হাজীদের খিদমত…পথে পথে পদে পদে

ছোটবেলা থেকেই শুনতাম- অল্প বয়সেই হজ করে ফেলা উচিত। কেননা, হজের জন্য যে শারীরিক ও মানসিক ধকল সইতে হয় তা বৃদ্ধ বয়সে অনেকের পক্ষেই সম্ভব হয় না। এই কথার বাস্তবতা টের পেয়েছিলাম হজের সফরে গিয়ে। আমাদের মত ইয়াং মানুষও অনেক জায়গায় রীতিমত হাঁপিয়ে ওঠে। বিশেষত হজের দিনগুলি সত্যিই বড় পরীক্ষা হিসেবে আবির্ভুত হয়- অবশ্য আল্লাহ বান্দার জন্য সহজ করে দেন। নতুবা কীভাবে ষাটোর্ধ-সত্তরোর্ধ (বিশেষত এই ভারতীয় উপমহাদেশের, যাদের নানাবিধ রোগ-ব্যাধিতে শরীর ভেঙ্গে পড়ে পঞ্চাশের পরেই) মুরুব্বিদের পক্ষে হজের কাজগুলি সুষ্ঠুভাবে আঞ্জাম দেওয়া সম্ভব?

৮ই যিলহজ মিনার তাঁবুতে অবস্থান নেওয়া থেকে শুরু করে ১৩ই যিলহজ্ব হজের কার্যাবলী থেকে ফারেগ হওয়া পর্যন্ত শারীরিক পেরেশানি ছাপিয়ে সবচেয়ে বড় যে পেরেশানি মানুষের মনে ঘুরপাক খায় তা হল- আমার হজ ঠিকমত হচ্ছেতো? কোনোকিছু ভুল হয়ে যাচ্ছে নাতো? এজন্য কাফেলায় একজন আহলে ইলম আলেম থাকা খুব প্রয়োজন। যাই হোক, এত এত পেরেশানির মাঝে হজের ফরয-ওয়াজিব-সুন্নাহগুলো মেইনটেইন করে আবার ব্যক্তিগত নফল আমল করা কিছুটা কঠিনই বটে- তবে অসাধ্য বা অসম্ভব নয়। কিন্তু ঐ যে আমার মত দূর্বল ঈমান ও আমলওয়ালাদের জন্য এক প্রকার দুরূহ। তাই হজের দিনগুলিতে বেশি বেশি সাওয়াব কামিয়ে নেওয়া এবং কবুল হজের সম্ভাবনা বৃদ্ধির জন্য কী করা যেতে পারে- এটি ছিল আমার প্রি-হজ স্টাডির অন্যতম অংশ। কিছুটা পড়াশোনা করে যা পেয়েছিলাম এবং হজের সফরে যা দেখেছি তাই আজ শেয়ার করব আপনাদের সাথে।

হজের সফরে দুটি কাজ করুন বেশি বেশি-

১. ফালা রফাসা… আয়াতের স্মরণ করুন এবং মুখ বন্ধ ও মাথা ঠাণ্ডা রাখুন এবং

২. হাজীদের খিদমত করুন।

ভাবতে পারেন- হাজীদের খিদমত আবার কীভাবে করবেন? এই খিদমত কিন্তু শুধু হজের দিনগুলিতেই নয় বরং আপনি সেখানে যাওয়ার পর থেকেই শুরু করে দিবেন এবং সবচেয়ে বেশি চেষ্টা করবেন হজের দিনগুলিতে। কীভাবে এই চেষ্টা করতে পারেন দেখুন।

হজের কার্যাবলী শুরু হওয়ার আগেই-

  • হারামাইনের প্রাঙ্গন থেকে ভেতরে ঢুকে মূল মসজিদে ঢোকার গেইটে আপনি পলিথিন বিতরণ করতে পারেন। লজ্জার কিছু নেই- অনেকেই করে এবং এটা বেশ কাজে দেয়। জুতা রাখার জন্য আলাদা ব্যাগ না নিয়ে অনেকে বিপাকে পড়ে যায়, তাদের জন্য এই পলিথিনগুলো খুব কাজের জিনিষ! আবার অনেকে আছে টিস্যু নিতে ভুলে যায়, তারা পলিথিন থাকলে মাতাফে বা এমন জনসমাগমের জায়গায় সেটা ব্যবহার করে হাঁচি দিতে পারেন। এভাবে পলিথিন হারামাইনের ভেতরে অনেক কাজে আসতে পারে। তাই সুযোগ পেলে সেগুলো বিতরণ করুন।
  • হারামাইনের ভেতরে আপনি খেজুর ও পানি বিতরণ করতে পারেন খুব সহজেই। প্রচুর মানুষ এই সময় নফল সিয়াম পালন করে, দেখবেন- মাগরিবের আগে তারা ইফতার নিয়ে বসে গেছে। হারামাইন থেকেও ইফতার দেওয়া হয়। তবে আপনি যদি একটি এক্সট্রা খেজুর ও এক ঢোক পানি দিতে পারেন তবে মন্দ কী! অগণিত মানুষের সিয়ামের সাওয়াব আপনিও পেতে পারেন সহজেই।
  • হারামাইনের আশেপাশে বেশ কিছু দোকান আছে যেগুলোতে ছোট্ট গোলাকৃতির ফোল্ডিং চেয়ার পাওয়া যায়। এই চেয়ারগুলো মসজিদের মধ্যেও প্রচুর দেখতে পাবেন-সাদা ফ্লুইড দিয়ে লিখা থাকে- خاص للحرام

এই চেয়ারগুলোর দাম বেশ রিজনেবল এবং এগুলো মাটিতে বসতে অক্ষম মানুষের জন্য দারুণ উপকারী। আপনি কিছু চেয়ার কিনে (অন্তত ১টি হলেও!) মসজিদে রেখে দিতে পারেন, মসজিদের ভেতরে রাখতে না পারলেও মসজিদের প্রাঙ্গণে রেখে আসতে পারেন। যতদিন ঐ চেয়ারে বসে মানুষ সালাত আদায় করবে তার সাওয়াব আপনি পাবেন- আর হারামাইনে সালাত আদায়ের সাওয়াব জানা আছে তো?!

  • আপনি কিছু ছোট ছোট (একেবারে মিনি সাইজ) ছাতা সাথে রাখতে পারেন, কপালের সাথে ব্যাণ্ড দিয়ে আটকানো ছাতাগুলো দিয়েও সুন্দর কাজ চালানো যায়। অনেক মানুষ দেখবেন যারা মক্কা-মদীনার প্রখর রোদের ভেতর ছাতা নিতে ভুলে যায়। আপনি একটি ছাতা দিয়ে হলেও একজন মানুষের প্রশান্তির কারণ হতে পারেন।
  • অনেক মানুষ (বিশেষত বয়ষ্ক শ্রেণীর মানুষ) রাস্তা হারিয়ে ফেলেন। মসজিদে এসে আর হোটেলে ফিরতে পারেন না। আর বিষয়টা আসলেই কিছুটা জটিল। এত এত গেট! সবগুলো গেট আবার একইরকম লাগে! গোলাকৃতির কারণে মসজিদে নববীর চাইতে মসজিদে হারামে পথ হারানো বেশি সহজ। তাই মসজিদ থেকে পথ হারিয়ে হোটেলে ফিরতে পারছে না এমন মানুষদেরকে আপনি হোটেল পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে আসতে পারেন। নিদেনপক্ষে কাছাকাছি দিয়ে আসা কঠিন কিছু নয়।  

হজের দিনগুলোতে-

  • মীনার তাঁবুতে প্রচণ্ড গরম ও পানির পিপাসা কষ্টের অন্যতম কারণ। যদিও তাঁবুর বাইরে কিছুদূর পরপরই ফ্রিজ থাকে এবং সেখানে ঠাণ্ডা পানির বোতল এভয়লেবল থাকে, তবে অনেকেই (বিশেষত বয়ষ্ক মানুষেরা) তাঁবুর বাইরে যেতে চান না দুটি কারণে-
    • ফ্রিজগুলো নির্দিষ্ট দূরত্ব পরপর থাকে তাই খোঁজাখুঁজি করতে গিয়েও নিজের তাঁবু হারিয়ে ফেলার সমূহ সম্ভাবনা থাকে। কেননা, মীনার সকল তাঁবু দেখতে একই রকম।
    • মহিলারা তাঁবুর ভেতরে হিজাব খুলে রিল্যাক্সে থাকতে পারেন কিন্তু বারবার তাঁবুর বাইরে বের হতে হলে নতুন করে হিজাব পরে বের হওয়া কষ্টসাধ্যই বটে, তাও আবার প্রখর রোদের মধ্যে! একারণেই অনেকেই পিপাসা নিয়েও তাঁবুর ভেতর বসে থাকেন।

এই জায়গাটাই হল পানি বিতরণের মাধ্যমে খেদমতের অন্যতম সেরা সুযোগ। আপনি এবং আপনার মত শক্ত-সমর্থ কিছু মানুষ প্রত্যেকে হাতে দু-তিনটি করে ব্যাগ নিয়ে বের হয়ে যান এবং ব্যাগ ভর্তি হীমশীতল ঠাণ্ডা পানির বোতল নিয়ে পুরুষ ও মহিলাদের তাঁবুতে দেওয়ার ব্যবস্থা করুন। তাদের অন্তরের প্রশান্তি আর দূয়া হয়ত দেখতে পাবেন না কিন্তু মুখে খুশির যে ঝিলিক দেখবেন তা আপনার মনকে শীতল করে দিবে-নিশ্চিত থাকুন।

  • আরাফার ময়দানেও আপনি শীতল পানির বোতল বিতরণ করতে পারেন তবে এখানে একটি অতিরিক্ত সতর্কতা রয়েছে- আরাফায় অবস্থানের মূল সময় যোহর থেকে মাগরিব। আর এই সময়টাই হল দূয়া, দূয়া আর দূয়ার সময়। তাই আপনার এজেন্সি যদি সকাল বেলায়ই আরাফায় নিয়ে চলে যায় তবে মীনার মত এখানেও পানি ও শুকনা খাবার বিতরণ করতে পারেন তবে যোহরের পর থেকে পরিপূর্ণভাবে মন দিন নিজের দূয়া ও যিকিরে-মাগরিব পর্যন্ত সময়টুকু একান্তই আপনার নিজের সময়। একটি মুহূর্তও যেন নষ্ট না হয়-সেদিকে লক্ষ্য রাখুন।

এখানে একটি বিষয় স্মরণ করিয়ে দিতে চাই- যদি আপনি মনে করেন আরাফার ময়দানে খুব ঠাণ্ডা মাথায় দূয়া করবেন তবে আপনি ভুলের মধ্যে আছেন। কারণ, এত তীব্র গরম এবং প্রখর রোদের মাঝে (আমাদের সময় আরাফার দিন তাপমাত্রা ছিল ৪৬ ডিগ্রী সেলসিয়াস!) ছোট্ট একটু জায়গায় অনেকগুলো মানুষ গাদাগাদি করে থাকতে হবে- তখন এমনিই ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা হয়ে যায়। ঠাণ্ডা মাথায় ও শারীরিক প্রশান্তিতে থাকার সুযোগ আরাফায় নেই বললেই চলে। তাই দেখবেন, বিকালের দিকে অনেক মানুষ তাঁবু থেকে বের হয়ে এসে গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে একাকী দূয়া করে, করতে চেষ্টা করে। আরাফার সময়গুলিকে হেলায় নষ্ট না করে পরিপূর্ণ দূয়ায় কাটানোর জন্য উত্তম বুদ্ধি হল- দূয়াগুলো আগেই নোট করে নিয়ে যাওয়া, প্রয়োজনে আরাফার দূয়ার জন্য আলাদা নোট করা। এরপর যোহর থেকে মাগরিব পর্যন্ত একমনে নিজে নিজে দূয়া করে যাওয়া, মন খুলে আল্লাহর কাছে চেয়ে নেওয়া।

  • আরাফা থেকে মাগরিবের পর আপনার কাফেলা রওনা হবে মুজদালিফায়। চেষ্টা করবেন মাগরিবের পরপর সবচেয়ে প্রথমে যে বাসটা যাবে সেটায় রওনা দিতে, ভুলেও রাত ৯/১০টার বাসে রওনা দিবেন না। উল্লেখ্য, এক্ষেত্রে এজেন্সিভেদে নিয়ম ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে। দেখে নিবেন আপনার এজেন্সির বাসগুলি কখন রওনা দিচ্ছে। হতে পারে সকল বাস একসাথে মাগরিবের পরপরই রওনা দিয়ে দিচ্ছে, আবার এমনও হতে পারে যে- কিছু বাস মাগরিবের পরপর রওনা দিচ্ছে আর কিচ্ছু বাস রাতে ৯/১০টার দিকে রওনা দিচ্ছে, এমন ক্ষেত্রেই আমার উপরোক্ত পরামর্শ! যারা দেরিতে রওনা দেয় অনেকসময় তাদের মুজদালিফায় পৌঁছতে রাত ২/৩টা পর্যন্ত বেজে যায়। ফলে মুজদালিফায় রাতে লম্বা সময় অবস্থানের আমলটা ছুটে যায়।

মুজদালিফায় যেহেতু এক রাতের ব্যাপারে তাই এখানে খাবার ও পানীয় নিয়ে কিছুটা অব্যবস্থাপনা থাকতে পারে। এজন্য ব্যাকআপ পানীয় ও শুকনো খাবার অবশ্যই সাথে রাখবেন। আপনার অতিরিক্ত পানীয় ও খাবার থাকলে তাও ক্ষুধার্ত হাজীদের খেদমতে দিতে পারেন। এছাড়া মুজদালিফায় সবাই এত বেশি টায়ার্ড থাকে যে, খুব সহজেই রাতে ঘুম চলে আসে। তাই এখানে খুব বেশি খেদমতের সুযোগ নেই আর কি!

  • মীনা-আরাফা-মুজদালিফা-জামারা সব কয়টি জায়গাতেই দারুণ একটি খেদমতের মাধ্যম হল- ওয়াটার স্প্রে! প্লাস্টিকের ছোট ছোট স্প্রে বোতল ব্যাগে পানি ভরে ক্যারি করবেন। প্রচণ্ড ক্লান্তির সময়ে নিজের চোখে-মুখে স্প্রে করবেন আবার আপনার আশেপাশের হাজীদের মুখেও দিবেন। এতে ক্লান্ত-শ্রান্ত হাজীরা যে কি পরিমাণ খুশি হয় তা না দেখলে আপনি বিশ্বাসই করবেন না, অনেকে এগিয়ে এসে বলতে থাকে- ‘ওয়ান্স মোর ব্রাদার’!

মীনা থেকে জামারায় পাথর মারতে যাওয়ার পথে বিভিন্ন জায়গায় মানুষ এসব স্প্রে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, অনেক সিকিউরিটি গার্ড এবং পুলিশ অফিসারকেও দেখেছি ওয়াটার স্প্রে দিয়ে হাজীদের একটুখানি প্রশান্তির ব্যবস্থা করতে! ঐ মুহূর্তে এই একটুখানি প্রশান্তিও বিশাল বড় কিছু! তাই ওয়াটার স্প্রে সাথে নিতে ভুলবেন না। জামারায় যাওয়ার সময় পথের দুইপাশে ট্যাপ লাগানো পানির সোর্স পাবেন-সেগুলো থেকে মন ভরে পানি খাবেন, বোতল রিফিল করবেন, স্প্রে রিফিল করবেন, আশেপাশের মানুষদের রিফিল করে দিবেন- এগুলোই হয়ে যেতে পারে আপনার মাবরূর হজ্জের নিয়ামক।  

  • পুরো হজের সফরে অন্যতম আরেকটি খেদমতের সুযোগ হল- অন্যকে প্রাধান্য দেওয়া। প্রতিটি ক্ষেত্রে সম্ভব হলে অন্যকে প্রাধান্য দিন (তবে অসুস্থতাজনিত কারণ বা অন্য কোনো কারণে আপনিই প্রাধান্যের দাবীদার হলে ভিন্ন কথা)- বাসে ওঠার সময় অন্যকে আগে উঠতে দিন, সুন্দর সীট বেছে নেওয়ার এখতিয়ার অন্যদের উপর ছেড়ে দিন, তাঁবুতে ‘কুলার’ এর সামনের জায়গাটা অন্যদের দিয়ে দিন, খাবারের কমতি দেখা দিলে নিজে একটু কম খান, পানির চাহিদা বেড়ে গেলে নিজের বোতল থাকলে দ্রুত এগিয়ে দিন…মোদ্দাকথা যখন যেভাবে পারেন অন্যের চাহিদাকে নিজের উপর প্রাধান্য দিন- এটাই মাবরূর হজ্জের সবচেয়ে বড় নিয়ামক।  

এভাবে আপনার পুরো হজের সফরকেই বানিয়ে ফেলুন খিদমত ও ‘ইসার’ (অন্যকে প্রাধান্য দেওয়া) এর সফর। ইনশা আল্লাহ আপনার হজ্জ মাবরূর হজ্জ হয়ে উঠবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *