ইয়াওয়ার বেগ মানুষটা আমার চিন্তা-ভাবনার জগতে বড় রকমের প্রভাব ফেলেছেন। অনেক কিছুই গতানুগতিক চিন্তার বাইরে তিনি নতুনভাবে চিন্তা করতে শিখিয়েছেন। যেমন একবার শায়খ বলছিলেন- আমাদের তরুণ দা’ঈদের অনেকের মধ্যেই একটা ভুল ধারণা হল ইসলামের কাজ করার জন্য সবথেকে বেশী যে জিনিষটা দরকার সেটা হল একটা ইসলামিক ইউনিভার্সিটির ডিগ্রী। এই ডিগ্রীর জন্য হাজার হাজার মানুষ ঘুরে ফিরছে অথচ দাওয়াহ-র সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান সম্পর্কে আমরা এসব তরুণরা বেখেয়াল আর সেটা হল- Connection with Allah. অন্যভাবে বললে- তাহাজ্জুদ।
বিষয়টার গুরুত্ব বোঝাতে গিয়ে শায়খ সূরা মুযযাম্মিল এর প্রথম দিকের কিছু আয়াত কোট করে বললেন, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষটাকে আল্লাহ দাওয়াহ-র কাজে প্রস্তুত করার জন্য বলে দিলেন- “আমি তোমার উপর অবতীর্ণ করতে যাচ্ছি এক গুরুভার বাণী” আর এজন্য তাঁকে অর্ধেক রাত্রি অথবা ১/৩ অথবা ২/৩ অংশ সালাতে দাঁড়াতে বললেন। কেন ? এর বাখ্যাটাও বেশ মনকাড়া।
সালাতে দাঁড়িয়ে রাসূলুল্লাহ (সা) দীর্ঘসময় কুরআন তিলাওয়াত করতেন। হিফয ক্লাশে ছাত্ররা যেমন কুরআন মুখস্থ করে উস্তাদকে শোনায় নিজেকে ঠিক করে নেওয়ার জন্য, এই ব্যাপারটাও অনেকটা তেমন তবে আরও তাৎপর্যপূর্ণ। কুরআন স্বয়ং আল্লাহর কালাম। অর্থাৎ আল্লাহর কালাম আল্লাহকেই শোনাচ্ছেন তাঁর রাসূল(সা)। এখানে আল্লাহ স্বয়ং শিক্ষক আর তাঁর ছাত্র হল রাসূলুল্লাহ (সা)। গভীর রাতে এই ছাত্র তাঁর শিক্ষকের সামনে দাঁড়িয়ে গেছেন তা’লিম এর জন্য। আর এই তা’লিমের প্রয়োগ হবে দিনের বেলায় তাঁর সম্প্রদায়ের কাছে। জগতের সর্বশ্রেষ্ঠ তারবিয়্যাহতো এটাই। আমাদেরও উচিত হবে দাওয়াহ-র কাজ করতে চাইলে গভীর রাতে আল্লাহর সামনে তা’লিমে দাঁড়িয়ে যাওয়া। এই তা’লিম ছাড়া দাওয়াহ-র কাজে নিজেকে সফল মনে করা বোকামি। সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষটার জন্য যা জরুরী ছিল আমাদের জন্য কি তা এতই হালকা হয়ে গেছে ? নাকি আমরা ১ ডিগ্রী বেশি বুঝছি ?
কথাটা আমার ভেতরে একটা চড় দিয়ে গেছে।
১৫ জানুয়ারী, ২০১৪
ইখলাস
IOU তে The Etiquettes of Seeking Knowledge কোর্সের এসাইনমেন্ট করার জন্য একটা বই পড়ার দরকার হয়েছিল- শায়খ সালমান আল ওয়াদাহ-র PItfalls to the Quest for Knowledge. মাত্র ২০-২৫ পৃষ্ঠার বইটায় লেখক এমন কিছু পয়েন্ট তুলে এনেছেন যেগুলো যে কেউই যখন কেবল দ্বীন নিয়ে পড়া শুরু করবে তক্ষুণি এবং তক্ষুণি পড়ে ফেলা দরকার।
একেবারে প্রথম অধ্যায়েই শায়খ বলতে চাচ্ছেন Knowledge should not be sought for the sake of knowledge. যেকোন নতুন জিনিষের প্রতিই মানুষের কৌতূহল থাকে আর সেটা যদি হয় পছন্দের বিষয় তবেতো কথাই নাই। কিন্তু এই আগ্রহই হতে পারে অনেক বড় একটা চোরাফাঁদ। কারণ, জ্ঞান অর্জন করতে হবে একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য। কিন্তু এই জ্ঞান কেউ যদি “পড়তে ভাল লাগে” ভেবে অর্জন করে তবে সেখানে বিপদ। ব্যাপারটা অনেকটা বিদ’আত এর মত। বিদ’আতীদের কমন লজিক হল-“আমিতো ভাল উদ্দেশ্যেই করছি”। একইভাবে, আমাদের মনে হতে পারে- “আমিতো ইসলামকে ভালবেসেই পড়ছি!” তাহলে কী পড়া যাবে না ?
উত্তর- অবশ্যই যাবে এবং পড়তে হবেও আর ইসলাম নিয়ে পড়তে ভাল লাগাও অবশ্যই দোষের কিছু না। তাহলে কীভাবে বোঝা যাবে যে আমি শুধুই “পড়তে ভাল লাগে” তাই পড়ি নাকি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য পড়ি ? আমার মনে হয় এর একটা লিটমাস টেস্ট হল- যা পড়ছি নিজেদের জীবনে তার বাস্তবায়ন কতটুকু ? উত্তরে যদি নিজেরাই সন্তুষ্ট হতে পারি তবে আলহামদুলিল্লাহ আর না পারলে বুঝতে হবে কোথাও গলদ আছে, বড়সড় গলদ।
উস্তাদ ইসমাইল কামদার আমাদেরকে বলেছিলেন- প্রতি সেমিস্টার শেষে আমরা যদি আরও বেটার মুসলিম হতে না পারি তবে বুঝতে হবে আমাদের নিয়্যাহতে সমস্যা আছে, আমরা ভুল উদ্দেশ্যে পড়ছি। আসিফ ভাই তাঁর স্ট্যাটাসে লিখেছেন, শায়খ আমীন আশ শানকীতী মাদীনাহ ইসলামিক ইউনিভার্সিটির সার্টিফিকেটকে “মিথ্যা সাক্ষ্য” বলেছেন। কারণ, এই সার্টিফিকেট যে কাউকে ‘আলিম হিসেবে সাক্ষ্য দেয় অথচ তাদের সবাই ‘আলিম নন। আমার মনে হয়, যেকোন ইউনিভার্সিটির সার্টিফিকেটই আমাদের নিজেদের ভুলে “মিথ্যা সাক্ষ্য” হয়ে যেতে পারে।
এই প্রসঙ্গে ইয়াসীর ক্বাদীর আরেকটা কথা না বললেই না। তিনি বলেন, ইয়াং জেনারেশনের অনেকেই যখন প্রথম দ্বীন বুঝতে শুরু করে তখন তারা ভাবে দ্বীনের কাজ করার জন্য স্কলার হতে হবে, পাবলিক লেকচার দিতে হবে, হালাকা-দারস করে মানুষকে দ্বীন বোঝানোই একমাত্র উপায়। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায় তাদের অনেকেই চাকরি জীবনে ও সংসারে প্রবেশ করে খেই হারিয়ে ফেলে। তখন আর না যাওয়া হয় বিদেশে ইসলামিক ভার্সিটিতে পড়তে আর না করা হয় নিজের এলাকায় দাওয়াহ। কারণ, বিদেশে পড়ার স্বপ্ন বিভোর হয়ে এতদিন হাতের কাছে সহজলভ্য সুযোগগুলোও গ্রহন করা হয়নি ! এই পর্যায়ে এসে প্রচণ্ড হতাশায় মুষড়ে পড়ে ঐসব তরুণরা। তবে অবশ্যই এর ব্যতিক্রম আছে। কেউ যদি নন-ইসলামিক ব্যাকগ্রাউণ্ড থেকে ইসলামিক স্টাডিজে এসে সত্যিকার ‘আলিম/দাঈ’ হতে পারেন তবে সেটা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়।
এবার আমার নিজের IOU তে আসার পেছনের ছোট্ট একটা ঘটনা বলে শেষ করি। IOU অফিসে নাবিল ভাইকে বলছিলাম ইসলাম নিয়ে আমার চিন্তা-ভাবনার কথা, কতশত বিরাট বিরাট আশা। সব শুনে নাবিল ভাই শুধু বলেছিলেন-“দেখেন কবির ভাই, আপনি ১০ তলায় উঠতে চাইছেন কিন্তু আমাদের কাছে এখন ৫ তলা পর্যন্ত ওঠার সিঁড়ি আছে। আগে ৫ তলায় ওঠেন তারপর দেখা যাবে।” এই একটা কথায় বুঝে ফেললাম আমার চিন্তায় কোথায় ভুল ছিল।
আল্লাহু আ’লাম।
১১ জানুয়ারী, ২০১৪