আল্লাহর কাছে কোনটা প্রিয়: সফলতার আনন্দ নাকি ব্যর্থতার বেদনা?

হজ্জের প্রস্তুতি পর্ব অফিসিয়ালি শুরু হলো, আলহামদুলিল্লাহ। বছরের শুরু থেকেই ‘বাইতুল্লাহর মুসাফির’ বের করে রেখেছি, কনফার্ম হলেই পড়া শুরু করবো ইনশাআল্লাহ। হাতে আরও কিছু বই ছিলো, তার আগে সেগুলো পড়ে শেষ করছিলাম। আর দুই বাচ্চা নিয়ে পড়াশোনা, সে আর না বলি! বড়টাকে গল্প বই পড়ে শোনাতে হয়, টুকটাক পড়াশোনাও করাতে হয়, ৫ হয়নি এখনও। আর ছোটটা তো একদমই ছোট, বছরও হয়নি। আগে যেখানে দিনে একটা বই শেষ করতাম, এখন সেখানে একশ পৃষ্ঠার একটা বই পড়তেও মাস পেরিয়ে যায়, এই হলো অবস্থা। মায়েদের জীবন এরকমই- এর মাঝেই মায়েদের কষ্ট, মায়েদের প্রাপ্তি, আলহামদুলিল্লাহ!

রমাদান শুরু হয়ে যাচ্ছে, হজ্জ নিয়ে এখনও পড়া শুরু না করলে আর কখন? অবশেষে আবু তাহের মিসবাহ হুজুরের ‘বাইতুল্লাহর মুসাফির’ বই দিয়েই শুরু করলাম। এই বইটা পড়ার ব্যাকুলতা বহু বছর আগে থেকে, তাও না পড়েই তুলে রেখে দিয়েছিলাম, বাইতুল্লাহর ডাক এলেই পড়া শুরু করবো ভেবে। অবশেষে প্রতীক্ষার সেই বই খুলে বসার সুযোগ হলো, আলহামদুলিল্লাহ।

বইয়ের শুরুর দিকেই কিছু কথা এত ভালো লাগলো, একদম যেন মনের কথাই উনি বলছেন—

❝আমার বিশ্বাস, মুমিন বান্দার স্বপ্নের সফলতার আনন্দ এবং স্বপ্নের ব্যর্থতার বেদনা, দু’টোই আল্লাহর প্রিয়। তাই কারো স্বপ্ন তিনি পূর্ণ করেন, আর কারো স্বপ্ন আজীবন অপূর্ণই রেখে দেন। ইশক ও মুহাব্বাত এবং প্রেম ও ভালোবাসার জগৎ বড় রহস্যপূর্ণ। এখানে জীবনের সার্থকতা শুধু স্বপ্ন দেখার গভীরতায়, স্বপ্নের প্রাপ্তি বা অপ্রাপ্তিতে নয়। যে স্বপ্নের আবেদন যত গভীর এবং যে স্বপ্নের মিনতি যত মর্মস্পর্শী সে স্বপ্ন আল্লাহর তত প্রিয়, হোক তা প্রাপ্তির আনন্দে সিক্ত, কিংবা অপ্রাপ্তির বেদনায় তিক্ত।

একজনের বারবার ডাক আসে, বারবার তিনি শামিল হন হজ্বের সফরে, হিজাযের কাফেলায়।

আরেকজন সারা জীবন পথের কিনারে দাঁড়িয়ে দেখতে থাকেন হাজীদের কাফেলার চলে যাওয়া এবং ফিরে আসা। কেউ জানে না, এ দুই বান্দার মধ্যে কে আল্লাহর বেশি প্রিয়, ইহরামের সাদা লেবাসের মুসাফির, না পথের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা এবং ব্যাকুল নয়নে তাকিয়ে থাকা আল্লাহর এই মজবূর বান্দা!

সুতরাং আমার সালাম ও মোবারাকবাদ তাদের সবার জন্য; যারা সুন্দর করে স্বপ্ন দেখেন, যাদের স্বপ্নের ময়ূর পেখম মেলে তাদের জন্য এবং যাদের স্বপ্ন শুধু ডাহুকের ডাক ডেকে যায় তাদেরও জন্য। কারণ, উভয়ের স্বপ্ন দেখা সার্থক, যদি আল্লাহ কবুল করেন।❞

সত্যিই তাই, আমার মত গুনাহগার অধমকে আল্লাহ এমন একটা সুযোগ দিচ্ছেন, অথচ আমারচে হাজারগুণ যোগ্য, আল্লাহর প্রিয়, আশেকে রাসূল বান্দাহ রয়েছেন, যারা হয়তো বছরের পর পর বছর চোখের পানি ফেলেই যাচ্ছেন! আমরা যখন বলি, শুধু টাকা দিয়েই হজ্জ হয়না, আল্লাহর কবুলিয়াত লাগে, এটা যেমন সত্য। আবার এটাও একইসাথে সত্য যে, অনেক অসামর্থ্য আশেকে রাসূল আছেন, যাদের সামর্থ্য থাকলে হয়তো সবার আগেই বাইতুল্লাহ ঘুরে আসতেন, দিলের তামান্না থাকলেও সামর্থ্যের অভাবে হচ্ছেনা। তাই সামর্থ্য ও কবুলিয়াত দুটোই লাগে। আর হ্যা, আল্লাহ তা’আলা তো এজন্যই অসামর্থ্যবানদের উপর এই ইবাদাত ফরজ করেনওনি, তিনি এটা ফরজ করেছেনই সামর্থ্যবানদের উপর। আবার সময়ের পরিক্রমায় এমন অনেক হাজীও পাওয়া যায়, যাদের কানাকড়ির সামর্থ্যও ছিলোনা, শুধু দিলের তামান্না আর প্রচেষ্টা থেকেই আল্লাহ গায়েবী উপায়ে তাদের আল্লাহর ঘর ঘুরিয়ে এনেছেন।

সবরকম উদাহরণই পাওয়া যাবে। যাদের হজ্জ করার সামর্থ্য বা সুযোগ হয়নি, তাদের উচিৎ হাজীদের প্রতি সর্বোচ্চ সুধারণা রাখা- নিশ্চয়ই আল্লাহ কোন না কোন দিক দিয়ে সন্তুষ্ট হয়েই তাকে বাইতুল্লাহ সফরের সুযোগ দিয়েছেন, কারণ সামর্থ্য থাকার পরও তো শত শত মানুষ হজ্জ করতে যাচ্ছেনা, পারছেনা।

আবার যারা বাইতুল্লাহ সফরের সুযোগ পেয়েছেন, তাদের উচিৎ আল্লাহর শোকরগুজার হওয়া, আল্লাহর নিয়ামতের শোকর হিসেবে আরও বিনয়ী হওয়া। আর যাদের এই সুযোগ হয়নি কিন্তু তারা বাইতুল্লাহর জন্য পাগলপারা, তাদেরকে নিজের থেকে উত্তম মনে করা। কেননা, এমন কত হাজী আছেন, যারা লক্ষ টাকা খরচ করে হজ করে এসেও কবুলিয়াত পাচ্ছেন না, দেশে ফিরে আবার হারাম জীবনে ডুবে যাচ্ছেন। আবার এমন কত আশেকে রাসূল আছেন, যারা একটু একটু করে টাকা জমাচ্ছেন, হৃদয়ের সবটুকু আবেগ আর চোখের পানি বিসর্জন দিয়ে যাচ্ছেন শুধু কালো গিলাফ আর সবুজ গম্বুজের মায়ায়! আল্লাহর কাছে সামর্থ্য বা টাকার বৈষয়িক মূল্য নেই, মূল্য আছে অন্তরের নিয়ত ও ইখলাসের। কে জানে, কত অসামর্থ্যবানের চোখের পানির মূল্য আল্লাহর কাছে হাজীদের চোখের পানির চেয়েও অনেক বেশি দামি! আমরা কেউই জানিনা। বান্দাহর অন্তরের ইখলাসের হিসেব কেবল তার রবই জানেন। আমরা মানুষ হিসেবে সবাই নিজের কমজোরি আর অন্যের ব্যাপারে উত্তম ধারণা রাখাটাই অধিক তাক্বওয়ার।

আমাদের একজন শাইখ উনার বক্তব্যে বলেছিলেন- হজ্জ করে ফিরে যাবার পর হাজী সাহেবের হওয়া উচিৎ সবচেয়ে বিনয়ী, সবচে মুত্তাক্বী, কারণ সম্ভবত তার পূর্বের সকল গুনাহ মাফ করে দেয়া হয়েছে। বরং উল্টোটাই বেশি দেখা যায়, সে হয়ে ওঠে অহংকারী, নিজের নামের আগে পরে আলহাজ/হাজী ট্যাগ লাগিয়ে সদর্পে ঘুরে বেড়ায়, অথচ সে আদৌ জানেনা তার এই ইবাদাত কবুল হয়েছে কি হয়নি!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *