়ে শুয়ে পড়েছে, কেউবা বসে হাঁপাচ্ছে আর আশেপাশের কিছু মানুষ মাথায় পানি ঢালছে। এমন দুয়েকজনকে দেখে মনে হচ্ছিল- তাদের বুঝি আর এক পা এগোনোর শক্তি নেই। এই মানুষগুলো সবাই যে অনেক বয়ষ্ক তা কিন্তু না, কয়েকজন যুবক বয়সীকেও দেখলাম- হাঁটু গেঁড়ে বসে পড়েছে আর মাথায় পানি ঢালছে। কিন্তু এখানে খুব বেশি অপেক্ষা করার সুযোগ নেই- কাফেলা ক্রমাগত হেঁটে চলেছে সামনে। দেরি হয়ে গেলে আবার কাফেলা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে হবে-সেটা আরেক মুসিবত। একারণে আশেপাশে অসুস্থ মানুষের দৃশ্য দেখলেও খুব বেশী কিছু করার ছিল না। তখন প্রতি পদে পদে মনে হচ্ছিল নবীজির ঐ হাদীসটির কথা- কিয়ামতের ময়দানে প্রত্যেকেই ব্যস্ত থাকবে নিজেকে নিয়ে, অন্যের দিকে তাকানোর সুযোগ মিলবে না।
কিয়ামতের সূচনা হবে মীকাইল আ: এর শিঙ্গায় ফুঁ দেওয়ার মাধ্যমে আর সাথে সাথেই আদম আ: থেকে নিয়ে শেষ মানুষটা পর্যন্ত কবর থেকে জেগে উঠবে এবং দৌড়াতে থাকবে হাশরের ময়দানের দিকে। প্রত্যেকের গন্তব্য একটাই- হাশরের ময়দান, অতঃপর হিসাব-নিকাশ। এবং এইদিন ঘটবে চূড়ান্ত সম্মিলন। আল্লাহ কুরআনে তাই এই দিনকে বলেছেন- ‘ইয়ামুত তালাক’ (মিলনের দিন), ‘ইয়ামুল হাশর’ (একত্রিত হওয়ার দিন)।
আদম আ: এর সাথে দুনিয়ায় তাঁর সর্বশেষ সন্তানের সাক্ষাৎ যেমন হবে এইদিন, দুনিয়ার মানুষের সাথে আসমানের ফেরেশতাদেরও সাক্ষাৎ হবে এইদিনে। ফেরেশতারা সারিবদ্ধভাবে নেমে আসবে হাশরের ময়দানে। ফেরেশতাদের এই আগমনের কথা আল্লাহ বর্ণনা করেছেন কুরআনের একাধিক জায়গায়-
هَلْ يَنظُرُونَ إِلَّا أَن يَأْتِيَهُمُ اللَّهُ فِي ظُلَلٍ مِّنَ الْغَمَامِ وَالْمَلَائِكَةُ وَقُضِيَ الْأَمْرُ ۚ وَإِلَى اللَّهِ تُرْجَعُ الْأُمُورُ
অর্থ: ‘‘তারা কেবল সেই সময়ের অপেক্ষায় বসে আছে, যখন মেঘমালার ছায়াসহ স্বয়ং আল্লাহ তাদের সামনে আগমণ করবেন, বিপুল পরিমাণ ফেরেশতাগণও তাদের সামনে আসবেন। তখন সবকিছুর ফয়সালা হয়ে যাবে। শেষ পর্যন্ত সকল বিষয় তো আল্লাহর সামনেই উপস্থাপিত করা হবে’’। (সূরা বাকারা: ২১০)
كَلَّا إِذَا دُكَّتِ الْأَرْضُ دَكًّا دَكًّا وَجَاءَ رَبُّكَ وَالْمَلَكُ صَفًّا صَفًّا وَجِيءَ يَوْمَئِذٍ بِجَهَنَّمَ ۚ يَوْمَئِذٍ يَتَذَكَّرُ الْإِنسَانُ وَأَنَّىٰ لَهُ الذِّكْرَىٰ يَقُولُ يَا لَيْتَنِي قَدَّمْتُ لِحَيَاتِي
অর্থ: ‘‘কখনই নয়, পৃথিবীকে যখন চূর্ণবিচূর্ণ করে বালুকাময় করে দেয়া হবে এবং তোমার রব এমন অবস্থায় আসবেন, যখন ফেরেশতারা সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে থাকবে। সেদিন জাহান্নামকে সামনে আনা হবে৷ সেদিন মানুষ বুঝবে কিন্তু তার বুঝতে পারায় কী লাভ? সে বলবে, হায় আফসোস! যদি আমি নিজের জীবনের জন্য কিছু আগাম ব্যবস্থা করতাম!। (সূরা ফাজর: ২১)
وَيَوْمَ تَشَقَّقُ السَّمَاءُ بِالْغَمَامِ وَنُزِّلَ الْمَلَائِكَةُ تَنزِيلًا
অর্থ: ‘‘সেদিন আকাশ ফুড়ে একটি মেঘমালার উদয় হবে এবং ফেরেশাতাদেরকে দলে দলে নামিয়ে দেয়া হবে’’। (সূরা ফুরকান: ২৫)
এই দিন সাক্ষাৎ হবে যালিমের সাথে মাজলুমের, নিহত ব্যক্তি তার হত্যাকারীর (খুনির) চুলের মুঠি ধরে হাশরের ময়দানে টেনে নিয়ে আসবে।
বিগত প্রায় এক দশক যাবৎ আমাদের দেশে তরুণ প্রজন্মের মাঝে হজে যাওয়ার একটা প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। প্রচুর সংখ্যক তরুণ এখন হজের ব্যাপারে আগ্রহী এবং সামনে এই প্রবণতা আরও বাড়বে ইনশা আল্লাহ। তবে এখন থেকে ৪০-৫০ বছর আগে তাকালেও কিন্তু দৃশ্যপট ছিল পুরোই ভিন্ন। তখন হজ মানেই মনে করা হত বয়ষ্ক মুরুব্বি শ্রেণীর মানুষের একটি আমল। মানুষ শেষ বয়সে ছেলে-মেয়ের বিয়ে দিয়ে, সম্পত্তির ভাগ-বাটোয়ারা করে সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে হজে যেত। অর্থাৎ অনেকটা শেষ বিদায়ের প্রস্তুতি! যদিও বর্তমানে এই পরিস্থিতি অনেকটাই পরিবর্তনের পথে তবুও এখনও হজে যাওয়ার পূর্বে প্রায় সকলেই আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধবের কাছে মাফ চেয়ে নেয়, পূর্বের বিবাদ বিসম্বাদ থাকলে তা মিটিয়ে নেয়- এ কি মৃত্যুর আগে মানুষের চির বিদায়ের প্রস্তুতিকেই মনে করিয়ে দেয় না? আর মৃত্যুইতো কিয়ামতের প্রথম ধাপ।
যখন হাশরের মাঠে সকল হিসাব-কিতাব শেষ হয়ে যাবে এবং প্রত্যেকেই নিজের নিজের পাওনা বুঝে পাবে তখন তারা পাড়ি দেবে পুলসিরাত। এরপর সকলেই পৌঁছে যাবে তাদের অভীষ্ট গন্তব্যে- জান্নাত অথবা জাহান্নামে। এইদিন মানুষের সকল পেরেশানির অবসান ঘটবে এবং প্রত্যেকেই তাদের কর্মের ফল পেয়ে যাবে পুরোপুরি। হজ শেষ করে যখন আমরা বাড়ি ফিরি তখনও আমাদের জন্য আল্লাহর তরফ থেকে পুরষ্কার নির্ধারণ হয়ে যায়। এই মুহূর্তটি হল হজের সকল পেরেশানির অবসানের এবং সকল কষ্টে ধৈর্যধারণের পুরষ্কার পাওয়ার মুহূর্ত।
রাসূলুল্লাহ সা. বলেন,
“এক উমরার পর আরেক উমরাহ উভয়ের মধ্যবর্তী সময়ের (গুনাহের) জন্য কাফফারা। আর জান্নাতই হলো হজে মাবরুরের প্রতিদান”। (সহীহ বুখারি, হা/১৭৭৩, সহীহ মুসলিম, হা/৩১৮০)
তিনি আরও বলেন,
“তুমি কি জানো না যে, ইসলাম পূর্ববর্তী সকল গুনাহ মিটিয়ে দেয়? হিজরত পূর্ববর্তী সকল গুনাহ মিটিয়ে দেয়? আর হজ পূর্ববর্তী সকল গুনাহ মিটিয়ে দেয়?” (সহীহ মুসলিম, হা/২২০)
হাদিসে আরও এসেছে,
“তোমরা হজ ও উমরাহ পরস্পর (হজ্জ সমাপনের পর ‘উমরাহ ও ‘উমরার পর হজ) আদায় করবে। কেননা তা অভাব ও পাপ এমনভাবে দূর করে দেয়, যেমনিভাবে হাপর লোহা, সোনা ও রুপার ময়লা দূর করে দেয়। আর মাবরুর হজের বিনিময় জান্নাত ব্যতীত আর কিছুই নয়”। (সুনান আন-নাসা’ঈ, হা/২৬৩১)