যে ভালোবাসা লুকিয়া রাখা বারণ

নববীতে প্রথমবারের মত একা ঢুকেছি সকাল সকাল, উদ্দেশ্য যোহরে জুমার জামাতে জায়গা ধরা। বিশাল বিস্তীর্ণ জনসমাগম ঠেলে নিজের বসার মত সুন্দর একটা ফাকা জায়গা খুজে নেয়া হারামাইনে পিক আওয়ারে অসম্ভবের মতই কঠিন, অফ পিক আওয়ারে অবশ্য অনেকটাই ঝক্কিহীন। আর হারামাইনের আযান ও নামাযের সৌন্দর্য, তা নিয়ে আরেকদিন আলোচনা করা যাবে। সেই এক সৌন্দর্যই বোধহয় কানে বাজতে থাকে হারানো বীণের মত বহুদিন, বহুকাল….

এদিকে ওদিকে পায়চারি করতেই রুম্মেট আন্টিদের পেয়ে গেলাম। নাহ, একাগ্র ইবাদাতের জন্য আসলে পরিচিত মানুষ বাদ দিয়ে একটু অপরিচিত মানুষের আশেপাশে থাকলেই ভালো হয়, পারলে বাঙালি এড়িয়ে চলাও ভালো, অযথা আলাপ করার প্রয়োজন হবেনা।

খানিক দূরে গিয়ে একদম ভিনদেশীদের মধ্যে বসে তাক থেকে থরে থরে সাজানো নানারঙ মুসহাফ থেকে একটা মুসহাফ আর রেহেল নিয়ে বসে গেলাম। কিন্তু বহির্বিশ্বে যাতায়াত এই প্রথম আমার, ভিনদেশী মুসলিমদের প্রতি রাজ্যের আগ্রহ ভেতরে ভেতরে। আর বিশ্বের সমস্ত মুসলিম দেশ থেকে আসা ভিনদেশী, ভিন ভাষাভাষী মুসলিমের সমাগম এই মিলনমেলায়, কেবল এক রবের ভালোবাসাতেই তো। মুসলিম উম্মাহর ঐক্যের চিন্তাফিকির করা কিংবা একে অপর থেকে জানা ও শেখা, ভ্রাতৃত্ববোধ প্রকাশ এটাও তো এই মিলনমেলার একটা উদ্দেশ্য। ভিনদেশী মুসলিমদের প্রতি ঐ ভালোবাসার জায়গাটা থেকেই কথা বলার আগ্রহ।

এক পর্যায়ে মুসহাফ বন্ধ করে ডানে বামে তাকালাম। কেউ কারোর ভাষা না বুঝুক, সবাই সবাইকে একটা বোবা মিষ্টি হাসি হলেও উপহার দেয়, কিংবা টুকটাক সালাম কালাম তো সবাই বোঝে। আর ইবাদাতের ফাকে ফাকে ব্যাগে যে যা খাবার এনেছে, বের করে নিজে খায়, পাশের জনকে দেয়, কেউ খেতেও অস্বীকার করেনা, দিতেও কুণ্ঠাবোধ করেনা- আসলে সবাই যে খুজছে সাওয়াব কুড়ানোর মওকা!

ঠিক বাম পাশে দু তিন জন ভিনদেশী বোন কুরআন নিয়ে কথা বলছে। আমিও এগোলাম, ওরাও কথা বলতে চাইলো। একজন সম্ভবত নাইজেরিয়ান, আরেকজন ফিলিস্তিনি। ফিলিস্তিন, আহা ফিলিস্তিন! মুসলিমদের প্রথম ক্বিবলা আল-কুদসের ধারক ওরা। জানা অজানা কত অজস্র নবীর পা পড়েছে ওদের মাটিতে, ঐ কুদসে! কি পবিত্র মাটিতে জন্ম ওদের, কী পরিমাণ সাহস, শৌর্য আর ত্যাগ ওদের শিরায় শিরায়! ওদের ৫ বছরের বাচ্চার দিলে দ্বীনের জন্য যে তামান্না, তা আমাদের ৫০ এরও নেই। আহা, লজ্জা!

নাইজেরিয়ান বোন ইংলিশ পারেন, ফিলিস্তিনি বোনের ভাষা আরবি। তো দুই ভাষাতেই অল্পবিস্তর দখল থাকায় কথা শুরু করা গেলো দুজনের সাথেই। এরা দুজন আবার কেউ কারও ভাষা বোঝেনা, এরা কুরআন হাতে নিয়ে হাতের ভাষা ও আকার ইঙ্গিতেই কথা বলছে। ফিলিস্তিনি বোন বাংলাদেশীর মুখে আরবি শুনে সে কি খুশি, বার বার বলছিলো- সওতকি জামিল! সওতকি জামীল!

আমি জানি, আমার আরবি নিতান্তই প্রাইমারি লেভেলের, তবু আলহামদুলিল্লাহ আল্লাহ এটুকু সুযোগ তো দিয়েছেন। অন্তত এতটুকু জানানোর জন্যই কথা বলা- বোন, আল্লাহর জন্যই আমরা তোমাদের দেশ, তোমাদের মাটি ও মানুষদের ভালোবাসি। ইনশাআল্লাহ জান্নাতে আমাদের আবার দেখা হবে! বোনটাও আবেগাপ্লুত হলো, কুরআন দেখিয়ে বললো- এই যে কুরআন, এই কুরআনই আমাদেরকে ভালোবাসার বন্ধনে বেধেছে! আল্লাহ আমাদের মুসলিম উম্মাহকে একত্রিত করুন।

দূর থেকে যাদের যুগ যুগ ধরে ভালোবেসে এসেছি, তাদের এক দুজনকে হলেও যে ভালোবাসাটা জানিয়ে দিতে পারলাম, এও অনেক বড় ভালোলাগা! হৃদয়ের তড়পটুকু হয়তো একজনের মাধ্যমেই আল্লাহ পৌছে দিতে পারেন দূরে, বহুদূরে….

‘মুসলিম উম্মাহ একটা দেহের মত, এর একটা অংশ কষ্ট পেলে অন্য অংশও ব্যথিত হয়’ আমার রাসূল সা. এর হাদিস। আমরা ওদের ব্যথায় ব্যথিত, আমরা দূর থেকে ওদের ভালোবাসি, ওদের জন্য হাত তুলে দুয়া করি, আল্লাহর রাসূলের মাটিতে বসে আমি এটুকু কাউকে জানাতে পেরেছি, এও আমার পরম পাওয়া।

ফিলিস্তিনি বোন আমাকে ছাড়তে চান না। আমি আরবি জানি দেখে এক নাগাড়ে কথা বলে চলছেন, কিন্তু উনাদের লোকাল আরবিতে গিয়ে আমি ঠেকে যাচ্ছি, আর বুঝতে পারিনা। ‘লা আফহাম’ টাইপ কিছু বলে মুখে হাসি দিয়ে কথা টেনে যেতে হচ্ছে। উনি নিজে আমাকে কুরআন পড়ে শোনালেন, আমার কুরআন পড়া শুনলেন। বোনটা আমাকে বললেন- নাইজেরিয়ান বোনটা কুরআন পড়া নিয়ে সমস্যায় আছে, তাকে একটু হেল্প করতে হবে, আমি যেহেতু ইংলিশ বুঝি, আমি যেন তাকে একটু হেল্প করি।

নাইজেরিয়ান বোনটার সাথেও ইংলিশে অনেক কথা হলো, সে আবার ফ্রেঞ্চ ভাষাও পারে, শিক্ষিত নিগ্রো বোন, মা শা আল্লাহ। আমি হেল্প করতে চাইলেও উনার হাতে সময় ছিলোনা, জুমাবার তাই তাকে কাহাফ পড়ে শেষ করতে হবে। অনেক কষ্ট করে রেকর্ড শুনে শুনে মুসহাফে আঙ্গুল দিয়ে দিয়ে কাহাফ পড়ার চেষ্টা করছেন, ঘণ্টার পর ঘণ্টা। সুবহানাল্লাহ, সবর! যে সুন্দর করে কুরআন পড়তে পারেনা, বার বার ঠেকে যায়, তাও চেষ্টা করতে থাকে, তার জন্য দ্বিগুণ সাওয়াব…. এই বোনেরাই বোধহয় সেই হাদীসের উপযুক্ত!

আরেকদিনের ঘটনা, ওয়াক্তের নামাযে নববীর ভেতরে জায়গা পেতে চাইলে অন্তত আধা ঘণ্টা এক ঘণ্টা আগে আসা লাগে হজ্জের মৌসুমে। তো সেদিন আসতে একটু দেরিই হয়ে যায়, মসজিদের গেটে ঢুকতে গেলেই পুলিশ বোনদের ‘ইয়াল্লা ইয়া হাজ্জাহ’ উক্তি শুনতে শুনতে মুখস্থ হয়ে গেছে ইতোমধ্যেই। আর ব্যারিকেড? মুহুর্তের মধ্যে কোনদিকে কখন ব্যারিকেড পড়ে যায়, বোঝা কঠিন। আমজনতা বিরক্ত হয়, আমরাও হই, তবে মুখে প্রকাশ করিনা। বুঝি ঠিকই, এই লক্ষ লক্ষ জনতার ঢল, এত বিশাল ক্রাউড কন্ট্রোল করা চাট্টিখানি কথা নয়। এই ক্রাউডের দায়িত্ব এদে হাতে ছেড়ে দিলে আবেগ-উচ্ছাস ও ভিড়ের ধাক্কায় পায়ের চাপায় নিজেরাই নিজেদের মৃত্যুর কারণ হবে। সেখানে তাদের সেফটির জন্যই এই স্ট্রিক্ট ক্রাউড কন্ট্রোল সিস্টেমটা জরুরি ছিলো। আলহামদুলিল্লাহ, ব্যবস্থাপকদের আল্লাহ উত্তম বিনিময় দিন।

যাহোক, মসজিদে ঢুকতে না পারলেও বিশাল চত্বরের কোথাও না কোথাও ফাক ফোকরে জায়গা মিলবেই, তা এসির তলায় হোক আর রোদের গরমেই হোক। বসে আছি, সামনে পেছনে উযবেকিস্তান, তাযিকিস্তান, মালি, ইন্ডিয়া, পাকিস্তান…. কত কত দেশের কত কত পোশাকের মানুষ! আল্লাহু আকবার! দূর থেকে দু’চারজন সাদা হিজাবে আবৃত মহিলা দেখতে পেলাম। পেছন থেকে দেখতে পাচ্ছি, সাদার উপর সুতা দিয়ে সেলাই করে আরবিতে লেখা- ইমারাতুল ইসলামী আফ_গানি_স্তান!

আহা! ভালোবাসার আরেক নাম! অন্তরের ভেতরটা ধাক্কা দিয়ে উঠলো। স্বপ্ন কল্পনার ভালোবাসার মানুষগুলো এত কাছে! অন্তত আমাদের ভালোবাসাটা জানানোর জন্য হলেও কাছে যেতে হবে। যেই ভাবা সেই কাজ, জুতা_ব্যাগ কাধে নিয়ে কয়েক কাতার পার হয়ে সেই কাতারে চলে গেলাম। আযান তখনো দেয়নি, নামাযের ব্যস্ততাও শুরু হয়নি। কয়েকজন আফগান বয়স্কা মহিলা। কাছে গিয়ে হাত বাড়িয়ে দিলাম-

আসসালামু আলাইকুম ওয়ারাহমাতুল্লাহ। আনা মিন বানগালাদেশ। নাহনু নুহিব্বুকুম ফিল্লাহ, আখাওয়াত!

জানিনা, উনারা আমার ভাঙাচোরা আরবি বুঝলেন কিনা। তবে ভালোবাসা আর সালামের উত্তর ঠিকই দিলেন মুখের হাসির মাধ্যমে। উত্তর দিলেন তাদের ভাষায়। আহা, আমি যদি বুঝতাম ওদের ভাষা! ওরা যদি বুঝতো আরবি বা ইংলিশ! চোখ আর মুখের ভাষায় ভালোবাসা বিনিময় করেই চলে আসতে হলো এই বেলায়। তবু আলহামদুলিল্লাহ! খোরাসানের পতাকাবাহীদের কোন এক গর্ভধারিণীকে তো দেখেছি, কথা বলেছি, আমার দেশ থেকে সালাম ও ভালোবাসা পৌছে দিয়েছি! ওরা বীরাঙ্গনা, ওদের গর্ভে বীরের জন্ম হয়, আমরা দুর্বলা, ওদের মত সিংহ শার্দুল সন্তান আমরা জন্ম দিতে পারিনা। তবু আল্লাহর জন্যই ওদের ভালোবাসি, আল্লাহ আমাদের দুর্বলতা, অক্ষমতা সত্ত্বেও শুধু এই ভালোবাসাটুকুর জন্যই যদি আমাদেরকে জান্নাতে ওদের প্রতিবেশি হিসেবে কবুল করেন! আমরা অধম গুনাহগার, তবু তো আল্লাহ দুয়া করলে উত্তম জান্নাতের দুয়া করতেই বলেছেন, আল্লাহর ব্যাপারেও উত্তম ধারণা রাখতে বলেছেন। ভালোবাসা জানিয়ে দেয়ার এই সুযোগটুকুও ক্ষুদ্র আমার জন্য প্রাপ্ত হিসেবে অনেক। আমার রাসূল সা. বলেছেন- তুমি যদি তোমার ভাইকে (অথবা বোনকে) ভালোবাসো (আল্লাহর জন্য), তবে তা জানিয়ে দাও। এটাই সুন্নাহ।

আরেকদিনের ঘটনা। কাবার মাতাফে তাওয়াফ করছি আমরা দুজন। যে ভীড়ের দমক, যারাই মাহরাম সাথে এনেছে, শক্ত করে হাত ধরে রেখেছে, কোনভাবে ছুটে না যায়। সেখানে নারী পুরুষ সবাই একসাথে কাবার চতুর্দিকে কেবলই রব্বে কা’বার সন্তুষ্টির সন্ধানে ঘুরে চলছে, মুখে প্রত্যেকের দুয়া। যেমনিভাবে আসমানের উপরেও ঠিক এই বরাবর লক্ষ কোটি মালাইকা প্রদক্ষিণ করে চলছেন বাইতুল মা’মুর, একবার তাওয়াফ করার পর যারা দ্বিতীয় বার আর সুযোগ পায়না, আল্লাহু আকবার!

তাওয়াফের এক পর্যায়ে সামনে তাকিয়ে দেখি পাগড়ি পরিহিত কিছু ভাই, কারও আবার পাগড়ির কিছু অংশ দিয়ে মুখটাও ঢাকা। পোশাকের পেছনে লেখা- ইমারাতে ইসলামী আফগা…. আহা! ওদের বিজয় দেখে আনন্দে কত ফোটা অশ্রু বিসর্জন দিয়েছি আমরা! কত সহস্র মাইল দূর থেকে আমরা ওদের শুধু আল্লাহর জন্যই ভালোবেসেছি!

আবু ফাতিমা বললো- ওদের চোখ দেখলে সিংহের মত মনে হয়! ভিড় ঠেলে এগিয়ে ও এক পাগড়িওয়ালা ভাইয়ের সাথে কথা বললো, তাদের প্রতি আমাদের ভালোবাসা জানালো ইংলিশে। ভাইটিও উত্তরে ভালোবাসা জানালেন, আমাদের দেশবাসীর কাছে উনাদের জন্য দুয়া চাইলেন।

আমার চোখে পানি এসে যায়। কল্পনায় চলে যাই কৈশোরে নসীম হিজাযীর লেখায় পড়া টিপু সুলতান, তারিক বিন যিয়াদ, মুসা বিন নুসায়ের, ইউসুফ বিন তাশফিন কিংবা মুহাম্মদ বিন কাসিমদের কল্পনায়, টগবগ করে ঘোড়া ছুটিয়ে মাথায় পাগড়ি বেধে যারা ছুটে চলছেন মরণ নেশায়, দ্বীনকে বিজয়ের নেশায়! কিংবা আল্লাহর রাসূল ও তার সাহাবায়ে কেরামদের সীরাতের পাতায়, সেইসব মানুষদের আজকের প্রতিচ্ছবি…. এইতো এরা… আগামীদিনের পতাকাবাহী ইনশা আল্লাহ।

হে আল্লাহ! তাদের জন্য আমাদের ভালোবাসাটুকুই আমাদের নাজাতের উসিলা হিসেবে কবুল করে নিয়েন। আমার বংশধরদের আপনি আমৃত্যু হক্বের পথে চলার, হক্বের আওয়াজ বুলন্দ করার, হক্বওয়ালাদের সঙ্গী হওয়ার তাউফীক্ব দিয়েন। আমীন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *