আল্লাহ রাসূলের সময়কালে হাদীসের কোন অফিসিয়াল কালেকশান ছিল না বলা যায়। প্রত্যেকে ব্যক্তিগত উদ্যোগে স্বল্প কিছু হাদীস লিখে রাখতেন। তারপর আস্তে আস্তে প্রায় চার’শ বছরের পথ পরিক্রমায় হাদীসগুলো অত্যন্ত সুচারুরুপে সুকাঠামোতে লিপিবদ্ধের কাজ চলে। সেই প্রাথমিক যুগ থেকেই অনেকে হাদীসের ব্যাপারে সন্দেহের বীজ ঢোকানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে। তারা জানে ইসলাম নামক দূর্গের ভীত নড়বড়ে করে দেয়ার জন্য হাদীসের ব্যপারে আক্রমণই সবচেয়ে ফলপ্রসূতার সম্ভাবনা! অবশ্য, আমাদের পূর্ববর্তীরা কোন ফাঁকফোঁকড় রেখে যাননি। পৃথিবীতে রাসূল (সঃ) একমাত্র ব্যক্তি যার ব্যক্তিগত জীবনে জামা পরা,জুতা পরা থেকে শুরু করে স্ত্রীদের সাথে খুঁনসুটি অতঃপর রাষ্ট্রীয় জীবনের সবকিছু অত্যন্ত সুন্দর দালিলীক উপায়ে লিপিবদ্ধ। বিশ্বইতিহাসে এমন দ্বিতীয় ব্যক্তি খুঁজে পাওয়া দুষ্কর যারা সম্পর্কে এমন খুঁটিনাটি বিষয় সংরক্ষিত। শুধু তাই নয় এই একজন মাত্র মানুষের জীবন সংরক্ষিত,লিপিবদ্ধ রাখার জন্য মুসলিমরা তার সাথে এবং তার পরের আরো হাজার হাজার মানুষের জীবনী লিখে রেখেছেন। ইসলামবিরোধীর যখন হাদিসের বদনামে প্রায় ব্যর্থ হল তখন তারা বলা শুরু করল- কোরআনই বলছে, কোরআনে সবকিছু আছে। রশীদ খলিফার মত কিছু মুরতাদেরও সৃষ্টি হয়েছে যারা হাদীস অস্বীকার করে। ফলাফলে অনেক সাধারণ মুসলমান বিভ্রান্ত হচ্ছে। এ অবস্থায় হাদীসের প্রয়োজনীয়তা তাদের সামনে তুলে ধরা একান্ত প্রয়োজন।
জীবন দর্শন তৈরিতে:
সৃষ্টিলগ্ন থেকে যেসকল প্রশ্নগুলো দার্শনিকদের সবচেয়ে বেশি ভাবিয়েছে,সেগুলো হল আমাদের আগমন কোথা থেকে? আমরা কেন আসলাম? কোথায় যেতে হবে? পৃথিবীতে আমাদের উদ্দেশ্যইবা কি? পৃথিবীটা কি ‘খাওদাও ফূর্তি’র নীতিতে চলবে, নাকি অন্য কিছু? এ সবগুলো প্রশ্নের বিস্তারিত ব্যাখ্যা আল্লাহর রাসূল দিয়ে গেছেন। সাহাবীদের তিনি বিষয়গুলো বিভিন্ন ভাবে, ভঙ্গীতে হৃদয়াঙ্গম করিয়ে গেছেন। তার দু’একটি উদাহরণ দেয়া যেতে পারে-
“দুনিয়ার জীবন দৃষ্টান্ত আখিরাতের জীবনের তুলনায় এমন, যেমন তোমাদের কেউ অকুল সমুদ্রে একটি আঙ্গুল রাখল, তারপর তা তুলে ফেলল, তখন তার আঙ্গুলের সাথে যতটুকু পানি উঠে আসে দুনিয়ার জীবনও আখিরাতের তুলনায় তার মত। সে যেন চিন্তা করে দেখে সমুদ্রের পানির তুলনায় তার আঙ্গুলের সাথে উঠে আসা পানির পরিমাণ কতটুকু”।(সহীহ মুসলিম)
সমুদ্রের পানির তুলনায় আঙ্গুলের সাথে উঠে আসা পানি কোনো পরিমাণ হিসেবে আখ্যায়িত করা যায় কি? তা এতই নগণ্য যে দুনিয়ার কোন গণিতবিদও তা ব্যাখ্যা দিয়ে বোঝাতে অক্ষম। আখিরাতের জীবন অনন্ত অসীম যার শুরু আছে শেষ নাই। আখিরাতের জীবনের তুলনায় দুনিয়ার জীবন একেবারেই নস্যি। তাই রাসূল (সঃ) বিষয়টাকে সঠিকভাবে বুঝানোর জন্য একটি দৃষ্টান্ত দিয়েছেন মাত্র।
আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রাঃ থেকে বর্ণিত,তিনি বলেছেন-একদা নবী করীম সঃ আমার স্কন্ধদ্বয়ে হাত দিয়ে বলেছেনঃ তুমি দুনিয়ায় এমনভাবে বসবাস করো,যেন তুমি একজন পথের পথিক- দূরের যাত্রী। আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, নবী (সাঃ) বলেছেন, “হে আল্লাহ! আখেরাতের জীবনই প্রকৃত জীবন। (বুখারী,মুসলিম)
আব্দুল্লাহ ইবনে মাসঊদ (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) একদিন চাটাই –এর উপর শুলেন। তারপর তিনি এই অবস্থায় উঠলেন যে, তাঁর পার্শ্বদেশে দাগ পড়ে গিয়েছিল। আমরা বললাম, ‘হে আল্লাহর রসূল! যদি (আপনার অনুমতি হয়, তাহলে) আমরা আপনার জন্য নরম গদি বানিয়ে দিই। তিনি বললেন, “দুনিয়ার সাথে আমার কি সম্পর্ক? আমি তো এ জগতে ঐ সওয়ারের মত যে ক্লান্ত হয়ে একটু বিশ্রামের জন্য গাছের ছায়ায় থামল। পুনরায় সে চলতে আরম্ভ করল এবং ঐ গাছটি ছেড়ে দিল।” (তিরমিযী, ইবনু মাজাহ)
সত্যি! কি চমৎকার উপমা! একজন পথিক কাঠফাটা রোদে যখন কোন প্রান্তর দিয়ে হেঁটে যায়, পথিমধ্যে সে বিস্তৃত বটের ছায়ায় বিশ্রামের উদ্দেশ্যে খানিকক্ষনের জন্য গা এলিয়ে দেয়, এতে যে স্বল্প বিরতিটুকু নেয় আমরা আখিরাতের অনন্তকালের যাত্রায় অল্পকিছুক্ষণ বিরতি নিলাম। এ সময় অতি সামান্য। তদুপরি পথিক যেমন পথে গতিশীলতায় নিজের অস্তিত্বকে জানান দেয়, আমাদেরও তেমনি গতিশীল থাকতে হবে, নিথরতার কোন সুযোগ মুসলমানদের আছে কি?আরেকদিনের ঘটনা-
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বাজারের পাশ দিয়ে গেলেন। এমন অবস্থায় যে, তাঁর দুই পাশে লোকজন ছিল। তারপর তিনি ছোট কানবিশিষ্ট একটি মৃত ছাগল ছানার পাশ দিয়ে গেলেন। তিনি তার কান ধরে বললেন, “তোমাদের কেউ কি এক দিরহামের পরিবর্তে এটাকে নেওয়া পছন্দ করবে?” তারা বললেন, ‘আমরা কোন জিনিসের বিনিময়ে এটা নেওয়া পছন্দ করব না এবং আমারা এটা নিয়ে করবই বা কি?’ তিনি বললেন, “তোমরা কি পছন্দ কর যে, (বিনামুল্যে) এটা তোমাদের হোক?” তারা বললেন, ‘আল্লাহর কাসম! যদি এটা জীবিত থাকত তবুও সে ছোট কানের কারনে দোষযুক্ত ছিল। এখন সে মৃত (সেহেতু একে কে নেবে)?’ তিনি বললেন, “আল্লাহর কসম! তোমাদের নিকট এই মৃত ছাগল ছানাটা যতটা নিকৃষ্ট, দুনিয়া আল্লাহর নিকট তার চেয়ে বেশি নিকৃষ্ট।” (মুসলিম, আবূ দাউদ, আহমাদ)
দুনিয়াতে,দুনিয়ার প্রতি আমাদের দর্শন যদি এমন হয়,তাহলে ‘দুনিয়া’ নামক সুন্দরী রমণীর নজরকাড়া চাহনি আর লাস্যময়ী হাসি কি আমাদের বিভ্রান্ত করতে পারে?
দৃষ্টিভঙ্গীর পরিবর্তন:
একটা মানুষ তার দৃষ্টিভঙ্গিতে পুরো দুনিয়া দেখে এবং ব্যাখ্যা করে। আল্লাহর রাসূল (সঃ) মানুষের দৃষ্টিভঙ্গীর পরিবর্তনে কাজ করে গেছেন। আল্লাহ কেন্দ্রিক এবং আখিরাত চৈন্তিক দৃষ্টিভঙ্গির যে আভা তিনি মানুষের মধ্যে ছড়িয়েছেন তা এখনো হাদীসের বইগুলোর পাতায় পাতায়, বাক্যে-বাক্যে, শব্দে-শব্দে, বর্ণে-বর্ণে দীপ্তি ছড়িয়ে যাচ্ছে।
“দুনিয়া মুমিনদের জন্য জেলখানা এবং কাফিরদের জন্য স্বর্গ”।( মুসলিম)
রাসূল (সঃ)কে স্বল্প কথায় বিস্তৃত এবং গভীর বিষয় বুঝানোর যে একটি মহাগুণ আল্লাহ দান করেছিলেন তার অন্যতম উদাহরণ এ হাদীসটি। আমরা যদি দুচোখ বুঁজে কয়েকটি মুহূর্ত চিন্তা করি তাহলে বুঝব কয়েকটি শব্দে রাসূল কিভাবে মুমিন এবং কাফিরদের জীবন ব্যবস্থার রুপরেখা চিত্রায়িত করেছেন।
একটা জেলখানায় কি ঘটে? একজন লোক সেখানে যাচ্ছেতাই বল্গাহীন স্বাধীনভাবে চলতে পারেনা। তার খাওয়া-দাওয়া, পোষাক-আশাক ততটুকুই হয়, যা একান্ত না হলেই নয়। বিভিন্নরকম কষ্ট তাকে সেখানে ভোগ করতে হয়। আনন্দ, হৈ উল্লাস যেখানে কদাচিৎ।
একদিন মুমিন তেমনি এই দুনিয়াতে যা ইচ্ছা তাই করে বেড়াবে এমন নয়, বরং তাকে আল্লাহ এবং রাসূল প্রদত্ত আইনের বাউন্ডারীতে চলাফেরা করতে হয়। দুনিয়ার হাসি আনন্দ, জৌলুসকে ভুলে আল্লাহকে পাওয়ার আশায়-নেশায় মুমিনরা বিভিন্ন কষ্ট ভোগ করে। সে জানে, তার জন্য তো পরকালে বেহেশতের অফুরন্ত সুখ অপেক্ষা করছে।
অপরদিকে স্বর্গে মানুষ যা ইচ্ছে তাই করে। খাওয়া দাওয়া, পোষাক-আশাক অবারিত। কষ্টের লেশমাত্র যেখানে নেই।হাসি আনন্দ হৈ উল্লাসে মাতোয়ারা চারিদিক।কাফিররা দুনিয়াতে স্বর্গের ন্যায় বল্গাহীন স্বাধীন জীবনে ব্যস্ত। কোন বিধিনিষেধের ধার ধারেনা। নিজের জীবনকে আনন্দময় করার জন্য আল্লাহর নাফরমানী এবং বান্দাদের হয়রানি কোন কিছুতেই পিছপা হয়না।পার্থিব সুখই তার কাছে মূখ্য বাকী সব গৌণ। এই হাদীসে দুনিয়ার প্রতি মুমিনদের দৃষ্টিভঙ্গি কেমন হওয়া উচিৎ তা তুলে ধরেছেন।
“উপরের হাত (দাতার হাত) নিচের (গ্রহীতার) হাত হতে উত্তম” কথাটি যেমন মুসলিমদের সবসময় দাতার ভূমিকায় চিন্তা করার দৃষ্টিভঙ্গী সৃষ্টি করে তেমনি “সে ব্যক্তি সফলকাম, যে ইসলাম গ্রহণ করেছে, তাকে পরিমিত রূযী দেওয়া হয়েছে এবং আল্লাহ তাকে যা দিয়েছেন তাতে তাকে তুষ্ট করেছেন ।” হালাল রুজি অল্প হলেও তুষ্ট থাকার প্রেরণা যোগায়।
রাসূলের প্রতি ভালোবাসা ঈমানের পরিপূর্ণতা:
আল্লাহ এবং রাসূলের প্রতি ভালোবাসা ঈমানের দাবী এবং গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ।রাসূল নিজেই বলেছেন-
‘তোমাদের মধ্যে কেউই ঈমানদার হতে পারবে না, যে পর্যন্ত নিজ পিতা, পুত্র ও অন্যান্য লোক অপেক্ষা আমার সাথে অধিক ভালবাসা না রাখে। (বুখারী ও মুসলিম)
হাদীসের বিভিন্ন জায়গায় আল্লাহ রাসূলের সাহাবারা তাকে ভালোবেসে কিভাবে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন তা দুচোখ মেলে দেখতে পাই। তাই আল্লাহ রাসূল আমাদের কাছ থেকে তার ব্যাপারে কেমন ভালোবাসা চান, কিংবা পাওয়ার যোগ্য সে ব্যাপারে হাদিসছাড়া অন্য কোন সঠিক উৎস আছে কি?
হযরত আবদুর রহমান বিন আবি কিরাদ বলেনঃ একদিন রাসুলুল্লাহ (সা) ওযু করলেন। তখন তাঁর কিছু সাহাবী তার ওযুর পানি হাতে নিয়ে নিজেদের মুখমণ্ডলে মাখাতে লাগলেন। তা দেখে রাসূল (সা) বললেন কিসের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে তোমরা এ কাজ করলে? তারা বললেন আল্লাহ ও তার রাসূলের ভালোবাসা। [মিশকাত]
ব্যবসা বানিজ্য, লেনদেন ও বিভিন্ন অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের ক্ষেত্রে:
মানুষের জীবনের একটা অন্যতম অংশ ব্যবসা বানিজ্য লেনদেন সংক্রান্ত। আজকের যুগে পদস্ফলনের জায়গা গুলোর মধ্যে এটি অন্যতম। এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় সংস্কার নিয়ে আসতে পারলে বৈশ্বিক অনেক সমস্যার সমাধানও অনায়াসে সম্ভব। এ বিষয়ে অসংখ্য গুরুত্বপূর্ণ দিক নির্দেশনা আল্লাহর রাসূল দিয়ে গেছেন।
হযরত রাফে বিন খাদীজ (রা) বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ (সা) কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, কোন উপার্জন সর্বাধিক পবিত্র? রাসূল(সা) বললেন, মানুষের নিজ হাতের কাজ এবং যে ব্যবসায় মিথ্যাচার বেঈমানী থেকে মুক্ত। (মেশকাত)
রাসুলুল্লাহ (সা) বলেছেন, আল্লাহ সেই ব্যক্তির ওপর অনুগ্রহ ও রহমত বর্ষণ করুন, যে ক্রয়ে বিক্রয়ে ও নিজের দেয়া ঋণ আদায়ে নমনীয় ও উদার আচরণ করে। (বোখারী)
অন্যান্য আরো বিভিন্ন অর্থনৈতিক কর্মকান্ড এবং লেনদেনে আল্লাহর রাসূলের সুস্পষ্ট নির্দেশ ও নিষেধাজ্ঞা আছে।
মানবাধিকার,শ্রমিক অধিকার, প্রাণী অধিকার ও পরিবেশ আন্দোলনসহ বিভিন্ন আধুনিক আন্দোলনকে গতিশীল করা:
আজকের যুগে শিরোনামে উল্লেখিত বিষয়গুলো সবচেয়ে বেশী আলোচিত। ইসলাম তার জন্মলগ্ন থেকে এ সকল বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান নিয়ে আসছে। তৎকালীন ‘দাস প্রথা’ নামক মানবতা হরণকারী প্রথাকে রাসূল আস্তে আস্তে বিলুপ্তির রুপরেখা দিয়ে যান। মানুষকে তাদের মৌলিক অধিকার খাদ্য,বস্ত্র,বাসস্থান ইত্যাদির ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ দিক নির্দেশনাও দিয়ে যান।
রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেনঃ কেয়ামতের দিন আল্লাহ তায়ালা বলবেনঃ হে আদম সন্তান! আমি তোমার কাছে খাবার চেয়েছিলাম। কিন্তু তুমি আমাকে খাওয়াওনি। সে বলবে হে আমার প্রতিপালক, আমি তোমাকে কিভাবে খাওয়াবো? তুমি তো সর্ব জগতের প্রতিপালক। আল্লাহ বলবেনঃ তুমি কি জানো না, তোমার কাছে আমার অমুক বান্দা খাবার চেয়েছিল। কিন্তু তুমি তাকে খাওয়াওনি? তুমি কি জানো না, তুমি তাকে খাওয়ালে তা আজ এখানে আমার কাছে পেতে? হে আদম সন্তান, আমি তোমার কাছে পানি চেয়েছিলাম, কিন্তু তুমি আমাকে পানি পান করাওনি। সে বলবে হে আমার প্রতিপালক, আমি তোমাকে কিভাবে পানি পান করাবো?তুমি তো সারা বিশ্বের প্রতিপালক। আল্লাহ বলবেন আমার অমুক বান্দা তোমার কাছে পানি চেয়েছিল কিন্তু তুমি তাকে পানি দাওনি। তুমি যদি তাকে পানি দিতে তবে সেই পানি আজ আমার এখানে পেতে। (মুসলিম)
বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিক থেকে চাঙ্গা শ্রমিক আন্দোলন এবং আজ অবধি বিভিন্ন শ্রমিক আন্দোলনের ক্ষেত্রে ইসলামের রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ পথ নির্দেশ।
.রাসূলুল্লাহ(সা) বলেছেনঃ যে, আল্লাহ তায়ালা বলেছেনঃ আমি কেয়ামতের দিন তিন ব্যক্তির বিরুদ্ধে বাদী হবোঃ এক, যে ব্যক্তি আমার নাম নিয়ে কোন চুক্তিতে আবদ্ধ হয় এবং তারপর তা ভঙ্গ করে। দুই, যে ব্যক্তি কোন সম্ভ্রান্ত ও স্বাধীন ব্যক্তিকে (অপহরণ করে) বিক্রি করে দেয় এবং তার পণ্যের অর্থ আত্নসাত করে। তিন, যে ব্যক্তি কোন শ্রমিককে নিয়োগ করলো, তার কাছ থেকে পুরো কাজ আদায় করলো, অতঃপর কাজ আদায় করার পর তাকে মজুরী দিল না। (বোখারী)
পশ্চিমারা এখন প্রাণী রক্ষার যে আন্দোলন করছে,আরো বছর ‘শ আগেই আশরাফ আলী থানবী (রহঃ) মত ইসলাম বিশেষজ্ঞরা এগুলোকে এড্রেস করে বই লিখে গেছেন। শেখ কারদাওয়ীসহ অন্যান্য বিশেষজ্ঞরা হাদীসের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে কাজ করে যাচ্ছেন। পরিবেশ রক্ষার ক্ষেত্রে বৃক্ষরোপনের উপরও সবিশেষ গুরুত্ব আছে হাদীসের বইগুলোতে।
আনাস রা. থেকে বর্ণিত, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘যে কোন মুসলমান কোন বৃক্ষ রোপণ করে, কোন শস্য চাষ করে। অতঃপর তা থেকে কোন পাখি বা মানুষ অথবা কোন জন্তু-জানোয়ার খাবার খায়, তাহলে এটা তার জন্য ছদকাহ হিসেবে আল্লাহর কাছে গ্রহণ করা হয়।
কমিউনিটি ডেভেলপমেন্ট:
আল্লাহ রাসূল (সঃ) সমাজকে স্থিতিশীল রাখার জন্য এবং সমাজকে উন্নততর করার নিমিত্তে অনেকগুলোর দিক নির্দেশনা দিয়ে গেছেন। আজকের যুগেও একটি যথাযথ মানানসই মুসলিম সমাজ গঠনে আল্লাহ রাসূলের হাদীসের ভূমিকা অতুলনীয় হতে পারে।
“এক মুমিন অন্য মুমিনের আয়না এবং এক মুমিন অন্য মুমিনের ভাই।“
রাসূলুল্লাহ (সঃ) আরো বলেছেন, তুমি তোমার ভাইয়ের সাহায্য করো। চাই সে যালিম হোক বা মযলুম। এক ব্যক্তি জিঙ্গেস করলো, হে আল্লাহর রাসূল।মযলুম হলে আমি তাকে সাহায্য করবো। কিন্তু যালিম হলে আমি তাকে কিভাবে সাহায্য করবো? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উত্তরে বললেন তাকে অত্যাচার করা হতে বিরত রাখবে। আর এটাই হলো তাকে সাহায্য করা। (বুখারী, মুসলিম)
সেই মুসলিম সমাজে শুধু মুসলিমরা সানন্দে- নিরাপদে থাকবে, বিষয়টা এমন নয়।বরং অমুসলিম সমাজ তাদের যথাযথ মর্যাদা নিয়ে থাকতে পারবে।তাদের প্রতিটি সদস্যই অনুভব করবে পার্থিব পরিবেশেই স্বর্গীয় নিরাপত্তা।
রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেন, মনে রেখো যদি কোন মুসলমান কোন অমুসলিম নাগরিকের উপর নিপীড়ন চালায়। তার অধিকার খর্ব করে। তার কোন বস্তু জোরপূর্বক ছিনিয়ে নেয়। তাহলে কিয়ামতের দিন আমি আল্লাহর আদালতে তার বিরুদ্ধে অমুসলিম নাগরিকের পক্ষ অবলম্বন করবো।–আবু দাউদ
সভ্য ও নৈতিক সমাজ গঠন:
কোরআনে নূন্যতম চার জায়গায় এসেছে, রাসূল (সঃ) এর উপর অর্পিত একটি অন্যতম দায়িত্ব হল মানুষদের জীবনকে পরিশুদ্ধ করা। আল্লাহ রাসূলের সময়ে আরবে যাচ্ছেতাই অবস্থা ছিল। কেউ নীতি নৈতিকতার ধার ধারত না। মদ,জুয়া,অশ্লীলতা, বেহায়াপনা ছিল তাদের জীবনের অংশ। রাসূল (সঃ) আস্তে আস্তে তাদের জীবনের প্রতিটি পরতে পরতে কিভাবে পরিবর্তন আনলেন তার পূর্নাংগ বিবরণ হাদীসে সংরক্ষিত আছে। আরব বেদুঈনদের মত মানুষদের কিভাবে আস্তে আস্তে সভ্যতার আলোতে নিয়ে এসেছিলেন, তার রুপরেখা হাদীসে আছে এবং সেই সূত্র ধরে একসময় আফ্রিকার মত অংশগুলো সভ্য সমাজে পরিণত হয়। এখনো কুসংস্কারমুক্ত সভ্য ও নৈতিক বলে বলীয়ান সমাজ গঠনে হাদিসের ভূমিকা অপরিসীম।
কোরআনের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে হাদীসের ভূমিকা:
“আগের রসূলদেরকেও আমি উজ্জ্বল নিদর্শন ও কিতাব দিয়ে পাঠিয়েছিলাম এবং এখন এ বাণী তোমার প্রতি নাযিল করেছি, যাতে তুমি লোকদের সামনে সেই শিক্ষার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করে যেতে থাকো৷ যা তাদের জন্য অবতীর্ণ করা হয়েছে”। সূরা নাহল-৪৪
আল্লাহ একজন মানুষকে কেন নবী করে পাঠালেন? একজন মানুষকেই নবী বানিয়ে পাঠানোর পেছনে যে নিগূঢ় যৌক্তিকতা নিহিত ছিল মহান আল্লাহ সে যৌক্তিকতা ও বর্ণনা করে দিয়েছেন। আল্লাহর বাণী ফেরেশতাদের মাধ্যমেও পাঠানো যেতো । সরাসারি ছাপিয়ে প্রত্যেকটি মানুষের হাতেও পৌঁছানো যেতে পারতো । কিন্তু যে উদ্দেশ্যে মহান আল্লাহ স্বীয় সুগভীর প্রজ্ঞা, করুণা ও সার্বভৌম কর্তৃত্বের আলোকে এ ওহী অবতারণের মাধ্যমে প্রকৃতপক্ষে যে উদ্দেশ্য সাধন করতে চেয়েছিলেন শুধুমাত্র ছাপানো একখানা গ্রন্থ বা পুস্তিকা পাঠিয়ে দিলেই সে উদ্দেশ্য পূর্ণ হতে পারতো না । এ উদ্দেশ্য পূর্ণ করার জন্য যা অপরিহার্য ছিল তা হলো একজন যোগ্যতম মানুষ তা সাথে করে নিয়ে আসবেন, তিনি তাকে একটু একটু করে লোকদের সামনে পেশ করবেন । যারা এর কানো কথা বুঝতে পারবে না তাদেরকে তার অর্থ বুঝিয়ে দেবেন। নিজের জীবনকে তাদের সামনে আদর্শ হিসেবে পেশ করবেন । তাদেরকে ব্যক্তিগত ও সামষ্টিক পর্যায়ে অনুশীলন দান করে সারা দুনিয়ার সামনে এমন একটি সমাজকে আদর্শ হিসেবে তুলে ধরবেন যার সমগ্র সামাজিক ব্যবস্থা হবে এর উদ্দেশ্যের বাস্তব ব্যাখ্যা । [তাহফীমুল কোরআন]
আল্লাহ রাসূলের পুরো জীবনটাই পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে হাদীসে লিপিবদ্ধ আছে। তিনি ছিলেন কোরআনের ভাষ্যকার। তাই ১৫০০ বছর পরে এসেও যদি আমরা কোরআন বুঝতে চাই হাদীসের কোন বিকল্প নেই। আয়েশা রাঃ আল্লাহর রাসূল সম্পর্কে বলেছেন ‘রাসূলুল্লাহ (সঃ)’র চরিত্র হল কুরআন।
ইমাম শাফেয়ী (রহঃ)‘সম্পূর্ণ হাদীস কুরআনেরই ব্যাখ্যা”। কোরআনের বিখ্যাত মুফাসসির ইবনে কাসীর লিখেছেন-“তুমি হাদীসের অনুসরণ কর। কেননা হাদীস হল কুরআনের ব্যাখ্যা’।
ইমাম আবু হানিফা (রাঃ) বলেন- ‘যদি হাদীস না হত তাহলে আমাদের কেউ কুরআন বুঝত না’। নামায,রোযা,হজ্জ,যাকাত সহ কোরআনের আদেশ নিষেধগুলোর পরিপূর্ণ ব্যাখ্যা আমরা হাদীস থেকেই পাই।
নতুন সভ্যতা বিনির্মাণে:
সপ্তম থেকে একাদশ শতাব্দী পর্যন্ত যে ইসলামী সভ্যতা আমাদের দৃষ্টিগোচর হয়,তার ক্ষেত্র তৈরিতে রাসূল (সঃ) এর প্রতিটি পদক্ষেপের ছিল অসামান্য ভূমিকা। যেখানে আল্লাহর রাসূলের নবুওয়াতকালে হাতে গোণা কয়েকজন মানুষ পড়ালেখা জানত সেখানে অল্প কয়েক বছরের মধ্যে প্রায় শতভাগ অক্ষরজ্ঞান সম্পন্ন মানুষের যে রাজ্য আমরা ইতিহাসের পাতায় দেখছি তা পুরোপুরি রাসূলের কার্যক্রমেরই ফলাফল। বদরের বন্দীরের শিক্ষার বিনিময়ে মুক্তি, বারবার জ্ঞানের ফজিলত সম্পর্কে মানুষকে বলা এবং সর্বোপরি ‘জ্ঞানার্জন করার প্রত্যেক মুসলিম নরনারীর জন্য ফরয’ নামক বিপ্লবী সমাজপরিবর্তনকারী বচনগুলো ইসলামী সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়েছে। কোরআনে হাদিসকে ইঙ্গিত করে ‘হিকমাহ’ শব্দটির ব্যবহার করে জ্ঞান বিজ্ঞানের প্রসারের ব্যাপক ক্ষেত্র তৈরি হয়। ‘আল্লাহ এমন কোন রোগ সৃষ্টি করেননি যার ঔষধ তিনি সৃষ্টি করেননি’ মত হাদীসগুলো দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েই সৃষ্টি হয়েছিল ইবনে সিনারা। কোরআন এবং তার বিশদ ব্যাখ্যা হাদীসকে সাথে নিয়ে যদি আবার চলা যায় তাহলে ইসলাম সভ্যতার নতুন বিনির্মাণ ঘটবে।
ইসলামী চিন্তাপ্রসারে বাস্তব কৌশলগত সিদ্ধান্ত নেয়ার ব্যাপারে:
আল্লাহ রাসূল, শুরুতে একজন মাত্র লোক আস্তে আস্তে দাওয়াত দেয়া শুরু করলেন। ২৩ বছরের ব্যবধানে সোয়া লাখ লোকের সমাগমে বিদায় হজ্জের ভাষণ দেন। সেই মোমেন্টামকে ধারণ করে আরো এক যুগের মধ্যে প্রায় অর্ধপৃথিবীতে ওমরের করতলে চলে আসে। এই অভাবনীয় সাফল্যের ব্যাপারে রাসূলের কর্মকান্ড ও কৌশলগুলো কেমন ছিল? ইসলাম নামক অগ্নিস্ফুলিঙ্গটি কিভাবে শিখায় পরিণত হয়ে দিকবিদিক আলোকিত করে তার পূর্ণ নকশা হাদীসে এখনো বর্তমান। বর্তমানেও যে কোন পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে হাদীসের বিষয়গুলো সামনে রাখলে কৌশলের ধারণা পাওয়া যাবে। কোন বিষয়টাকে প্রয়োরিটি দিতে হবে কাকে স্থগিত রাখতে হবে সব কিছুর ধারণাই হাদীসে আছে। যেমন আয়েশা রাঃ বর্ণনা করেন,আল্লাহ রাসূল যদি প্রথমেই মদের ব্যাপারে বলতেন তাহলে অনেক লোক ইসলামেই আসত না। এরকম আরো অসংখ্য হাদীস থেকে আল্লাহ রাসূলের কৌশলগত কর্মকান্ডগুলোর ধারণা পাই, যেখানে তিনি পাবলিক সাইকোলজিকে বিবেচনায় রেখেই কাজ করেছিলেন।
ভবিষ্যতের পানে,আশাবাদীতার সাথে:
আল্লাহর রাসূল আরো সাড়ে চৌদ্দশ বছর আগে বসে আজকের বিশ্বব্যবস্থা নিয়ে বলে গেছেন,নির্দেশনা দিয়ে গেছেন এবং এই বিষয়গুলোর বিস্তৃতি সুদূর কেয়ামত পর্যন্ত। আল্লাহ রাসূল মুসলিমদের রাজনৈতিক উত্থান পতন নিয়ে যেমন বলে গেছেন, তেমনি বলে গেছেন মুসলিমদের সংখ্যা বৃদ্ধি বিষয়ে। তিনি বলেছেন-
রাত ও দিন যতদূর পৌঁছেছে এ ধর্মও ততদূর পৌঁছে যাবে। কোন পশমনির্মিত তাঁবু (শহুরে বাড়ী) অথবা মাটির ঘর (গ্রাম্য ঘর) কোনটাই বাদ থাকবে না; আল্লাহ তাআলা সর্বগৃহে এই ধর্মকে প্রবেশ করাবেন। সম্মানীর ঘরে সম্মানের সাথে, অসম্মানীর ঘরে অসম্মানের সাথে। যে সম্মানের মাধ্যমে আল্লাহ ইসলামকে গৌরবময় করবেন এবং যে অপমানের মাধ্যমে আল্লাহ কুফরকে অপমানিত করবেন। [মুসনাদে আহমাদ (১৬৩৪৪), সিলসিলা সহিহা গ্রন্থে আলবানী হাদিসটিকে সহিহ আখ্যায়িত করেছেন]
মুসলমানরা শত জুলুম নির্যাতনেও আশায় বুক বেঁধে থাকে। তারা জানে ইসলাম সকল কিছুর উপর বিজয়ী হবে। ঈসা নবী এবং ইমাম মাহদী এসে তাদের নেতৃত্ব দেবে। প্রত্যেকটা মুসলমানের দিলে এই কনফিডেন্স আল্লাহর রাসূল দিয়ে যেতে সমর্থ হয়েছেন- “আগামী দিনের সূর্যটা ইসলামের…”
আসলে হাদীসের প্রয়োজনীয়তা এই সংক্ষিপ্ত পরিসরে ইতি টানা সম্ভব নয়। আমি হাদীসের ব্যাপারে আমার কিছু অনুভূতি ব্যক্ত করলাম মাত্র। আমরা যদি হাদীসের মহাসাগরে কিছুটা হলেও নিজেকে ভাসিয়ে দিতে পারি,তাহলে উপলব্ধি করব “হাদীস তো আসলে বায়ু, কোথায় তার উপস্থিতি নেই? প্রয়োজনীয়তা নেই”?