বায়োমেট্রিক রেজিস্ট্রেশন ও ভ্যাক্সিনেশান: সবরের প্রথম ধাপ

হজ্জের সফর মানেই সবরের সফর। বাইতুল্লাহর মুসাফির বইতে পড়েছিলাম সম্ভবত, হজ্জের সফরে কোন না কোন দিক দিয়ে পরীক্ষা আসবেই- হোক শারিরীক, মানসিক বা আর্থিক। লেখক নিজেও হজ্জের সফরে কীভাবে পরীক্ষার সম্মুখীন হয়েছিলেন, সেই বর্ণনা দিয়েছেন। এ তো হলো মাঝারি থেকে বড় আকারের পরীক্ষা, তবে প্রতিমুহূর্তে সবর ধরে রাখার চ্যালেঞ্জ ফেইস করতেই হবে।

হজ্জের সিরিয়ালে নাম আসার পর অফিসে কিছু কাগজপত্র জমা দিয়ে এলাম। এর কিছুদিন পর সময় এলো সৌদি ভিসার বায়োমেট্রিক রেজিস্ট্রেশনের: Saudi Visa Bio এপ থেকে পাসপোর্ট, মুখ আর দুই হাতের ১০ আঙ্গুলের ফিঙ্গারপ্রিন্ট মিলাতে হবে। এ এক বিশাল ঝক্কি! শুরু করতেই ভয় পাচ্ছিলাম, আম্মু ভাইয়ার ফিঙ্গারপ্রিন্ট নেয়ার সময় দেখেছিলাম কী হ্যাসেল- দুই দিন চেষ্টার পরও যখন হলোনা, তখন তৃতীয় দিন আম্মু ২ রাকাত নামাজ পড়ে দুয়া করে আবার বসলেন, ভাইয়া মোবাইল দিয়ে ট্রাই করলো, আলহামদুলিল্লাহ একবারেই হয়ে গেলো।

আমরা তখন রাজশাহী এসেছি ফাতিমা ইব্রাহীমের দাদাবাড়ি, ১ মাস পর হজ্জের সফর, একটু লম্বা সময় বাচ্চারা দাদা-দাদীর সাথে থেকে যাবে, এই নিয়তে। বাচ্চাদের নিয়ে আমি একটু ব্যস্ত থাকায় আবু ফাতিমাই বায়োমেট্রিক রেজিস্ট্রেশন শুরু করলো, সেও যথারীতি প্রথম দুই চার বারে ব্যর্থ হয়ে তারপর উতরে গেলো। এরপর আমার পালা। পাসপোর্ট, ফেইস একবারেই মিলে যাচ্ছে, কিন্তু প্রতিবারই ফিঙ্গারপ্রিন্টে এসে ঝামেলাটা লাগছে, ১০ আঙ্গুলের ছাপই একটা একটা করে বহু সময় ধরে নিচ্ছে, সবশেষে error, try again এরকম কিছু একটা বলছে। এগেইন ট্রাই করতে করতে প্রতি দফায় মোটামুটি হাত ব্যথা হয়ে যাচ্ছে, আলহামদুলিল্লাহ।

একদিন, দুই দিন, তিন দিন, চার দিন…. দিন বেড়ে চলছে, আর প্রতিদিনই কয়েকবার করে চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে ইস্তফা দিতে হচ্ছে। নিজের মোবাইলে হচ্ছেনা দেখে আবু ফাতিমার মোবাইল, শাশুড়ীর মোবাইলেও মেইল থেকে লগিন করে চেষ্টা করতে লাগলাম, আঙুলের ছাপজনিত সমস্যা তো রয়েই গেলো, উপরন্তু একাধিক সেট থেকে লগিন করায় আরও নতুন কিছু ঝামেলা যুক্ত হলো। এই পর্যায়ে বুঝে আসলো- সবরের পরীক্ষা সফরের আগেই শুরু হয়ে গেছে! আল্লাহ, আপনি পরীক্ষায় পাস করার তাউফীক দেন। শুরুতেই ফেইল করে গেলে পরের ধাপগুলোতে কী হবে?

মনের মধ্যে নানা ধরণের কুচিন্তা উকি দিতে লাগলো- আচ্ছা, যদি এমন হয় যে আঙ্গুলের ছাপ আর মিললোই না, তখন কী হবে? কী করা উচিৎ তখন? এজেন্সির whatsapp গ্রুপে তখন বার বার সবার আপডেইট চেক করছি, অনেকেই বাসায় রেজিস্ট্রেশন করতে গিয়ে এই ঝামেলায় পড়ছেন, পরে তারা এজেন্সির অফিসে গিয়ে ট্রাই করছেন। অনেকের হয়ে যাচ্ছে, তবে অনেকের ওখানে গিয়েও হচ্ছেনা। এই মুহুর্তে রাজশাহী থেকে ঢাকায় ওদের অফিসেও যাওয়া সম্ভব না। আবার অনেকের নাকি সব হয়েও মেইলে কনফার্মেশন আসছে না। অভিজ্ঞদের কাছ থেকে পরামর্শ নিয়ে একবার আঙ্গুলে তেল দিচ্ছি, আরেকবার দিনের আলোয় জানালায় পাশে ট্রাই করছি, আরেকবার আঙ্গুলের ডগা সাবান দিয়ে ধুয়ে নিচ্ছি, আরেকবার ব্যাকগ্রাউন্ডে কালো কুচকুচে কাপড় দিয়ে ট্রাই করছি, মোবাইল সেট চেইঞ্জ করছি। নাহ, কোনভাবেই হচ্ছেনা….

তাহলে বিকল্প কী? আচ্ছা, এমন তো শুধু নয়, কারও তো এক্সিডেন্টে এক আঙ্গুল কেটেও যেতে পারে! কারও ঐ মুহুর্তে আঙ্গুলের কোন অপারেশন লাগতে পারে, আঙ্গুলের যেকোন সমস্যা হতে পারে! তাহলে তারা কী করবে? সময়ও ফুরিয়ে যাচ্ছে, নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই এই কাজ শেষ করতে হবে। একটু ঘাটাঘাটি করে জানতে পারলাম- একদম না পারা গেলে বিকল্প আছে, হাতের কোন রোগ থাকলে ডাক্তারের কাছ থেকে তার সার্টিফিকেট এনে জমা দিতে হবে, তখন ওরা বিবেচনা করবে। কিন্তু আমার হাতে তো জানামতে কোন রোগও নেই!

আল্লাহুম্মা ইয়াসসির লী।

আল্লাহুম্মা লা সাহলা ইল্লা মা জা’আলতাহু সাহলা। ওয়া আনতা তাজ’আলুল হাযনা ইযা শি’তা সাহলা।

(আমার জন্য সহজ করে দেন হে আল্লাহ।

আপনি যা সহজ না করেন, তা কখনোই সহজ হয়না।…..)

ভাইয়ার কাছে পরামর্শ নিলাম, ভাইয়া বললো, আরেকটু ভালো মানের মোবাইল সেটে ট্রাই করতে। রাজশাহীতে এমন কাকে পাওয়া যায়? মাথায় আসলো দুই ছোট বোনের নাম- তৃনা আর রওশন, এই দুইজন টেক এডভান্সড, এদের কাছে কাঙ্ক্ষিত মানের সেট পাওয়া যেতে পারে। দুজনকেই ফোন দিয়ে উত্তম সাহায্যের আভাস পাওয়া গেলো (জাযাহুমাল্লাহ)। তৃনা সেদিনই রাত ৯ টার দিকে দুই দুটি সেট নিয়ে হাজির হলো বাসায়। একটায় ট্রাই করে না হলে যেন আরেকটায় ট্রাই করা যায়, দুটোই বেশ ভালো সেট। দুটোতেই ও নিজে আমার মেইলে লগিন করে দিলো।

আলহামদুলিল্লাহ আলহামদুলিল্লাহ আলহামদুলিল্লাহ। অবশেষে আল্লাহ আমার জন্য সহজ করলেন। দুটো সেটে ট্রাই করা লাগেনি, প্রথম সেটে একবার ট্রাই করতেই ১০ মিনিটের মধ্যে হয়ে গেলো। সবরের একটা মাঝারি মানের পরীক্ষা হলেও শেষে এসে আল্লাহ পুরোটাই সহজ করে দিলেন। সুম্মা আলহামদুলিল্লাহ।

রাজশাহী থেকেই প্রয়োজনীয় মেডিকেল টেস্টগুলো করে ঢাকা ফিরলাম। ভ্যাক্সিন দিতে ভ্যাক্সিনেশন সেন্টারে যেতে হবে। বাচ্চাদের বাসায় রেখে কোথাও লম্বা সময়ের জন্য যাওয়া এক ঝামেলা, আবার ছোটটাকে নিয়ে বের হলে তো ব্যাগের মধ্যেই এক বিশাল এরেঞ্জমেন্ট নিয়ে বের হতে হয়, আর কান্নাকাটি তো আছেই। আম্মা আব্বা বললেন- বাচ্চাদের রেখেই যাও, কত সময় লাগে, বলা তো যায়না!

বাচ্চাদের আব্বু আম্মুর কাছে রেখে ভ্যাক্সিনের জন্য বের হলাম- সোহরাওয়ার্দী হস্পিটালের সেন্টারে। ভ্যাক্সিন দেয়ার জায়গায় পৌছেই দেখলাম, বড় করে হাজীদের জন্য শুভকামনার বার্তা লেখা চারপাশে। গার্ডরাও সবাইকে হাজী সাহেব বলেই ডাকছেন। কি অদ্ভূত! হজ্জ তো শুরুই হয়নি, হাজী হলো কিভাবে? সে যাই হোক, বাইতুল্লাহর মুসাফিরদের এভাবে সম্মান দেয়াটা ভালোই লাগলো।

ভ্যাক্সিন দিতে গিয়ে সেদিনও আরেকবার টের পেলাম- আসন্ন সবরের প্রস্তুতি! মাত্র দুইটা টিকা নেয়ার জন্য কতবার যে লাইনে দাড়াতে হলো! বায়োমেট্রিকের মত এইখানেও আবু ফাতিমার সহজে হয়ে গেলো, দুইটা লাইনে দাড়ায়েই টিকা দিয়ে ফেললো। এদিকে আমার অবস্থা আগের মতই। মহিলাদের সাথে লাইনে দাড়াচ্ছি, আধা ঘণ্টা দাড়ানোর পর ভ্যাক্সিনের লোকেরা উঠে যাচ্ছে, আমাকে আবার আরেক লাইনে গিয়ে দাড়াতে হচ্ছে।

হজ্জের প্রস্তুতি- এখানে বেসবরি করা যাবেনা, অন্যদের ইহসান করতে হবে, তাহলে ইনশাআল্লাহ মাবরূর হজ্জের প্রত্যাশা, এটাতো কেবলই একটা রিলাক্স ট্যুর না, এখানে কষ্ট আছে, সবর আছে, তা সানন্দে গ্রহণ করার মাঝেই কবুলিয়াতের প্রত্যাশা। পশুর কুরবানি, সেই সাথে নিজের ‘আমিত্ব’টাকেও কুরবানি করে আসতে হবে- তুমি যে আল্লাহর গোলাম, আবদ, এই উবুদিয়্যাতের সাক্ষ্য তোমাকে দিতে হবে ঘাটে ঘাটে….

লাইনে আগে বাড়ার জন্য কোন ঝামেলা করবোনা। যদিও হজ্জের সফর না হলেই ঝামেলা করতাম, এমন না, আমি এমনিতেও ঝামেলা এড়িয়ে চলতেই পছন্দ করি, তাতে নিজের একটু সমস্যা হলেও, আলহামদুলিল্লাহ। তবে হজ্জের প্রস্তুতি হিসেবে নাফসকে আরও একটু বেধে রাখার চেষ্টা। লাইন থেকে বের হয়ে আন্টি বয়সের কয়েকজন ৩০-৪০ মিনিট পরে এসে আবার ঢুকতে চাইলেন, শব্দটি করিনি, অন্যরা না করা সত্ত্বেও অন্যদের একটু রিকোয়েস্ট করেই উনাদের ঢুকতে দিলাম, যেহেতু উনারা আমাদের আগেই দাড়িয়েছিলেন। দেখলাম, অনেকেই চেষ্টা করছে হজ্জের সফরের সবর ধরে রাখার। পুরুষদের সারিতে, মহিলাদের সারিতে কেউ না কেউ সবরের নসীহত দিচ্ছে। বেশ ভালো লাগলো, বোঝা গেলো অনেকেই পড়াশোনা করছে, হজ্জের ট্রেইনিং নিচ্ছে। আবার টিপিক্যাল বাঙালিওয়ানাও দেখলাম। এইখানে লাইনে দাড়িয়েও কতিপয় আন্টি নিজেদের ‘মুক্তিযোদ্ধা’ সার্টিফিকেটের দোহাই দিচ্ছেন, তাদেরকে লাইনের আগে যেতে দিতে হবে। সব জায়গায় তাদের জন্য ছাড় আছে, এখানে কেন নয়? ভেতরে ভেতরে অনেকেই বিরক্ত হলেন, প্রকাশও করলেন- তবে এ দেশে সার্টিফিকেটধারীরা কে কার বিরক্তির খোজ রাখে? সার্টিফিকেট থাকলে জুলুমই যেখানে বৈধ হয়ে যায়! এক শিক্ষিতা ভদ্রমহিলা তো বলেই ফেললেন- এই সার্টিফিকেট দিয়ে সব পারলেও আল্লাহর কাছে হজ্জ কবুল করাতে পারবেন না কিন্তু! ঐখানে লবিং চলবে না….

যাক সে কথা। লাইনগুলোতে দাঁড়িয়ে মনে হলো- বয়সে আমিই হয়তো এখানে কনিষ্ঠতম। যাক, তাহলে ইহসান আমিই করি। অন্যরা বয়স্ক মানুষ, আর বয়স্কা মহিলাদের কত কত অসুস্থতা! তবে ইহসান করতে গিয়ে টের পেলাম, যে লাইনের শুরুতে আমার থাকার কথা, সেখানে আমার জায়গা হয় সবার শেষে। একটা কথা জিজ্ঞেস করার জন্য লাইন থেকে মাত্র ২০ সেকেন্ডের জন্য বের হয়েছিলাম, যাদেরকে ৪০ মিনিট পর আসার পরও আমি নিজে তাদের লাইনের আগের জায়গায় ঢুকতে দিয়েছিলাম, সেই তারাই আমার ২০ সেকেন্ডের বের হওয়া সহ্য করতে পারলেন না, আমাকে ঢুকতে দিলেন না- বের হইসেন কেন? পিছনে গিয়ে দাড়ান।

লাইনের শুরু থেকে ছিটকে একদম পেছনে, আলহামদুলিল্লাহ। লাইনের মহাজ্যাম পার হয়ে ভ্যাক্সিন দেয়া শেষ করতে মোটামুটি ঘণ্টা দুই লেগে গেলো। তবে মজার বিষয় হচ্ছে, যারা লাইনে আগে দাড়ানোর জন্য খুব হুড়োহুড়ি করছিলো, কেউ সার্টিফিকেটের জোর, কেউ স্বার্থপর মনোবৃত্তি…. ভ্যাক্সিন দেয়া শেষ করে দেখলাম, ইনারাও মোটামুটি একই সময়েই বের হচ্ছে। সময়ের হেরফের ৫-৭ মিনিটের বেশি হয়নি। অথচ এই সামান্য সময়ের জন্যই কতজন তাদের আচরণের কদর্যতা দেখিয়ে ফেললেন! আসলে বাস্তবেও এমনটাই হয়- প্রয়োজনের সময় আমরা সামান্য ধৈর্য না ধরে, অন্যের জন্য সামান্য ইহসান না করে ব্যতিব্যস্ত হয়ে যে বেসবরি ও আচরনের বাড়াবাড়িগুলো করে বসি; ফলাফল পাওয়ার পর বেশিরভাগ সময়ই দেখা যায়, ঐ বাড়াবাড়িটুকু না করলেও ফলাফল ওরকমটাই হতো। এরই নাম তাক্বদীর, অনিবার্য তাক্বদীরকে এড়ানোর জন্য আমরা নিজের ও অন্যদের উপর বাড়াবাড়ি করে ফেলি, অথচ শেষ পর্যন্ত তাক্বদীরই আমাদের উপর জয়ী হয়। এটাই আল-ক্বাদা ওয়াল ক্বদর। অথচ মাঝখান দিয়ে কেউ স-বিরুনদের অন্তর্ভুক্ত হয়, আর কেউ খ-সিরুনদের অন্তর্ভুক্ত হয়। আসলে সবরের পরীক্ষার মর্মই এটা- বান্দাহ না চাইলেও ঐ সবরের পথ সে এড়াতে পারবেনা, তবে সে ধৈর্যের সাথে পথটা পার হবে, না অধৈর্য আর অভিযোগ-অনুযোগের সাথে পার হবে, এই সিদ্ধান্তটা তার: দুনিয়াবি ফলাফল যেমনই হোক, আল্লাহর কাছে প্রাপ্যটা তার এই সিদ্ধান্ত ও নিয়তের সমানুপাতেই নির্ধারিত হবে।

বুঝতে পারলাম, ইহসান করাটা খুব সোজা নয়। আল্লাহ সহজ না করলে আরও কঠিন। যে কাজ আবু ফাতিমা বিশ মিনিটে করে বসে আছে, সেই একই কাজে আমার লাগলো দুই ঘণ্টা। আমার জন্য সবকিছুই কি কঠিন করে দিচ্ছেন আল্লাহ?

– তোমার জন্য আল্লাহ সব সহজ করে দিচ্ছেন। আমি গুনাহগার তাই আল্লাহ এখন থেকেই কঠিন করে দিচ্ছেন। (আলহামদুলিল্লাহ)

– উহু, আল্লাহ যার হজ্জে মাবরূর চান, তার জন্যই কঠিন করেন। তোমার জন্য সুসংবাদ, ইনশা আল্লাহ।

আল্লাহর চাওয়া যেটাই হোক, পরস্পরের প্রতি সুধারণা পোষণ করে এই যাত্রার ইতি টানা হলো, আলহামদুলিল্লাহ। এরপর রিকশায় ওঠা, গন্তব্য ‘শেফার্ডস’ হজ্জ এজেন্সীর অফিস, আজ পাসপোর্ট জমা দিয়ে যেতে হবে….

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *