৭ চক্র ধ্যান, এনার্জি হিলিং বা Nerve Plexus Meditation: নামায ও অন্যান্য ইবাদাতে মনোযোগ ফেরাতে ইউজ করা যাবে কি?
বিষয়টি আলোচনার আগে আরও কিছু বিষয় জানতে হবে। জানতে হবে চক্র বিশ্বাসের উৎপত্তি ও গোড়ার কথা। চলুন জেনে আসি…..
* চক্র বা প্লেক্সাসে বিশ্বাসের উৎপত্তি ও বিবর্তন:
চক্র ধারণাটি একটি জটিল আধ্যাত্মিক ব্যবস্থার অংশ, যার শিকড় প্রাচীন ভারতীয় ধর্ম ও দর্শনে নিবদ্ধ। এর উৎপত্তি একটি মাত্র গ্রন্থ বা সময়ে হয়নি, বরং শতাব্দী জুড়ে বিকশিত হয়েছে।
১. প্রাচীনতম উৎস: বেদ ও উপনিষদ
· মৌলিক ধারণা: “চক্র” শব্দটির আক্ষরিক অর্থ “চাকা” বা “বৃত্ত”। প্রাচীনতম হিন্দু ধর্মগ্রন্থ বেদ-এ (খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০-৫০০ অব্দ) এই শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে সূর্যের রথের চাকা বা রাজ্যের প্রাধান্য বোঝাতে।
· দার্শনিক ভিত্তি: পরবর্তী সময়ের উপনিষদ-গুলোতে (খ্রিস্টপূর্ব ৮০০-২০০ অব্দ) শারীরবৃত্তির চেয়ে দার্শনিক ধারণা হিসেবে চক্রের বিকাশ ঘটে। এগুলোকে দেখা হতো প্রাণ (জীবনশক্তি) প্রবাহের কেন্দ্র হিসেবে। শরীরের ভিতরে সূক্ষ্ম-শরীরের (সূক্ষ্ম শরীর) অংশ হিসেবে চক্রের ধারণা স্পষ্ট হতে থাকে।
· প্রথম উল্লেখ: ঋগ্বেদ-এ “চক্র” হিসেবে এর উল্লেখ থাকলেও, আধ্যাত্মিক শক্তি কেন্দ্র হিসেবে চক্রের স্পষ্ট ধারণা প্রথম পাওয়া যায় অথর্ববেদ-এ।
২. ক্লাসিকাল পর্ব: তন্ত্রযুগে পরিপক্বতা
চক্র ব্যবস্থা তার পূর্ণাঙ্গ রূপ পায় তন্ত্র সাহিত্যের মাধ্যমে (খ্রিস্টপূর্ব ৫০০ অব্দ – খ্রিস্টাপূর্ব ৫০০ অব্দ)।
· তন্ত্রের প্রভাব: তন্ত্র হলো একটি জটিল আধ্যাত্মিক প্রথা যা শক্তি (নারীশক্তি) উপাসনাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। তন্ত্রে দৈহিক সাধনা, মন্ত্র, ও যোগের মাধ্যমে মোক্ষলাভের ওপর জোর দেওয়া হয়।
· সমন্বিত ব্যবস্থা: এই যুগেই প্রধান ৭টি চক্র, তাদের অবস্থান, রং, দল, মন্ত্র এবং কুন্ডলিনী শক্তি-এর সাথে তাদের যোগাযোগ একটি সুসংহত ব্যবস্থায় রূপ পায়।
· মূল গ্রন্থ: শাত-চক্র-নির্দপন (“ছয় চক্রের বিবরণ”) এবং ঘেরন্ড সংহিতা-এর মতো গ্রন্থগুলোতে চক্র ব্যবস্থার বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে।
৩. চক্র বিশ্বাসের সাথে কুন্ডলিনী ও শিবের যোগসূত্র:
‘কুণ্ডলিনী’ শব্দটি এসেছে সংস্কৃত শব্দ ‘কুণ্ডল’ থেকে, যার অর্থ হলো ‘কুণ্ডলী পাকানো’ বা ‘পেঁচানো’। এই নামটির সাথে সাপের কুণ্ডলী পাকিয়ে থাকার সরাসরি মিল রয়েছে। যোগশাস্ত্র অনুসারে, কুণ্ডলিনী শক্তি মানুষের মেরুদণ্ডের একদম নিচে অবস্থিত মূলাধার চক্রে (Root Chakra) একটি নিদ্রিত সাপের মতো তিন থেকে সাড়ে তিনবার কুণ্ডলী পাকিয়ে সুপ্ত অবস্থায় থাকে।
সাপ যেমন কুণ্ডলী পাকিয়ে শান্তভাবে শুয়ে থাকে, ঠিক তেমনি এই কুণ্ডলিনী শক্তিও মানুষের মধ্যে ঘুমন্ত অবস্থায় থাকে। এটি এমন এক বিশাল শক্তি যা সাধারণত অনাবৃত হয় না। সাপের ঘুম ভাঙা এবং উঠে দাঁড়ানো (ছোবল মারার জন্য বা চলতে শুরু করার জন্য) কুণ্ডলিনী শক্তির জাগরণ এবং উর্ধ্বমুখী যাত্রার প্রতীক।
যোগী বা সাধকের নিয়মিত যোগাভ্যাস, ধ্যান ও প্রাণায়ামের মাধ্যমে যখন এই শক্তি ‘জাগ্রত’ হয়, তখন এই শক্তিকে মেরুদণ্ডের মধ্যে দিয়ে থাকা সুষুম্না নাড়ীর পথে উপরের দিকে চালিত করা হয়। সাপ যেমন কুণ্ডলী ছেড়ে সোজা হয়ে উঠে আসে, তেমনি এই শক্তি মেরুদণ্ডের মধ্য দিয়ে মূলাধার থেকে সহস্রার চক্র পর্যন্ত ছয়টি চক্রকে ভেদ করে উপরে ওঠে, যা আধ্যাত্মিক মুক্তি বা আলোকপ্রাপ্তির দিকে নিয়ে যায়।
★ শিবের সাথে মিলন: হিন্দুধর্মে কুণ্ডলিনী শক্তিকে দেবী বা ‘শক্তি’র রূপ হিসেবে দেখা হয় এবং তন্ত্র সাধনা মূলত মহাদেব শিবকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে। ভগবান শিবকে প্রায়শই গলায় সাপ পরিহিত অবস্থায় দেখা যায়। কুন্ডলিনী সাধনার লক্ষ্য হল এই সুপ্ত শক্তিকে জাগ্রত করে স্পাইনের মধ্য দিয়ে ঊর্ধ্বমুখী করে মস্তিষ্কের সহস্রার চক্রে পৌঁছানো। সেখানে এর মিলন হয় শিব-এর (পরম চৈতন্যের প্রতীক) সাথে। এই মিলনই হলো মোক্ষ বা চূড়ান্ত মুক্তি ও আধ্যাত্মিক জ্ঞানের অবস্থা। সুতরাং, শিব ও কুন্ডলিনীর (শক্তির) মিলনই হলো সৃষ্টির মৌলিক দ্বৈততার (পুরুষ ও প্রকৃতি) মিলন।
৪. বৌদ্ধ ও অন্যান্য প্রভাব
· তিব্বতি বৌদ্ধধর্ম: বৌদ্ধধর্ম, বিশেষ করে বজ্রযান (তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্ম) ও তিব্বতি বৌদ্ধধর্ম, চক্র ব্যবস্থাকে গভীরভাবে গ্রহণ করে এবং তাদের নিজস্ব উপায়ে রূপান্তরিত করে।
· New Age Spirituality Movement: বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় থেকে পশ্চিমা সংস্কৃতিতে যখন ভারতীয় আধ্যাত্মিকতা ও যোগ (Yoga) এর জনপ্রিয়তা বাড়ে, তখন চক্রের ধারণাটিও জনপ্রিয়তা লাভ করে। নিউ এইজ স্পিরিচুয়ালিটি এই প্রাচীন ধারণাটিকে গ্রহণ করে এবং এটিকে মনোবিজ্ঞান ও psychosomatic (মনের সাথে শারীরিক রোগের সম্পর্ক) থেরাপির সাথে যুক্ত করে ব্যাখ্যা করে। একে রোগ নিরাময় (Healing), ভারসাম্য আনয়ন ও ব্যক্তিগত বিকাশের একটি সরঞ্জাম হিসেবে ব্যবহার করে থাকে। এমনকি তারা এর ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট থেকেও একে বিচ্ছিন্ন করে একটা সায়েন্টিফিক Healing পদ্ধতি হিসেবে উপস্থাপনের চেষ্টা করে।
* ৭ চক্র ও সংশ্লিষ্ট Nerve Plexus: নিউ এইজ স্পিরিচুয়ালিটিতে এই ৭ চক্রকে বৈজ্ঞানিক-সদৃশ ভাষায় Energy, Vibration, nerve plexus ইত্যাদি যুক্ত করে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করা হয়। এখানে সংক্ষেপে তা উপস্থাপন করা হলো—
★ ৭ চক্রের হিন্দু নাম ও সংশ্লিষ্ট নার্ভ প্লেক্সাস:
১. মূলাধার (Root Chakra): Coccygeal Plexus
২. স্বাধিষ্ঠান (Sacral Chakra): Sacral Plexus
৩. মণিপুর (Solar Chakra): Solar Plexus
৪. অনাহত (Heart Chakra): Cardiac Plexus
৫. বিশুদ্ধ (Throat Chakra): Cortical Plexus
৬. আজ্ঞা (Third Eye Chakra): Carotid Plexus
৭. সহস্রার (Crown Chakra): Cerebral Cortex
নিউ এইজ ধারণায়, চক্র ব্যবস্থাকে একটি “বায়ো-এনার্জি সিস্টেম” হিসাবে উপস্থাপন করা হয়, যা ৩ টি মূল ধারণার উপর দাঁড়িয়ে আছে-
1. Vibration (কম্পন):
প্রতিটি চক্র একটি নির্দিষ্ট আবেগিক ও আধ্যাত্মিক কম্পাঙ্কে (frequency) vibrating হয়। যেমন: হৃদয় চক্র (Anahata) ‘প্রেম’ এর উচ্চ কম্পাঙ্কে vibrating হয়, অন্যদিকে মূল চক্র (Muladhara) ‘নিরাপত্তাহীনতা’ এর নিম্ন কম্পাঙ্কে vibrating হতে পারে।
2. Energy (শক্তি):
– চক্রগুলি হচ্ছে শক্তি (Energy) এর কেন্দ্র বা প্রবাহপথ।
– শরীরের ভিতর একটি মৌলিক জীবনশক্তি (যাকে ‘প্রাণ’ বা ‘কুন্ডলিনী’ বলা হয়) এই চক্রগুলির মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়।
– চক্র যখন কোন কারণে ব্লক বা ভারসাম্যহীন হয়, তখন শক্তির প্রবাহ বাধাপ্রাপ্ত হয়, যা শারীরিক ও মানসিক সমস্যা সৃষ্টি করে। তা থেকেই অমনোযোগ ও বিভিন্ন রোগের সৃষ্টি হয় বলে মনে করা হয়।
3. Nerve Plexus (স্নায়ু জালিকা):
– প্রতিটি “শক্তি কেন্দ্র” (চক্র) কে শরীরের একটি বাস্তব nerve plexus ও এন্ডোক্রাইন গ্রন্থির সাথে যুক্ত করা হয়।
– এটি একটি রূপক (Metaphor) হিসাবে কাজ করে, যাতে এই ‘অদৃশ্য শক্তি সিস্টেম’কে বোধগম্য শারীরবৃত্তীয় structure-এর সাথে relatable করা যায়।
– উদাহরণ: মণিপুর চক্র Solar Plexus স্নায়ু জালিকার সাথে যুক্ত, যা আত্মবিশ্বাস নিয়ন্ত্রণ করে বলে ধরা হয়। অনাহত চক্র কার্ডিয়াক প্লেক্সাস ও থাইমাস গ্রন্থির সাথে যুক্ত, যা প্রেম ও সমবেদনার সাথে সম্পর্কিত বলে মনে করা হয়।
নিউ এইজ-এর ভাষ্য অনুযায়ী, আপনার নেগেটিভ ভাবনা ও আবেগ নিম্ন কম্পাঙ্কের vibration সৃষ্টি করে, যা সংশ্লিষ্ট চক্রে এনার্জি ব্লকেজ সৃষ্টি করে এবং পরিণামে সেই চক্রের সাথে সংযুক্ত স্নায়ু ও গ্রন্থির কার্যক্রম বিঘ্নিত করে। যা থেকেই অমনোযোগ ও বিভিন্ন শারীরিক রোগ সৃষ্টি হয়।
অন্যদিকে ধ্যান, ইতিবাচক চিন্তা ইত্যাদির মাধ্যমে আপনি চক্রের vibration ও Energy প্রবাহ ঠিক করে শরীর-মন সুস্থ রাখতে পারেন বলে তাদের বিশ্বাস।
* ৭ চক্র ধ্যানের এই তত্ত্ব কি বিজ্ঞান সমর্থন করে?
এই ব্যাখ্যাটি বৈজ্ঞানিকভাবে অত্যন্ত দুর্বল বা অগ্রহণযোগ্য। কারণ—
√ প্রত্যক্ষ প্রমাণের অভাব: চক্র বা কুন্ডলিনী শক্তির কোনও প্রত্যক্ষ শারীরবৃত্তীয় অস্তিত্ব (যেমন একটি অঙ্গ বা স্নায়ুর মতো) বিজ্ঞান কখনও খুঁজে পায়নি। এগুলো অদৃশ্য “শক্তি কেন্দ্র” বলে দাবি করা হয়, যা বর্তমান বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি দিয়ে শনাক্তযোগ্য নয়।
√ এন্ডোক্রাইন গ্রন্থির সাথে অতিসরলীকৃত সংযোগ: নিউ এইজ ব্যাখ্যা চক্রগুলোর সাথে নির্দিষ্ট এন্ডোক্রাইন গ্রন্থিকে (যেমন, অ্যাড্রিনাল-মূলাধার, পিটুইটারি-সহস্রারা) ম্যাপ করে। কিন্তু এই গ্রন্থিগুলোর কার্যক্রম অত্যন্ত জটিল এবং একে অপরের ওপর নির্ভরশীল। একটি মাত্র “এনার্জি সেন্টার” দ্বারা এদের নিয়ন্ত্রিত হওয়ার ধারণা এন্ডোক্রাইনোলজি বিজ্ঞানের সাথে খুবই সরল ও অসঙ্গতিপূর্ণ।
· উদাহরণ: অ্যাড্রিনাল গ্রন্থি শুধু টিকে থাকা নিয়ন্ত্রণ করে না, এটি metabolism, রক্তচাপ এবং Inflammation নিয়ন্ত্রণেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। একে শুধু “ভয় ও নিরাপত্তার” সাথে জড়িত করা বৈজ্ঞানিক সত্যকে অতিসরলীকরণ করা।
√ পিনিয়াল গ্রন্থির রহস্যায়ন: “থার্ড আই” চক্রকে প্রায়ই পিনিয়াল গ্রন্থির সাথে যুক্ত করা হয় এবং একে “আধ্যাত্মিক গ্রন্থি” বলে উল্লেখ করা হয়। বৈজ্ঞানিকভাবে, পিনিয়াল গ্রন্থির প্রধান ও প্রমাণিত কাজ হলো মেলাটোনিন হরমোন নিঃসরণ এর মাধ্যমে ঘুমের চক্র নিয়ন্ত্রণ। এর আধ্যাত্মিক বা অতীন্দ্রিয় ক্ষমতা সম্পর্কিত কোন প্রমাণ বিজ্ঞানের কাছে নেই।
* চক্র-ধ্যান ও ইসলামি বিশ্বাসের মৌলিক সংঘাত:
ইসলামের দৃষ্টিতে চক্র বিশ্বাস বা এ ধরনের যেকোনো আধ্যাত্মিক প্রথা গ্রহণযোগ্য নয়। অন্য ধর্ম থেকে আগত বিশ্বাস ও রীতিনীতি পালন করা একটি গুরুতর গুনাহ এবং শির্কের দিকে নিয়ে যেতে পারে। কুরআন, হাদিস এবং ইসলামিক স্কলারদের মতামত এই ব্যাপারে খুবই স্পষ্ট।
* কুরআনের স্পষ্ট নির্দেশনা:
√ সূরা আল-বাকারাহ (২:১৬৮): “হে মানুষ! পৃথিবীতে যে হালাল ও পবিত্র বস্তু রয়েছে, তা আহার কর এবং শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করো না। নিশ্চয় সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু।”
√ সূরা আল-মুমিনুন (২৩: ৪৪): “এরপর আমরা একের পর এক আমাদের রাসূলগণকে প্রেরণ করেছি। যখনই কোন জাতির কাছে তার রাসূল এসেছেন তখনই তারা তার প্রতি মিথ্যারোপ করেছে। অতঃপর আমরা তাদের একের পর এককে ধ্বংস করে তাদেরকে কাহিনীর বিষয় করে দিয়েছি। কাজেই যারা ঈমান আনে না সে সমস্ত সম্প্রদায়ের জন্য ধ্বংসই রইল!”
এই আয়াতগুলো থেকে স্পষ্ট যে, শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ বলতে শয়তানের ডাকে সাড়া দিয়ে সকল প্রকারের গোমরাহী ও ভ্রষ্টতাকে বোঝানো হয়েছে, যার মধ্যে অন্য ধর্মের মিথ্যা বিশ্বাস ও রীতিও অন্তর্ভুক্ত।
* রাসূলুল্লাহ ﷺ এর সতর্কবার্তা:
হাদিসে রাসূলুল্লাহ ﷺ স্পষ্ট ভাষায় অন্য ধর্মের অনুকরণ করতে নিষেধ করেছেন।
· হাদিস: “যে ব্যক্তি কোন সম্প্রদায়ের সাদৃশ্য অবলম্বন করবে, সে তাদের দলভুক্ত বলে গণ্য হবে।” (সুনান আবু দাউদ, ৪০৩১)
এই হাদিসটি ইসলামে অন্য ধর্মের অনুসরণের বিরুদ্ধে একটি মৌলিক নীতি প্রতিষ্ঠা করে। উলামায়ে কেরাম বলেন- চেহারা, পোশাক-পরিচ্ছদ, ধর্মীয় উৎসব কিংবা আচার-অনুষ্ঠান—যেকোনো ক্ষেত্রে কাফিরদের সাদৃশ্য অবলম্বন করা থেকে মুসলমানদের বিরত থাকতে হবে।
* বিজ্ঞ আলেমদের মতামত:
ইসলামিক স্কলাররা এই বিষয়ে একমত যে, কোনো কাজ যদি নিম্নলিখিত শর্ত পূরণ করে, তাহলে তা ইসলামে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ:
· ঐতিহাসিক উৎস: সেটি সরাসরি অন্য ধর্ম বা বিশ্বাস থেকে এসেছে।
· ধর্মীয় অর্থবহ: তার সাথে সংশ্লিষ্ট ধর্মের একটি বিশেষ আধ্যাত্মিক বা ধর্মীয় বিশ্বাস জড়িত।
· অনুকরণ: মুসলিম হিসেবে তা পালন করাকে সেই ধর্মের অনুকরণ বলে গণ্য হয়।
এই নীতির ভিত্তিতে, হিন্দু ধর্ম থেকে আগত চক্র বা কুন্ডলিনী ধ্যান, বৌদ্ধ ধর্মের ধ্যান পদ্ধতি ধর্মের বিশেষ আচার-অনুষ্ঠান ইসলামী শরিয়তে গ্রহণযোগ্য নয়। এগুলো অনুশীলনের মূলে রয়েছে ইসলামের তাওহিদ (আল্লাহর একত্ববাদ) এর বিপরীত শিরকী বিশ্বাস। আরো বিশদভাবে ব্যাখ্যা করা হলো-
* ইসলামী বিশ্বাসের মূল ভিত্তি তাওহীদ (একত্ববাদ)। সমস্ত ইবাদত, প্রার্থনা ও ভরসা শুধুমাত্র আল্লাহর জন্য। তিনি ছাড়া আর কেউ উপকার বা অপকার করার ক্ষমতা রাখে না। বিপরীতে চক্র বিশ্বাসের ভিত্তি বহুত্ববাদ। এটি একটি বহুত্ববাদী (Pluralistic) বিশ্বাস যা Hinduism-এর দর্শনে rooted। এতে বিভিন্ন চক্র ও দেব-দেবীর ধারণা অন্তর্নিহিত। এটি শির্ক-এর দিকে নিয়ে যায়। কেননা, আল্লাহ ছাড়া অন্য কোনো সত্তা বা শক্তির কাছে ক্ষমতা আরোপ করা এবং তার কাছে সাহায্য চাওয়া হলো শির্কের manifest।
* গায়েবের জ্ঞান : গায়েব (অদৃশ্য) এর জ্ঞান একমাত্র আল্লাহর কাছে। আধ্যাত্মিক জ্ঞান অর্জনের একমাত্র উৎস হলো ওহী (কুরআন ও সহিহ সুন্নাহ)। বিপরীতে চক্র বিশ্বাসে ব্যক্তির নিজের “অভিজ্ঞতা”, “অনুভূতি” ও “জাগরণ”-কে জ্ঞানের প্রধান উৎস হিসাবে বিবেচনা করে। এটি ইসলামের জ্ঞানার্জনের উৎস (Quran & Sunnah) -কে প্রত্যাখ্যান করে এবং ব্যক্তি অভিজ্ঞতাকে প্রাধান্য দেয়, যা ভ্রষ্টতার দিকে নিয়ে যেতে বাধ্য।
* জিন-শয়তানের ক্ষেত্র : ইসলাম শিক্ষা দেয় যে, শয়তান ও জিনেরা মানুষকে বিভিন্ন রূপকথা, ভুল বিশ্বাস ও শির্কে ফাঁদে ফেলতে সক্রিয়। বিপরীতে চক্র বিশ্বাস এমন সব “শক্তি” ও “কেন্দ্রের” অস্তিত্ব স্বীকার করে, যা কুরআন-সুন্নাহ দ্বারা প্রমাণিত নয়। যে কোনো অদৃশ্য শক্তি, যা আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রমাণিত নয়, তার সাথে জড়িত হওয়া জিন-শয়তানের প্রভাব-এর অধীনে পড়ার একটি বড় ঝুঁকি।
* দেহ-মন সম্পর্ক : ইসলাম দেহ ও মনের interconnection স্বীকার করে, কিন্তু কোনো specific “শক্তি কেন্দ্রে” বিশ্বাস করে না। বিপরীতে চক্র বিশ্বাস দেহে ৭টি specific “শক্তি কেন্দ্র”-এর অস্তিত্বে বিশ্বাস করে। এটি একটি বিদআতী (innovated) বিশ্বাস যা শরিয়ত দ্বারা সমর্থিত নয় এবং হিন্দু ধর্মের মূল বিশ্বাসের অংশ।
মোটকথা, ইসলামি আকিদা একটি স্পষ্ট ও পূর্ণাঙ্গ system। এর মাঝে হিন্দু ধর্ম বা নিউ এজের মতো অন্য কোনো ধর্মীয়/দার্শনিক system-এর মৌলিক বিশ্বাস import করা স্পষ্ট শির্ক বা অন্তত বিদআতের পর্যায়ে পড়ে, যা ইসলামে সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ। আর ভিন্ন ধর্ম বিশ্বাসের সাথে জড়িত বিশ্বাস ইবাদাত হিসেবে পালন করা হারামের পর্যায়ে পড়ে।
নামাজ বা অন্য যে কোন ইবাদাতে মনোযোগ বৃদ্ধির জন্য চক্র ধ্যান করা কি অনুমোদনযোগ্য ?উত্তর হলো- না, এটি সুন্নাহ সমর্থিত নয়; বরং এটি একটি গুরুতর ভ্রষ্টতা। কারণ:
1. ইবাদতের ভিত্তি হলো ‘ইখলাস’ ও ‘মুতাবাআ’ (অনুসরণ): কোনো ইবাদত বা আমল কবুল হওয়ার জন্য দুটি শর্ত:
· ইখলাস (একনিষ্ঠতা): কাজটি খালেসভাবে আল্লাহর জন্য হতে হবে।
· মুতাবা’আহ (সুন্নাতের অনুসরণ): কাজটি রাসূল ﷺ-এর শিক্ষা ও পদ্ধতি অনুযায়ী হতে হবে।
এখন যদি নামাজে মনোযোগ আনার জন্য আপনি একটি অ-ইসলামিক বিশ্বাস চক্র system এর ওপর ভরসা করেন, তাহলে এটি ইখলাসকে নষ্ট করে। এটি মুতাবা’আহ-কেও নষ্ট করে, কারণ রাসূল ﷺ কখনও তাঁর উম্মতকে নামাজে খুশু অর্জনের জন্য এমন পদ্ধতি শিখাননি।
2. ভুল উপায়ে সঠিক লক্ষ্য অর্জন যায় না: ইসলামে ইবাদাত গ্রহণযোগ্য হওয়ার জন্য শুধু লক্ষ্য (Intention) ভালো হলেই হয় না, উপায় (Method)-ও শরিয়তসম্মত হতে হবে। নামাজে খুশু অর্জন একটি মহান লক্ষ্য। কিন্তু এই লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য রাসূল ﷺ শরিয়তসম্মত উপায় শিখিয়ে গেছেন। সেগুলো বাদ দিয়ে অনৈসলামিক উপায় বেছে নেয়া হলে তা বিদ’আত হবে।
3. শির্কে পতনের ফাঁদ: শুরুতে আপনি হয়তো শুধু “একটি কৌশল” হিসাবেই এটিকে দেখছেন। কিন্তু ধীরে ধীরে আপনার subconscious mind-এ এই বিশ্বাস গেঁথে যেতে পারে যে, “চক্রের ধ্যানের কারণেই আমার নামাজে মনোযোগ বাড়ল।” এটি সরাসরি আপনাকে শির্ক-ই-আসগার (ছোট শির্ক) -এর দিকে নিয়ে যায়, যেখানে আপনি গাইরুল্লাহ তথা আল্লাহর শক্তি ছাড়া অন্য কোনো শক্তির প্রভাব মানতে শুরু করেন। এটা ছোট শিরক থেকে বড় শিরক, তা থেকে কুফরের দিকে নিয়ে যেতে পারে। এ কারণেই হাদিসে বলা হয়েছে-
“প্রত্যেক বিদ’আতই ভ্রষ্টতা, আর প্রত্যেক ভ্রষ্টতাই জাহান্নামে নিয়ে যায়।”
নামাযে মনোযোগ (খুশু) বাড়ানোর সুন্নাহ সমর্থিত উপায়:
নামাজে মনোযোগ আনার জন্য ইসলাম নিজেই সম্পূর্ণ ও কার্যকরী system দিয়েছে। এগুলোর উপর আমলই হলো সুন্নাহ সমর্থিত পথ:
১. প্রস্তুতি: আজানের উত্তর দেওয়া, ওযু ঠিকমতো করা, অযুর দুয়া পড়া এবং নামাজের জন্য দাঁড়ানোর আগে দুনিয়াবী চিন্তা দূর করার চেষ্টা করা।
২. তাদাব্বুর (চিন্তাভাবনা): নামাজে যা তিলাওয়াত করা হচ্ছে তার অর্থ বুঝে পড়া, অর্থ নিয়ে চিন্তা করা। এটি হলো খুশুর সবচেয়ে বড় উপায়।
৩. আল্লাহর সামনে দাঁড়ানোর অনুভূতি: নামাজে দাঁড়ানোর সময় এটা মনে করা যে, আপনি সরাসরি আল্লাহর সাথে কথা বলছেন এবং তিনি আপনাকে দেখছেন।
৪. নামাজের আহকাম-আরকান সঠিকভাবে পালন করা: যেমন, রুকু-সিজদা ঠিকমতো করা, দ্রুত না করা ইত্যাদি।
৫. দোয়া ও অধ্যবসায়: আল্লাহর কাছে নামাজে খুশু দানের জন্য নিয়মিত দোয়া করা। রাসূল ﷺ এই দোয়া শিখিয়েছেন: “হে আল্লাহ! আমি আপনার কাছে এমন ক্বলব থেকে আশ্রয় চাই, যা আপনার জন্য বিনম্র নয়।”
সুতরাং নামাজ ও অন্যান্য ইবাদাতে মনোযোগ বাড়ানোর জন্য ইসলামের নিজস্ব অফুরান ভান্ডার রয়েছে। সেখানে মনোনিবেশকরুন। ভিন্নধর্মী এবং সন্দেহযুক্ত beliefs ও practices-এর দিকে যাওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। এটি ঈমানের জন্য মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ। আল্লাহ তা’আলা আমাদের এসব ভ্রান্ত বিশ্বাস ও ইবাদাতের নামে শিরক ও বিদ’আতের চর্চা থেকে দূরে রাখুন, কুরআন ও সহীহ সুন্নাতের উপর আমল করার তাউফীক দিন। আমীন।
