দ্বুয়ূফুর রহমান – রহমানের অতিথি

রাসূলের শহর মদীনায় পা দিয়েছি দুদিন হলো। মদীনার রাস্তায় প্রথম ঢুকতেই অন্যরকম আপন এক অনুভূতি ঘিরে নিয়েছিলো। একে তো আমার নবীর শহর, আনসারদের শহর, চিরচেনা চির আপন! দ্বিতীয়ত, রাস্তার দুই ধারে দোকানপাট সব আরবিতে নামাঙ্কিত, এই ভাষাটিও আমার অচেনা নয়। এ তো আমার কুরআনেরই ভাষা, এ তো আমার হৃদয়ের ভাষা!

ছোটবেলায় ৪-৫ বছর বয়সে যখন নতুন নতুন বাংলা রিডিং পড়া শিখেছি, বাসে চড়ে ঈদ-কুরবানীতে গ্রামে নানাবাড়ি দাদাবাড়ী যাওয়ার পথে ৬-৭ ঘণ্টার জার্নির পুরোটা পথ রাস্তার দুধারের দোকানপাটের নাম পড়তে পড়তে যেতাম! নতুন পড়তে শেখার সে কি আনন্দ! মদীনার রাস্তাঘাট দীর্ঘ ২৫ বছর পর আমাকে সেই ছোটবেলার আনন্দে ফিরিয়ে নিয়ে গিয়েছে- প্রত্যেকটা দোকান পাট হোটেল মসজিদ কলেজের নাম পড়ছি, অর্থ বুঝছি। আরব ড্রাইভারের বলা টুকটাক আরবিগুলোও বুঝতে পারছি। সারাজীবন শিখে আসা আরবির যেন এখানে প্র‍্যাক্টিক্যাল হচ্ছে! আরও কিছুদিন যদি থাকতে পারতাম! লোকাল আরবিটাও হয়তো অল্পবিস্তর রপ্ত করে ফেলা যেতো!

মদীনার রাস্তাঘাটের আরেকটা ভিন্নতা আছে, আমাদের দেশের মত দ্বিমুখী রাস্তা নয়, এক রাস্তার মধ্যে অনেকগুলো বিভিন্নমুখী রাস্তা। গাড়ি যখন চলছে, মাঝে মাঝে ১৮০ থেকে ৩৬০ ডিগ্রি এঙ্গেলেও বাক নিচ্ছে। পাহাড়ী রাস্তা বলেই এমন কিনা জানা নেই। তবে এত আকা বাকা রাস্তায় আমরা কেন, খোদ আরব ড্রাইভারেরাও চেনা পথ ভুল করে ফেলে! আকাবাকা পাজলের মধ্য দিয়ে চরকির মত এক পথেই বার বার ঘুরতে থাকে। কি বিরক্তি!

উহু, বিরক্ত কেন হবেন? মদীনার পথই তো! মদীনা মানে কী? মনে করিয়ে দিই। এই শহরের নাম আগে ছিলো ইয়াসরিব, যখন থেকে রাসূলের পদধূলি এখানে পড়েছে, তখন থেকেই এর নাম হয়েছে মাদীনাতুর রাসূল, রাসূলের শহর। তা থেকেই মদীনা। এ যে আমার রাসূলের শহর; উম্মতের দরদে যার চোখের পানি মিলে মিশে একাকার হয়ে আছে এই শহরের ধূলি, মাটি, পাহাড় আর আকাশ-বাতাসে! যখন এই পথ ছেড়ে দেশের চেনা পথে ফিরে যাবেন, বুঝতে পারবেন, কী মায়ার জাল বুনে দিয়ে গেছে এই শহর; এর অলি গলি, রাস্তাঘাট, সবকিছু! নববীর আযানের রেকর্ড শুনলেও আপনার অন্তর চিরে এফোড় ওফোড় হয়ে যাবে…..

নববী থেকে ট্যাক্সিতে উঠেছি, গন্তব্য যাহরাতুল মুনাওওয়ার। ড্রাইভার সাহেব আরব। গাড়ি চালাচ্ছেন আর গাড়িতে রেডিও চ্যানেল টাইপ কিছু একটা অন করা আছে। তিনি শুনছেন, আমরাও শুনছি। মনে হলো- শাইখদের কয়েকজনের করা টক-শো ধাচের আলোচনা। ওখানেই প্রথম শোনা-

‘দ্বুয়ূফুর রহমান’ ضيوف الرحمان- রহমানের অতিথি! ❤️

আগ্রহ বেড়ে গেলো, কান খাড়া করে শুনতে লাগলাম- সব কথা ওয়ার্ড বাই ওয়ার্ড না বুঝলেও জিস্টটুকু বুঝি, আলহামদুলিল্লাহ। হজ্জ মৌসুমে সারা বিশ্ব থেকে রহমানের অতিথিরা আসছে, কিভাবে তাদের খেদমত করতে হবে, কী তার ফাযায়েল, সেসব বলা হচ্ছিলো। আফদ্বলুস সদাক্বাতি সূক্বইয়াল মা-, অর্থাৎ পানি পান করানো শ্রেষ্ঠ সাদাক্বাহ! বুঝলাম, কেন ওরা এত বেশি পানি বিলায়। মরুর দেশ, অথচ সব জায়গায় পানির কল, পানির ফ্রি বোতল। অথচ আমাদের দেশে এত পানি তাও রাস্তায় পানি কিনেই খেতে হয়। হাদিস থেকে, রাসূল সা. ও সাহাবীদের সীরাত থেকে হজ্জ ও জিলহজ্জ বিষয়ক নানা ঘটনা কোট করা হচ্ছিলো সেই বক্তব্যে। নামার সময় হয়ে এলো, আবু ফাতিমা ড্রাইভার সাহেবকে জিজ্ঞেস করলো- উনি আহলে মাদীনা কিনা। হ্যা সূচক উত্তর দিলেন। তারপর আবু ফাতিমা তাকে জানালো, আহলুল মাদীনারা তো আনসারদের বংশধর, আল্লাহর জন্যই আমরা তাদের ভালোবাসি। তিনিও উত্তরে ভালোবাসা ও হজ্জের জন্য দুয়া জানালেন।

দ্বুয়ূফুর রহমান! ❤️

অন্যরকম ভালো লেগে গেলো কথাটা! এরপর আরও বহু জায়গায় শুনেছি, মসজিদের বয়ানে, হারামের খুতবায়, পথে ঘাটে, সব জায়গায় হাজী সাহেবদেরকে ওরা এই নামেই সম্মান দিয়ে ডেকে থাকে। কি চমৎকার কথামালা!

সত্যিই তো! হজ্জ সফরনামাগুলোতেও এরকমটাই পড়েছি। কেউ চাইলেই তো এই সফরে আসতে পারেনা, রহমান তার বান্দাহদের মধ্যে যাদেরকে পছন্দ করে নিয়ে আসেন, তারাই কেবল সুযোগ পায়। এই সাম্রাজ্য রহমানের, যারা আসে তারা রহমানের দাওয়াত পেয়েই আসে, তারা রহমানেরই মেহমান! আল্লাহ, আমাদেরকে আপনার মেহমানদারির যোগ্য ও আদব মেহমান হওয়ার সুযোগ দিন।

হজ্জের সফরে এসে অনেক সময় আমরা ছোট ছোট বিষয়ে বিরক্ত হই- কখনো খাবারের মেনু পছন্দ হয়না, কখনো মরুর রোদ, কখনো রাস্তার দূরত্ব, কখনো মুয়াল্লিমদের ত্রুটিবিচ্যুতি….. অথচ আমরা যদি একটু অন্যভাবে চিন্তা করি? সম্ভবত জুলফিকার আলি নকশাবন্দির ‘কাবার পথে’ বইতেই কিনা, চমৎকার একটা কথা পড়েছিলাম-

“শরীফ মেহমান কখনো মেজবানের বদনাম করে না। আর হাজীরা তো সরাসরি আল্লাহরই মেহমান, তারা কীভাবে তার আপ্যায়নের বদনাম করতে পারে?”

এই অমূল্য কথাটুকু মাথায় গেথে নিলে সত্যিই মক্কা-মদীনার কোন বিষয়ে অভিযোগ করতে লজ্জা হবে, শ্রদ্ধায় মাথা নুয়ে আসবে। আল্লাহ আমাকে এত আদর করে ভালোবেসে তার ঘরের মেহমান করে আনলেন, আর আমি কিনা তার মেহমানদারির ভুল ধরায় ব্যস্ত? কত বড় গোস্তাখ! আর আল্লাহর কত লক্ষ কোটি প্রিয় বান্দা দিনের পর দিন চোখের পানি ফেলছেন শুধু এই মদীনার পথের ধুলি হতে চেয়েই! কতজন বাইতুল্লাহর স্বপ্ন বুকে নিয়ে কবরতলার বাসিন্দাও হয়ে গেছেন!

আফসোস! আমি আপনি আল্লাহর ঘরের মেহমান তো হয়েছি, ‘শরীফ মেহমান’ হতে পেরেছি তো? বেয়াদবি হয়ে গেলে তাওবা ইস্তিগফার করে নিই, আর যেন না হয়।

মনে পড়ে, মদীনায় ঢোকার পথে কিছু সময়ের জন্য অন্য এজেন্সীর এক বাসে উঠতে হয়েছিলো। তাদের মুয়াল্লেম সাহেবের কিছু কথা কানে ভাসে এখনো-

আমরা মদীনায় ঢুকছি, এটা রাসূলের শহর! এখানে আমরা যেন উচ্চস্বরে কথা না বলি, রাসূলের শানে বেয়াদবি হবে। সরাসরি কুরআন পাকে আল্লাহ তা’আলা এই আদেশ করেছেন- তোমরা রাসূলের সামনে উচু স্বরে কথা বোলোনা। আমরা যতদিন মদীনায় আছি, রাসূলের প্রতি এই আদবটুকু বজায় রাখবো ইনশাআল্লাহ।

আল্লাহুম্মা সল্লি ওয়া সাল্লিম ‘আলা নাবিয়্যিনা মুহাম্মাদ, আল্লাহুম্মা সল্লি ওয়া সাল্লিম আলা আলা শাফিয়াল মুযিনিবীন, খতামান নাবিয়্যীন, রহমাতুল্লিল আলামীন….

সত্যিই কি পেরেছিলাম, পুরোটা মদীনার সফরে সেই আদব বজায় রাখতে? জানিনা, লিখতে গিয়ে চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে আসে….

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *