(১৫ মার্চ) দুপুরের খাওয়া সেরেই সিভিল বিল্ডিংয়ের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম। চিন্তা করলাম যাওয়ার আগেই ক্যাফে থেকে এককাপ চা খেয়ে যাই। ক্যাফেটেরিয়াতে ঢুকতেই স্যারকে দেখলাম কয়েকজনের সাথে দাঁড়িয়ে আছে।স্যারের স্ত্রী ও কায়কোবাদ স্যারও ছিলেন। অপেক্ষা করছিলাম স্যারকে কখন একা পাব। সৌভাগ্যক্রমে পেয়েও গেলাম। কিন্তু আশে পাশে তার ভক্তকুল যেভাবে অটোগ্রাফ আর ছবি তোলার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে তাতে স্যারকে একা পেতে আরো কিছুক্ষন সময় লেগে গেল। যখন একা পেলাম সালাম দিয়েই স্যারের সাথে কথোপকথন শুরু করলাম। কিছুক্ষন হেঁটে কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে। কথাগুলো অনেকটা এরকম হয়েছে।
আমি: স্যার,আপনার বিজ্ঞান বিষয়ক বই এবং উপন্যাস অনেক পড়েছি, খুব ভাল লাগে।স্যার আপনার কাছে কিছু প্রশ্ন ছিল।
স্যার: মৃদু হেসে বললেন, বলো।
আমি: স্যার,১৬ ডিসেম্বর প্রথম আলোতে আপনার একটা লেখা বের হয়েছিল। আপনি স্বাধীনতা,রাজাকার বিভিন্ন বিষয়ে বলতে গিয়ে আপনি হঠাৎ মেয়েদের বোরকা পড়ার বিষয়টা নিয়ে এসেছেন। জিনিসটা কিছুটা অপ্রাসংগিক হয়ে গেলনা? এজন্য ব্লগ ফেসবুকে দেখলাম অনেকে এ বিষয়ে প্রশ্ন তুলেছে। স্যার আপনি আসলে বিষয়টা এভাবে লিখলেন কেন যদি কিছুটা ব্যাখ্যা করতেন আপনার লেখার পাঠক হিসেবে খুশি হতাম।
স্যার: দেখ,আমার যেটা ভাল মনে হয়েছে আমি লিখেছি, তোমার ভাল মনে নাহলে নিওনা। আর বোরকা নারীদেরকে দমিয়ে রাখার জন্য। এটা প্রগতিতে বাধা দেয়।
আমি: স্যার আপনি প্রথম আলোতে আপনার এক লেখা “ওদের নিয়ে কেন স্বপ্ন দেখবনা” তেও এরকম একটা কথা বলেছেন। (স্যারের ঐ লেখা নিয়ে লিখতে গিয়ে আমার এক নোটে এ বিষয়ে আলোচনা করেছি।সে প্রশ্নটা স্যারকে সরসরি করলাম।আমি আমার নোট থেকে সরাসরি লেখাটা দিচ্ছি)
[স্যার বলেছেন-
“কক্সবাজারের পথে একবার হঠাৎ একটি মেয়ের সঙ্গে দেখা। মেয়েটি বলল, ‘স্যার, আমি আপনার ছাত্রী।’ আমি খুবই অপ্রস্তুত হলাম, নিজের ডিপার্টমেন্টের একটা ছাত্রীকে আমি চিনতে পারছি না। আমি এত বড় গবেট! ছাত্রীটি তখন নিজেই ব্যাখ্যা করল। বলল, ‘স্যার, আমি তো ডিপার্টমেন্টে বোরকা পরে যাই, তাই আপনি চিনতে পারছেন না।’ আমি তখন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। ক্লাসে যার শুধু এক জোড়া চোখ দেখেছি, তাকে আমি কেমন করে চিনব? কিন্তু গত ৫০ বছরে যে মেয়েদের একটি প্রজন্মকে ঘরের ভেতর আটকে রাখার চেষ্টা করা হয়েছে, সেই প্রজন্মকে নিয়ে আমরা কী স্বপ্ন দেখব?
এ শেষ লাইনের সাথে এর আগের লাইনগুলোর মিল কতটুকু?এ শেষ লাইনটি পুরোপুরি অপ্রাসংগিক।সবচেয়ে বড় কথা এ প্যারাটি অসংলগ্ন এবং সাংঘর্ষিক।হিজাব পরা যে মেয়েটাকে তিনি চিনতে পারলেননা সে মেয়েটা তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ছিল।তাহলে কিভাবে তিনি শেষ লাইনে বলতে পারলেন মেয়েদের ঘরের ভেতরে আটকে রাখা হয়েছে?পর্দার কারনে মেয়েদের যদি ঘরের ভেতর আটকে রাখা হয় তাহলে এ মেয়েটি বিশ্ব বিদ্যালয়ে কেন?এরকম সাংঘর্ষিক,আত্মঘাতী কথা স্যার বলেছেন বলে আমার মনে হয়না।শুনেছি যারা বিখ্যাত হয় তাদের নামে অনেক লেখা চালিয়ে দেয়া হয়, যা আদৌ সে সকল বিখ্যাত ব্যক্তিদের লেখা না।আমি জানিনা এ লেখাটির ক্ষেত্রে সেরকম কিছু হয়েছে কিনা,যদি হয়ে থাকে আমি আনন্দিত হব।তবে সেটা সম্ভাবনা যে খুব একটা নেই, সেটা চিন্তা করে খুব খারাপ লাগছে]
স্যারকে বললাম স্যার আপনার এ লেখাটা কি সাংঘর্ষিক নয়?
স্যার: তোমার কাছে যদি সাংঘর্ষিক মনে হয় তাহলে নিওনা।আর যারা সাংঘর্ষিক বলছে তারা তোমার মত টুপি দাঁড়ি পাঞ্জাবীওয়ালা। তুমি মনে হয় তাবলীগ করো। না? দেখো কোরআনে কোথাও হিজাবের কথা বলা হয়নি। আমি তোমার চেয়ে কোরআন বেশি পড়েছি। কোরআনে নবীর স্ত্রীদেরকে পর্দা করার জন্য বলা হয়েছে। (স্যার সম্ভবতঃ সূরা আহযাবের ৩২,৩৩ নং আয়াত indicate করেছেন)
আমি: স্যার, নবীর স্ত্রীরা হল উম্মুল মুমিমীন। বিশ্বাসীদের মা। হিজাবের উদ্দেশ্য আপনি যে আয়াত ইনডিকেট করছেন সেখানে বলা হয়েছে যেন মানুষের মনে খারাপ কোন কিছু না আসে। যেখানে মা দের হিজাবের জন্য বলা হয়েছে সেখানে তো অন্য মহিলাদের আরো বেশি হিজাব করা উচিৎ। আর আপনি যদি সূরা আহযাবের ৫৯ আয়াত পড়েন তাহলে সেখানে পাবেন সকল বিশ্বাসী মহিলাদেরই হিজাব করার কথা বলা হয়েছে।
[কিছু কথা যা স্যারকে সময়ের জন্য বলতে পারিনি। নবীর স্ত্রীদের জন্য যদি পর্দা ফরয হয় তাহলে অন্য মহিলাদের জন্য ফরজের উপর ফরজ। কারন মাদের সম্পর্কে কারো মনে খারাপ কিছু আসেনা কিন্তু অন্য কারো বিষয়ে আসতেই পারে। আর যদি নবীর স্ত্রীদের হিজাব করার বিষয়টা তাদের সম্মানের জন্য হয়ে থাকে তাহলে তো আপনি মেনেই নিচ্ছেন হিজাব সম্মানের নিদর্শন। অপমানের নয়। আর সূরা আহযাবে পরিষ্কারভাবে মুমিন মহিলাদের বলা হয়েছে। এসকল আয়াতের অর্থ ইবনে আব্বাস,ইবনে আবী হাতেম,ইবনে মারদুইয়া কেউ বুঝলেননা?ইবনে কাসীর এ সকল আয়াত নাবুঝেই এ বিশাল তাফসীর লিখে ফেললেন?ইবনে তাইমিয়ার জীবনেতে পড়েছি তিনি নাকি ১০০ তাফসীর পড়েছেন, তিনিও এসকল আয়াত ভুল বুঝলেন?তারা কেউই বুঝেননি আমাদের আজকের যুগে এসে শ্রদ্ধেয় জাফর স্যার বুঝলেন?তবে আমরা ইসলামে আধুনিক জ্ঞানসম্পন্ন নতুন মুফাসসির পেয়ে সৌভাগ্যমন্ডিত হলাম?মাশাল্লাহ!(?)]
স্যারঃওখানে কি বলা হয়েছে?
আমিঃওখানে স্যার নবীর স্ত্রী,কন্যা এবং মুমিন মহিলাদের বাইরে যাওয়ার সময় “জিলবাব” পরার জন্য বলা হয়েছে।
স্যারঃজিলবাব কি?
আমিঃস্যার জিলবাব (বড় চাদর) পুরো শরীরকে ঢেকে রাখে যা তখন আরবে পরা হত।
স্যারঃইসলাম কি শুধু আরবের জন্য এসেছে?(এখানে স্যার আলোচনা নতুন দিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলেন কেন বুঝলামনা)
আমিঃএটা মানে তো আপনি এটা বুঝতে পারেননা। ইসলাম পুরো মানবজাতির জন্য এসেছে।
[একটা কৌতুক বলি।ধরুন কেউ বলল, আমার বাবা আমাকে মারা যাওয়ার সময় বলেছে “কথা দে তুই আর কখনো সিগারেট খাবিনা”
সে বলল খাবনা।
তাই সে জীবনে আর কখনো সিগারেট খেলনা ।বিড়ি খাওয়া শুরু করল।বাবার সিগারেট বলার অর্থ অনুধাবন না করলে এ অবস্থা ছাড়া আর কিইবা হতে পারে।কুরআনে জিলবাব বলার কারন যদি শুধু জিলবাব আরবের পোশাক শুধু আরবদের জন্য বলা হয়েছে এরকম চিন্তা করা কুরানের অর্থ অনুধাবন নাকরার পরিচায়কই মনে হয়।কারন এ আয়াতের শেষেই এর কারন বলা হয়েছে]
স্যারঃতুমি কি মনে কর,এতগুলো মহিলা শ্রমিক হিজাব না করে কাজ করছে তারা জাহান্নামে যাবে?
আমিঃসেটার ভারডিক্ট তো আমি দিতে পারবনা। আলোচনা সাপেক্ষ বিষয়।আর মেয়েদের এভাবে বাইরে কাজ করতে হচ্ছে কেন?সেটাও বুঝা দরকার।
স্যার টয়লেটে চলে গেলেন যাওয়ার আগে বলে গেলেন
“দেখ, তোমরা যারা অন্ধবিশ্বাস নিয়ে আছ, তাদের বিরুদ্ধে আমার যুদ্ধ চিরকাল চলবে”
আমি টয়লেটের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকি।স্যার এক মিনিটের মাঝেই ফিরে এলেন
আমিঃস্যার, আপনি আমাকে ভুল বুঝবেননা।আমি আসলে জানার আগ্রহে আপনাকে প্রশ্ন করছি।
স্যারঃনা ঠিক আছে।আমি মুক্তভাবে চিন্তা করি। তুমি আমাকে আমার চিন্তাধারা থেকে পরিবর্তন করতে পারবে?
আমিঃসেটা আমি চাচ্ছিওনা।
স্যারঃতোমরা তো আলোচনায় যেতে রাজিনা।
আমিঃস্যার আমিও মুক্তভাবে চিন্তা করতে পছন্দ করি।আর ইসলাম আলোচনায় উৎসাহ দেয়া আপনি সূরা নাহলের ১২৫ নং আয়াত পড়লে বুঝতে পারবেন ইসলাম আলোচনা কথা বলে।যুক্তির কথা বলে।
স্যারঃদেখ,ধর্ম হচ্ছে বিশ্বাস। তোমাকে যা বলছে, তা অন্ধভাবে বিশ্বাস করতে হবে।
আমিঃস্যার, যে কোন জিনিস অন্ধভাবে বিশ্বাসে আমি পক্ষপাতি না।
স্যারঃতোমরা আল্লাহ বিশ্বাস করো,রাসুল বিশ্বাস করো এগুলো কি তোমরা যুক্তি দিয়ে বিশ্বাস করো?
আমিঃস্যার আপনি কি বিশ্বাস করেননা?
স্যারঃআমি কি বিশ্বাস করি,নাকরি সে বিষয়ে তুমি আমাকে প্রশ্ন করছ কেন?
আমিঃস্যার বাংলাদেশের বেশির ভাগ মানুষ আপনাকে মুসলমান হিসেবে জানে।আপনি বারবার “তোমরা” “তোমরা” করছেন।
স্যারঃআমার সময় নেই ।সেমিনার শুরু হয়ে গেছে………
আমিঃওকে স্যার।থ্যাংক ইউ……
[আজ ১৬ ই মার্চ আবার স্যারের সাথে সৌভাগ্যক্রমে দেখা হয়ে গেল।আমাদের অডিটোরিয়ামের সামনে বসে কিছু বিষয়ে কথাও হল। ইসলাম ও কোরআন সম্বন্ধে তার দৃষ্টিভঙ্গি আরো ভালভাবে বুঝতে পারলাম। অন্য কোনদিন সেটা শেয়ার করার ইচ্ছা রইল।তবে পাবলিকের জন্য আলোচনাগুলো জমাতে পারিনাই।একটু পরপর একগ্রুপ এসে স্যার, আপনার অটোগ্রাফ।স্যার, আপনার সাথে একটা ছবি তুলব…………]
জাফর ইকবাল স্যারের সাথে কথোপকথনঃকিছু উপলব্ধি,কিছুটা হতাশাপূর্ন
১৬ মার্চ সকালে সার্ভেয়ীং প্র্যাকটিকেলের এক ফাঁকে ক্যাফেটেরিয়ার দিকে যাচ্ছিলাম সৌভাগ্যক্রমে দেখলাম স্যার গাড়ি থেকে নেমে অডিটোরিয়ামের সেমিনার রুম এর দিকে যাচ্ছে আমিও পিছু পিছু স্যার স্যার করে গিয়ে বললাম “স্যার আপনার সাথে গতকাল কথা হয়েছিল,কথা শেষ করতে পারিনাই” দু মিনিটের মত কথা হল।স্যার সেমিনারে চলে গেলেন।আবার সাড়ে বারোটার দিকে আমি সার্ভেয়ীং শেষ করে আবার অডিটোরিয়ামের দিকে গেলাম।অডিটোরিয়ামে ঢুকে আধা মিনিটের মত বসলাম দেখলাম স্যার সামনের কাতার হতে সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে অডিটোরিয়ামের বাইরে গেল আমিও স্যারের পিছু পিছু গেলাম।অডিটোরিয়ামে সামনে রেলিংয়ের মত বসার জায়গাটাতে স্যারের সাথে বসলাম।আরো কিছুক্ষন কথা হল।এভাবে ঐ দিন দুই দফা স্যারের সাথে কথা হল।
প্রথম লেখাটার মত পুরো কনভারসেশনটা ওভাবে লেখা সম্ভব নয় কারন স্যারের সাথে দুই দফা কথা হয়, আরেক সমস্যা হচ্ছে দ্বিতীয় দফায় একের পর এক স্যারের ভক্তরা এসে তার সাথে ছবি তোলা এবং অটোগ্রাফ নেয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ে।একথা বলে নিই স্যারের সাথে যখন তার ছেলে ও মেয়ে ভক্তরা ছবি তোলা শুরু করে আমি স্যারের পাশেই বসে ছিলাম।কিছুটা অস্বস্তিতে পড়ে গিয়েছিলাম।উঠে চলে যেতেও পারছিলাম না কারন স্যারের সাথে আমার কথা চলছিল।তো যা বলছিলাম আজ লেখাটায় স্যারকে যে সকল প্রশ্ন করেছিলাম সেগুলো তুলে ধরব সাথে সাথে আমি কি বলেছিলাম সেটাও বলার চেষ্টা করব।
স্যারের সাথে এ কনভারসেশনে স্যারকে আমি একটা অনুরোধ করেছিলাম। স্ট্রিং থিউরির উপর স্যারের একটা বই লেখা দরকার।স্যারকে আমি জানালাম “স্যার,আমি আপেক্ষিকতা নিয়ে আপনার বইটা পড়েছি।এবং এত সহজ ভাষায় আপেক্ষিকতা বুঝানো হয়েছে যা সত্যিই অসাধারন ছিল”।কোয়ান্টাম মেকানিক্স নিয়ে স্যারের লেখা বইটা যদিও সময়ের অভাবে এখনো পড়তে পারিনি।একবার নিউ মার্কেটে গিয়ে দরদাম ও করেছিলাম।কিন্তু পরে সামনে পরীক্ষা না কি চিন্তা করে আর কেনা হয়নি।শুনেছি সেটাতেও কোয়ান্টাম মেকানিক্স খুবভাবে উপস্থাপন করেছেন।
স্যার বললেন আমার বই “একটুখানি বিজ্ঞানে স্ট্রিং থিউরীর বিষয়টা কিছুটা এসেছে”।
আমি স্যারকে জানালাম স্যার ঐ বইটা আমি পড়েছি।ওখানে খুব একটা বিষয় আসেনি,আমি চাই E=mc*c এর মত একটা বই।
স্যার সম্মতিসূচক জবাব দিয়েছিলেন।
স্যারের সাথে দ্বিতীয় দফায় যখন কথা বলছিলাম তখন স্যারের মায়ের ফোন এসেছিল।স্যারের মা সম্ভবত ঢাকায় থাকেন।স্যারের মায়ের সাথে স্যারের কথা বলার ধরনটা আমার ভাল লেগেছে।
স্যারকে আমি প্রশ্ন করলাম স্যার পৃথিবীতে এত এত ধর্ম এত এত মতবাদ কোনটা ঠিক?
উত্তরে স্যার বললেন, “দেখ,আমার বাবা একটা কথা বলেছিলেন একটা বৃত্তের কেন্দ্রে অবস্থান করছেন স্রষ্টা,বিভিন্ন জন বিভিন্ন অংশ থেকে এক কেন্দ্রের দিকে যাচ্ছে।একেকজন একেকভাবে স্রষ্টাকে পেতে চাচ্ছে।হিন্দুরা তাদের মত করে,খ্রিস্টানরা তাদের মত করে আর মুসলিমরা তাদের মত করে।যে যার মত করছে”
আমি বললাম “সব কি একসাথে ঠিক হতে পারে”?আপনি জিনিসটা বৃত্ত দিয়ে ব্যাখ্যা করলেন আমি যদি বিন্দু দিয়ে ব্যাখ্যা করি তাহলে বিষয়টা এমন “দুইটা বিন্দুর মধ্যে কেবলমাত্র একটাই সরলরেখা থাকবে,বাকী যত রকমের রেখা হতে পারে সবই বক্ররেখা।এখন মানুষকে যদি একটা বিন্দু আর স্রষ্টাকে যদি একটা বিন্দু ধরি তাহলে তাদের মধ্যে সোজা পথ,সরল পথ একটাই থাকবে,বাকীগুলো বক্রপথ”
সেটা তোমার চিন্তা।
আর ধর্মগুলোর শিক্ষাও তো অনেকক্ষেত্রে একটা আরেকটার সাথে সাংঘর্ষিক।ইসলামের অনেককিছু হিন্দু ধর্মের সাথে সাংঘর্ষিক।তাহলে সব একসাথে কিভাবে ঠিক হবে?
-যে যেভাবে দেখে বিষয়টা।
স্যার আরো বললেন, “দেখ, কোরানের ৫৪ নাম্বার পারায় না কোন পারায় যেন আছে -বড় গুনাহ থেকে বেঁচে থাকলে আল্লাহ ছোট গুনাহ ক্ষমা করে দিবেন”
-স্যার কোরআনের পারা সংখ্যাই তো ৩০ (এটা মে বি স্যরের স্লিপ অব টাং ছিল।অবশ্য এরকম বেসিক ভুল নরমালি স্লিপ অব টাং হবার কথা না কারন এর আগের দিনই স্যার বলেছিলেন আমি তোমার চেয়ে কোরআন বেশি পড়েছি।তারপরো আমি পজিটিভলি চিন্তা করতেই পছন্দ করি আর এটাকে স্লিপ অব টাং হিসেবেই ধরে নিচ্ছি)
আর আপনি যে আয়াতটি বললেন সেটা আমার জানামতে সূরা নজমের আয়াত।আর এটা কোরআনের ৫৩ নং সূরা।(তখন অবশ্য মাথায় আয়াতটাও ঘুরছিল।৩১ অথবা ৩২ নং আয়াত।রুমে এসে দেখি আয়াতটা ৩২ নং। )
স্যারঃহতে পারে।তুমি আমার চেয়ে ভাল জানবা।
আমিঃকিন্তু স্যার কোনটা বড় গুনাহ আর কোনটা ছোট গুনাহ সেটা কিভাবে নির্ধারিত হবে?
স্যর উত্তরে বললেন “বিবেক,আমার বিবেকই আমাকে বলবে কোনটা ঠিক আর কোনটা ঠিক নয়,যেমন মানুষ হত্যা খারাপ এটা সবাই এক কথায় বলবে।কিন্তু বোরকা সহ ইত্যাদি বিষয়ে মানুষকে চাপিয়ে দেয়ার কোন মানেই হয়না।(আজ আমি মোটেই বোরকার বিষয়টাতে আর যেতে চাইনি কারন গতকালের কথোপকথনে তার দৃষ্টিভঙ্গি পরিষ্কার।তারপরো বুঝলামনা স্যার এ বিষয়টা কেন নিয়ে আসলেন পাশেই স্যারের এক ভক্ত আপু দাঁড়িয়ে ছিলেন তার সাথে কথা বলার জন্য। বোরকার বিষয়টা আসার সাথে সাথে তার ঠোঁটের কোনায় একটা হাসি লক্ষ্য করলাম।কারন স্যার এটা বলেই তার দিকে তাকালেন।পরে আপুটার সাথে স্যারের কনভারসেশনের সময় আমি পাশেই বসা ছিলাম।জানতে পারলাম তার নাম পূজা।সেমিনারে তার থিসিসের উপর একটা প্রেজেন্টেশান ছিল।)
আপুটা স্যারের সাথে অনেকক্ষন কথা বলল আর আমাকে স্যারের সাথে গুরুত্বপূর্ন আলোচনা থেকে কিছুক্ষন বঞ্চিত করে রাখল।আপুটার সাথে স্যারের আলোচনায় দুইটা পয়েন্ট তুলেনা ধরলেই নয়।
আপু বিভিন্ন ইউনিভার্সিটিতে চাকরির ইন্টারভিউ দিয়েও সিলেক্ট হননি বিষয়টা স্যারকে জানানোর সাথে সাথে স্যার একটা সুন্দর কমেন্ট করলেন
“এখন তো সব জায়গায় DNA test করে চাকরিতে নেয়।নিজের দলের হইলেই কেবল এ টেস্টে উন্নীত হওয়া যায়”।
কথার এক পর্যায়ে স্যার আপুকে পড়াশুনার ফাঁকে ফাঁকে আর কি করা হয় জানতে চাইলে আপু জানালেন তিনি ডান্স করেন।
স্যার বললেন “তাই নাকি?আজকের প্রোগ্রামে একটা পারফর্ম করতে পারতে।ফিজিক্সের সাথে সাথে আমরা একটু আনন্দও পেতাম”।
(বুঝলাম, স্যার অনেক মুক্তমনা আর রসিক মানুষ।অবশ্য এর প্রমান আমরা আগেও পেয়েছি।শাহাজালাল ভার্সিটিতে যতদূর মনে পড়ে মেয়েদের হলের কোন প্রোগ্রামে তিনি “নো এনট্রি” গানের সাথে নেচেছিলেন।জনৈক লেখক এ বিষয়ে বলতে গিয়ে লিখেছিলেন “বাংলাদেশের মানুষ এখনো অনেক ব্যাকডেটেড।কোন স্বনামধন্য লেখক মেয়ের বয়সী যুবতীদের সাথে নাহয় তাহার নিতম্ব একটু দুলালোয় এতে এত হৈ চৈ করার কি আছে?মৌলবাদীতে দেশটা ভরে গেছে”।)
যা বলছিলাম স্যার সবকিছু এভাবে বিবেকের উপর ছেড়ে দিলেন কেন বুঝলামনা।যা আজকাল মুক্তমনা নাস্তিকদের মুখেই বেশি শোনা যায়। বিবেক কিছু চিন্তা ও বিশ্বাসের উপর নির্মিত হয়।যদি বিবেকের কোন রেফারেন্স ফ্রেম না থাকে তাহলে তা শয়তান দ্বারাই অনেকক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রিত হয়। সবচেয়ে আজব লেগেছে তিনি কোরআন দিয়ে সেটা ব্যাখ্যা করতে চাইলেন। এনিওয়ে ওনার বিশ্বাস নিয়ে কোন মন্তব্য আমি করতে চাচ্ছিনা।
কথার এক প্রসংগে স্যার কোরআনের বিভিন্নরকম ব্যাখ্যা নিয়েও কথা বলতে চেষ্টা করলেন।তিনি বললেন “কোরআনে মদ নিষিদ্ধ সংক্রান্ত দুটো আয়াত আছে,আর বিভিন্ন জন এটাকে বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করেন”।
আমি স্যারকে জানালাম স্যার মদ তিন স্টেপে নিষিদ্ধ হয়।সুরা বাকারার ২১৯,সুরা নিসার ৪৩ আর সূরা মায়িদার ৯০।( মদের বিষয়টা নিয়ে এত বেশিবার পাবলিকের সাথে ডিল করতে হয়েছে যে আয়াতগুলো পুরো মুখস্ত ছিল)
আমি স্যারকে জানালাম “স্যার এখন পর্যন্ত যত তাফসীর বা যত জায়গায় বিষয়টা পড়েছি আমি একটাই কারণ জেনেছি। একটাই ব্যাখ্যা জেনেছি”।
স্যা্রের সাথে বিবর্তনবাদ নিয়েও অল্প স্বল্প কথা হল।স্যারের কথানুযায়ী বেশিরভাগ বিজ্ঞানী এটাতে একমত।আমি স্যারকে জানালাম আমিও আপনাকে প্রচুর বিজ্ঞানীর নাম বলতে পারি যারা বিবর্তনবাদকে স্বীকার করেননি।উদাহরন হিসেবে জিনোম প্রজেক্টের প্রধান ফ্রান্সিস কলিন্সের নাম বললাম।
স্যার বললেন “দেখ,যারা এটার বিরোধী তারা হয় মৌলবাদী খ্রীস্টান নাহয় মুসলমান” ( আমি বুঝলাম না এটা কোন ধরনের যুক্তি হল? আমি কি বিবর্তনবাদকে এ বলে উড়িয়ে দেব যারা এটা নিয়ে কথা বলে তারা নাস্তিক।এটা কোন যুক্তি না।বিজ্ঞানে আদৌ এটার পক্ষে বিপক্ষে কেমন ডাটা এসেছে সেটাই মুখ্য বিষয়)
স্যার বিজ্ঞানের সাথে ধর্মকে মিলানোর বিরোধী।আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম স্যার বিজ্ঞানের কোন কিছু যদি ধর্মের বিরোধী হয় তখন আমি কি করব?
স্যার বললেন “সেখানে আমাকে বুঝতে হবে হয় ধর্ম সেখানে রুপক কিছু বুঝিয়েছে।নয়তো আগামীতে হয়ত প্রমানিত হবে”(কিন্তু বিজ্ঞান এখন যেটা বলে সেটা ভুল হতে পারে সেটা কেন যেন তিনি কখনো বলতে চাইছেননা।এমনকি ইভ্যুলশন থিউরীকেও ধর্মকে পাশ কাটিয়ে মেনে নিচ্ছেন।এখানে বিজ্ঞানের নামে যা চালানো হচ্ছে তা বিশ্বাস করার জন্য তিনি ধর্মের জিনিসটাকে রুপক ধরে নিচ্ছেন।তারমানে আল্টিমেটলি বিজ্ঞানই তার কাছে সব,আমি যতদূর বুঝলাম।)
স্যার, ধর্মের অনেক জিনিস পরিবেশের প্রেক্ষিতে পরিবর্তন করতে হবে সে ধারনায় বিশ্বাসী । তারমতে দাসপ্রথা আগে ছিল কিন্তু আধুনিক সভ্য সমাজে এর কোন অস্তিত্ব নেই।অতএব ধর্মের এ জিনিসটি এখন আর কার্যকর নয়।
(স্যারের বক্তব্যের প্রথম অংশের সাথে আমি একমত। ইসলামের মৌলিক কোন পরিবর্তন হবেনা।যা দেয়া আছে ঠিক তাই থাকতে হবে।তবে যুগের পরিপ্রেক্ষিতে অনেক বিষয় আসবে যা মহানবী (সঃ) এর সময় ছিলনা সেক্ষেত্রে বিদগ্ধ আলেমরা ডিসাইড করবেন কি করনীয়।একে ইজতিহাদ বলে।কিন্তু উদাহরন হিসেবে দাসপ্রথাকে টেনে আনা অজ্ঞতাপ্রসূত বক্তব্য ছাড়া আর কিছুই নয়।দাসপ্রথা কি ইসলামের কোন করনীয় বিষয়?ইসলাম দাসপ্রথাকে উচ্ছেদে সবরকম কর্মসূচী গ্রহন করেছিল কিন্তু সময়ের প্রেক্ষিত বিবেচনা করে সরাসরি এটাকে হারাম ঘোষনা করেনি। একদিন জনৈক নাস্তিক আমাকে প্রশ্ন করল “ ভাই ,মহানবী (সঃ) যদি এতই দাসপ্রথা উচ্ছেদ চাইতেন তাহলে তিনি বিদায় হজ্জের ভাষনে বললেননা কেন “আজ থেকে বিশ্বে কোন দাসপ্রথা থাকবেনা”।
মহানবী (সঃ) এর ভাষন খালেদা জিয়া বা শেখ হাসিনার ভাষন নয় যে কেউ লিখে দেবে আর দেখে দেখে বলবে।যে এরকম প্রশ্ন করে সে কি ভাবে, মহানবী (সঃ) তার চিন্তা অনুযায়ী ভাষন দেবেন? এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে ওহী হয়ে এসেছে।আর আল্লাহ কেন একবারে মদ হারাম করলেননা বা দাসপ্রথা কেন চিরতরে হারাম বললেননা এটা জানার জন্য মুহাম্মদ কুতুবের “ভ্রান্তির বেড়াজালে ইসলাম” বইখানি পড়ার জন্য সকলকে অনুরোধ করছি। এ স্বল্প পরিসরে এসবের ব্যাখ্যা দেয়া সম্ভব নয়।)
স্যারের আরো কিছু বিষয় আছে যা তিনি বলেছিলেন যা এ স্বল্প পরিসরে আলোচনা করব না। অন্য কোন আর্টিকেলে আলোচনার আশা রাখছি।ইনশা আল্লাহ।যেমন স্যার মহানবী সঃ কে পুরোপুরি সঠিক এবং ১০০% অনুসরনীয় বলে মনে করেননা।তিনি মনে করেন মহানবী সঃ কিছু ভুল করেছেন যা দু একটা উদাহরন ও তিনি দেয়ার চেষ্টা করেছেন।অতি দুঃখনের সাথে জানাচ্ছি তার জ্ঞান পশ্চিমা লেখকদের থেকেই ধার করা ।তিনি সরাসরি কোরআন বা হাদীস পড়ে এমন কথা বলছেননা।এবিষয়গুলো অন্য কোন নোটে আলোচনা করার চেষ্টা করব।যদি আল্লাহ তৌফিক দেন।
চলে যাওয়ার আগে স্যারকে একটা প্রশ্ন করেছিলাম স্যার আপনি তো কোরআনের আয়াত ব্যবহার করলেন আপনার বক্তব্যের দৃঢ়তার জন্য।আমি আপনাকে একটা প্রশ্ন করি-সুরা আলে ইমরানে আছে”আল্লাহর কাছে একমাত্র গ্রহনযোগ্য জীবনব্যবস্থা ইসলাম”।আপনি যে সবকিছুকে ঠিক বলছেন এ আয়াতের ব্যাখ্যা আপনি কিভাবে করবেন?
স্যার জবাবে বললেন “তাহলে দেখতে হবে সেখানে আদৌ ইসলাম বলতে কি বুঝানো হয়েছে”?
(আমি বুঝলাম না নবী (সঃ) ,সাহাবী,তাবেয়ী, তাবে তাবেয়ীরাসহ বিদগ্ধ আলেমরা তাহলে কোরআন অধ্যয়ন করে কি বুঝলেন?)
পরিশেষে বলতে চাই,এ অধমকে স্যার তার মূল্যবান সময় দেয়ার জন্য তাকে অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি।জুমার নামাযের সময় হয়ে গিয়েছিল বলে স্যারের কাছে থেকে বিদায়ের প্রাক্কালে তিনি আমাকে শাহজালাল ভার্সিটি যাওয়ার জন্য বললেন।এবং বিজ্ঞান ধর্ম এবং ফিলোসফির বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনার আশাবাদ ব্যক্ত করেছিলেন। তার সাথে কথা বলে সত্যিই ভাল কিছু অভিজ্ঞতা লাভ করেছি যা আমার আগামী দাওয়াতী জীবনে কাজে লাগবে, ইনশা আল্লাহ।আর আমি স্যারের কথা হুবহু (অনেক ক্ষেত্রে নিজের ভাষায়) লেখার চেষ্টা করেছি।দুএকজায়গায় হয়ত নিজের অজ্ঞাতে ভুল হয়ে যেতে পারে।এজন্য আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের দরবারে ক্ষমা প্রার্থনা করছি।
আল্লাহ হাফেজ।
জাফর স্যারের সাথে সর্বশেষ কথোপকথন
ফুটবল বিশ্বকাপ আসলে সবাই কোন না কোন দলের পতাকা উড়ায়,উল্লাসিত হয়। আমি আর্জেন্টিনা সাপোর্টার। একদিন বসে বসে ভাবছিলাম কেন আমি আর্জেন্টিনা সাপোর্ট করি? ভাবতে ভাবতে যেটা পেলাম আমার প্রথম শোনা ফুটবল দলের নাম ‘আর্জেটিনা’ এবং প্রথম শোনা ফুটবলার ম্যারাডোনা তাই এই দলের প্রতি মনের অজান্তেই একটা ইনক্লাইনেশন তৈরি হয়েছে, যার ফলাফল আমি আর্জেন্টিনা সাপোর্টার। পাঠ্যপুস্তকের বাইরে বইয়ের প্রতি আমার আগ্রহ খুব একটা ছিল না। যার বই পড়ে প্রথম বই পড়ার প্রতি আমার আগ্রহ জন্মেছিল তিনি জাফর ইকবাল। তাই মনের অজান্তেই তার প্রতি শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসা প্রাকৃতিকভাবেই তৈরি হয়ে গেছে। কিন্তু যার লেখনীর প্রতি এবং ব্যক্তি হিসেবে তার প্রতি এত ভালবাসা সেই মানুষটির সম্পর্কে খারাপ কিছু শুনতে কার না খারাপ লাগে? কিন্তু ইসলামে ভালোবাসার একটি ইউনিক শর্ত আছে। ভালোবাসা হতে হবে আল্লাহর জন্য। যে মানুষটাকে ভালোবাসি তার গলায় যদি ইসলামবিদ্বেষের লকব ঝুলে তাহলে ইসলামের শিক্ষানুযায়ী “তোমার কাছে কোন সংবাদ আসলে যাচাই করে দেখ” নীতিটা অনুসরণ একান্ত কর্তব্য। তাই সরাসরি তার সাথে কথা বলার সুযোগ হওয়াতে সুযোগটার অসদ্ব্যবহার করিনি। ওনার সাথে ঢাকায় কি কথা হয়েছে তা আমি আমার আগের দুটো আর্টিকেলে লিখেছি। বলেছিলাম সিলেটে গিয়ে তার সাথে দেখা করব এবং তিনিও বলেছিলেন সময় দিবেন।
ইসলামিক একটা কনফারেন্স যোগ দেয়া এবং সিলেট ঘুরে আসার একটা সুযোগ লুফে নিলাম। স্যারের (?) সাথে দেখা করার জন্য গেলাম পাহাড় আর সবুজে ঘেরা ক্যাম্পাসে। স্যার (?) আমাকে দেখে চিনলেন। বুঝাই যাচ্ছিল তিনি একটা প্রজেক্ট নিয়ে ব্যস্ত তাই দুপুরের পর সময় দিলেন। আমি এবং আমার এক বড় ভাই গেলাম ওনার অফিসে। আমার সোজাসাপ্টা প্রশ্ন, ওনার কখনো সাধাসিধে,কখনো দ্বিধাগ্রস্ত কখনো প্রশ্ন এড়িয়ে যাওয়া উত্তর, ফলশ্রুতিতে আমার প্রত্যুত্তরে কখন যে আধাঘন্টা চলে গেল টেরই পাই নি। এই কথাবার্তায় তার চিন্তাচেতনায় অনেক কিছুই প্রতিফলন ঘটেছে। আমার অনেক ভাই সেগুলো নিয়ে লিখতে বললে কেন যেন ওনাকে নিয়ে আর লেখার রুচি হয় নি। তবে তার চিন্তাচেতনার সাথে পরিচিত হওয়া এবং ইসলাম নিয়ে কিছু বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা পাওয়া আমার মত তার লেখাপ্রেমী মানুষদের অধিকার বলেই আমার মনে হয়। তার সাথে যে কথা হয়েছিল যতটুকু মনে পড়ছে তার চুম্বক অংশগুলো তুলে ধরছি।
আমার প্রশ্ন ছিল আপনি হিজাব,ইসলামী রাজনীতি বিভিন্ন বিষয়ে যে লেখা লিখেছেন সেটা নিয়ে অনেকে প্রশ্ন তুলেছে। আপনি শুধু শুধু বিতর্কিত হয়ে যাচ্ছেন না?
যারা স্বাধীনতাবিরোধী,গোঁড়া তারাই এসব বলে বেড়ায়। তিনি তাদেরকে নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামাননা বলেই জানান। তিনি আরো জানান মানূষদের জন্য কাজ করাটাই মুখ্য বলে তিনি প্রয়োজন মনে করেন। হিজাব,নামায এগুলোকে তিনি অবশ্যপালনীয় বলে মনে করেন না। তিনি বলেন কোরআনে আছে “বড় গোনাহ থেকে বেঁচে থাকলে আল্লাহ ছোট গোনা ক্ষমা করে দিবেন” (নিসা-৩১,নামল-৩২) (তিনি উঠে আইপ্যাড/ট্যাব নিয়ে সেখান থেকে কোরআনের সে আয়াত খুঁজেও আমাদের দেখান), আমি প্রশ্ন করেছিলাম বড় গোনাহ কোনটা সেটা কে ডিফাইন করবে? আল্লাহইতো করবেন। তিনি জানান তিনি মনে করেন খুন,ধর্ষন,অত্যাচার এগুলো বড় গুনাহ এগুলো থেকে বেঁচে থাকলে আল্লাহ ক্ষমা করবেন।
-আমি আবারও বললাম“কিন্তু আমাদের তো কোরআন হাদীস থেকেই সব নিতে হবে” (বুঝলাম এ বিষয়ে তাকে বুঝানো কঠিন হবে)
তিনি মনে করেন কোরআনের বিজ্ঞানের বিষয়গুলো রুপক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। তাই কোরানে বৈজ্ঞানিক কিছু আছে বলে তিনি মনে করেননা। তাফসীরকারকরা বিজ্ঞানের সাথে মিলাতে চায়। তিনি মনে করেন কোরআন বৈজ্ঞানিক কিছু অসামঞ্জস্যতা আছে কিন্তু যদি আমরা সেগুলোকে রুপক হিসেবে ধরি তাহলে কোন সমস্যা থাকেনা।
আমি তার কাছ থেকে উদাহরণ চাইলে তিনি বলেন “কোরানে সাত আসমানের কথা বলা আছে কিন্তু সেটা বৈজ্ঞানিকভাবে সত্য নয়”
আমি বললাম, স্যার মরিস বুকাইলি যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন এখানে ‘সাত’ বলতে অনেক বুঝানো হয়েছে এবং আপনি জানেন ‘সাত’ বলতে অনেক ট্রাডিশনে ‘অনেক’ বুঝানো হয়। কোরআনে অনেককিছু রুপকভাবে উপস্থাপন করলেও অনেক বৈজ্ঞানিক ইনডিকেশন আছে। তিনি বললেন, এটা তোমার মতামত। তুমি তোমার মত করে গ্রহণ করতে পার।
কথা প্রসংগে তিনি সৌদি আরবের মাথা কাটা আইনটিকে বর্বর হিসেবে আখ্যায়িত করেন। এ যুগে এভাবে হত্যা,মৃত্যুদন্ড মধ্যযুগের বর্বরতা। আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম “স্যার আপনি কি মৃত্যুদন্ডের বিরোধী? এখন অনেক মানবাধিকারকর্মীরা মৃত্যুদন্ডকে অমানবিক মনে করেন। স্যার, আপনি কি বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধ্ মানবতা বিরোধীদের ফাঁসি চাননা? আমি চাই। তাহলে মৃত্যুদন্ডকে অমানবিক বলার কোন গ্রাউন্ড থাকেনা”।
– তিনি জানান এভাবে প্রকাশ্যে করাটা অমানবিক।
-গোপনে দিলে কতটুকু লাভ? বড়জোর আসামীকে এ ধরনের কাজ ফারদার যেন না করতে পারে সেটার ব্যবস্থা করলাম। কিন্তু ইসলামের দর্শন ভিন্ন। ইসলাম একজনকে তো কাজের ফলাফলস্বরুপ শাস্তি দিবেই সাথে সাথে হাজার হাজার মানুষকে সতর্ক করার ব্যবস্থা করে দিয়েছে।
আমি তাকে বললাম- “স্যার সৌদি আরবে অনেক কিছুই ইসলামিক আইন অনুযায়ী চলেনা। তবে আমার জানামতে এই আইনটি ইসলাম থেকেই নিয়েছে। তাদের মনগড়া না। তাহলে কি আপনি বলবেন ইসলামের আইন বর্বর?”
-“তখনকার অনেক কিছুই এখনকার সময়ে এপ্লিকেবল না। মনে কর ইসলামে দাসপ্রথা এটা তো আধুনিক বিশ্বে চলবে না।এখন কাউকে দাস বানিয়ে রাখা যাবে না”
-স্যার,দাসপ্রথা ইসলামের কিছুনা। আরবে এই প্রথার প্রচলন ছিল। ইসলাম এসে এটাকে আস্তে আস্তে উচ্ছেদ করেছে। এখনকার দাসমুক্ত বিশ্ব ইসলামের অবদান। ইসলাম আসার পর কিছু জিনিস সরাসরি নিষেধ করে দিয়েছে যেমন যেনা ব্যবিচার,কিছু জিনিস ধাপে ধাপে মহানবী (সঃ) এর সময়ই নিষিদ্ধ হয় যেমন মদ। আর কিছু জিনিস এমনভাবে ধাপে ধাপে নিমূলের ব্যবস্থা করে যা মহানবী (সঃ) এর অনেক বছর পর শেষ হয়। আপনি জানেন দাসপ্রথাটা আরবদের অর্থনীতির সাথে সংযুক্ত একটা ব্যাপার ছিল। এখন সরাসরি এসে এটাকে নিষিদ্ধ করতে গেলে অর্থনীতির উপর ব্যাপক প্রভাব পড়ত। যার রুট অনেক গভীরে তাকে নির্মূলে অবিবচকের মত আইন করলে তো হবে না।
-এটা তোমার ব্যাখ্যা বলে আমার কথাটাকে কিছুটে উড়িয়েই দিলেন মনে হল।
আমি তাকে প্রশ্ন করেছিলাম- একটা দেশ/সমাজের জন্য ধর্মকে আপনি কতটুকু প্রয়োজন মনে করেন?
-দেখ, ধর্ম ছাড়া অনেক দেশ খুবভালভাবে চলছে। (সম্ভবত তিনি আলজেরিয়ার উদাহরন দিয়েছিলেন।)
-স্যার, আমি আলজেরিয়ার অবস্থা সম্পর্কে খুব একটা বেশি কিছু জানি না তবে এমন কিছু অতীত ইসলামী সমাজের উদাহরণ আমি দিতে পারব যেখানে মানুষের অধিকার সংরক্ষিত হয়েছে এবং ন্যায়বিচার কায়েম হয়েছিল।
-তিনি জানান,ধর্মকে আমি ব্যক্তিগত বিষয় মনে করি,যখন আমি খুব কষ্টে থাকব তখন আল্লাহকে ডাকতে পারি মানসিক প্রশান্তির জন্য যখন সুখে থাকব মানুষের জন্য কাজ করে যাব।
[একদিন কোরাআনের সূরা যুমারের ৮নং আয়াতটি পড়তে গিয়ে বারবার তার সে কথাগুলো মনে পড়ে। এখনও এ আয়াতটি পড়তে গিয়ে তার চেহারাটা ভেসে উঠে। “যখন মানুষকে দুঃখ-কষ্ট স্পর্শ করে, তখন সে একাগ্রচিত্তে তার পালনকর্তাকে ডাকে, অতঃপর তিনি যখন তাকে নেয়ামত দান করেন, তখন সে কষ্টের কথা বিস্মৃত হয়ে যায়, যার জন্যে পূর্বে ডেকেছিল এবং আল্লাহর সমকক্ষ স্থির করে; যাতে করে অপরকে আল্লাহর পথ থেকে বিভ্রান্ত করে”।
এরকম কিছু জায়গায় কোরআনটাকে আমার এত বেশি জীবন্ত মনে হয় ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না]
-স্যার আমি ধর্মকে মানি বলেই মানবসেবায় ব্রতী হই। যখন সূরা মাউন পড়ি তখন আমি উপলব্ধি করি ইয়াতীম,মিসকীনদের জন্য কিছু করা উচিৎ। সূরা বাকারায় আছে ঘুষ খাওয়া যাবেনা। এগুলো একটা সুস্থ সমাজ গঠনে সহায়তা করে।
ওনার ক্লাসের সময় হয়ে গেছে। আমরা কক্ষ প্রস্থান করার জন্য মোটামুটি প্রস্তুতি নিলাম। এরি মধ্যে অন্য ইউনিভার্সিটির/কলেজের কয়েকটা মেয়ে স্যারের রুমে এসে বলল স্যার আমরা আপনার ফ্যান এবং তার স্তুতিমূলক কিছু কথাবার্তা। মেয়েরা বলল “স্যার আপনার সাথে আমরা ফটো তুলতে চাই”। আমরা দাঁড়িয়ে আছি। সত্যিই, বাংলাদেশের এমন বিজ্ঞজনকে কাছে পেলে সবাই ফটো তুলতে চাইবে এটাই তো স্বাভাবিক। আমাদের সাথেও ক্যামেরা ছিল। কেন যেন আমাদের দুজনের মধ্যে একজনেরও সেই ইচ্ছাটা জন্মায়নি। আসার পূর্বে বড় ভাই বলল স্যার আপনার কাছে একটা প্রশ্ন আছে
-বলো।
-“কোনটা রাইট,ধর্ম ত্যাগ করা নাকি সত্য ত্যাগ করা?”
-স্যার ভেবেছিল আমরা তাকে কথার মারপ্যাঁচে আটকাতে চাচ্ছি।
-তিনি দু তিনমিনিট চিন্তা করলেন। এরিমধ্যে মেয়েগুলোর সাথেও কথা বলছিলেন। তারপর বললেন এটা ‘ফিলোসোফিক্যাল ব্যাপার’।এবং রুম থেকে বের হয়ে গেলেন। আমরাও তার পেছন পেছন বের হয়ে গেলাম।
ভাই আমাকে বললেন, মুজাহিদ তুমি প্রশ্নটির উত্তর দাও।
-আমি বললাম ধর্ম ত্যাগ করা। কিন্তু আমি জানি ‘যে ধর্ম স্রষ্টা প্রদও, সেটা সত্য’।
পুনশ্চঃ অনেক ভাইরা এ কথোপকথনটি দেয়ার জন্য অনেক আগ থেকেই তাগিদ দিচ্ছিল। আসলে ওনাকে নিয়ে ফারদার কিছু বলতে ভাল লাগছিল না।
যেহেতু দুজনের মধ্যে কথা হয়েছে অনেক আগে। দুএকটা শব্দ ভুলে গেলেও মুল ব্যাপারটি মাথায় আছে আর দুএকটা জিনিস আবারো ভাইকে ফোন করে নিশ্চিত হয়ে নিয়েছি। আমি জানি মিথ্যা বললে আল্লাহর কাঠগড়ায় তো আমাকে দাঁড়াতে হবেই।