দ্বুয়ুফুর রহমান (ফালা~ রফাসা ওয়ালা~ ফুসু~ক্বা ওয়ালা~ জিদা~লা ফীল হাজ্জ)

যতই হজের দিনক্ষণ কাছিয়ে আসতে লাগল এজেন্সি থেকে ততই ঘনঘন হজ প্রশিক্ষণ ওয়ার্কশপ শুরু হল। ঐ সময়টায় আমি আবার দেশের বাইরে, এদিকে দুইটা আণ্ডাবাচ্চা নিয়ে দিনব্যাপী ওয়ার্কশপে যাওয়াও উম্মু ফাতিমার পক্ষে সম্ভব না। খুব খারাপ লাগল- হজ তো কেবল যাওয়া আসা নয়। হজের জন্য যে মানসিক ও আধ্যাত্মিক প্রস্তুতি দরকার, যেই মেন্টাল সেটাপ দরকার সেটাইতো শুরু হয় এসব প্রশিক্ষণ ওয়ার্কশপ থেকে। তবে এই অনলাইনের যুগে সবকিছুরই আপাত সমাধান আছে। আমি দেশের বাইরে থেকেই জুমে ওয়ার্কশপ এটেণ্ড করা শুরু করলাম।


এসব ওয়ার্কশপে একেবারে প্রথম থেকেই একটা কথা খুব বেশি কানে বাজত- ফালা~ রফাসা ওয়ালা~ ফুসু~ক্বা ওয়ালা~ জিদা~লা ফীল হাজ্জ। প্রোগ্রামের শুরুতেই শায়খরা এই আয়াতটি পড়তেন, মাঝেও একাধিকবার পড়তেন। হজ যে কতটা সবরের যাত্রা, মাথা ঠাণ্ডা রেখে অন্যকে অগ্রাধিকার দেওয়ার যাত্রা এবং তর্ক-বিতর্ক ও ঝগড়াঝাটির সম্ভাবনা যে কত বেশি, অনেক চূড়ান্ত ধৈর্যশীল মানুষও এসবে লিপ্ত হয়ে পড়েন- তা নিয়ে বারবার আলোচনা হত। ঐ সময় আমি ও উম্মু ফাতিমা হজ সংক্রান্ত প্রসিদ্ধ সফরনামাগুলি পড়া শুরু করেছি (হজের আধ্যাত্মিক প্রস্তুতির জন্য কোন কোন সফরনামা পড়েছিলাম আমরা এবং সেখান থেকে আমাদের অনুভূতিগুলো অন্য এক পর্বে লিখব ইনশা আল্লাহ)। সেখানেও বারংবার সবর ও নীরবতার কথা বলা হচ্ছে। একটা পর্যায়ে আমার মধ্যে এই চিন্তা একেবারে শক্তভাবে গেঁথে গেল যে- হজের সফরে অশ্লীল কথাবার্তা, পাপকাজ ও তর্কবিতর্ক পরিহার করাই কবুল হজের অন্যতম নিয়ামক।
দেখুন, আল্লাহ হজ সংক্রান্ত কোনো আয়াতে কিন্তু বেশি বেশি ইবাদত করতে বলেননি অথবা হজের দিনগুলোতে নির্দিষ্ট কোনো ইবাদত নির্দিষ্ট সংখ্যক বার করার আলাদা ফযীলত দেননি। বরং পুরো হজের দিনগুলোই একটাই প্রধান করণীয় আল্লাহ বলেছেন- ফালা~ রফাসা ওয়ালা~ ফুসু~ক্বা ওয়ালা~ জিদা~লা ফীল হাজ্জ; অর্থাৎ হজের মধ্যে কোনো অশ্লীল কথা নেই, পাপকাজ নেই, তর্কবিতর্ক নেই। হজের সফরই হল আত্মশুদ্ধির সফর, মানুষের বদভ্যাস ত্যাগ করে নিজেকে পরিবর্তন করে নিয়ে আসার সফর। আর তাইতো মানুষের প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যগত ৩টি বড় দূর্বলতাকে জয় করতে পারাই হজের দিনগুলোর প্রধান কাজ।


এই আয়াতাংশটা আমি আমার হজ সফরে প্রায় যিকিরের মত পড়তাম- নিজেকে কন্টিনিউয়াস রিমাইণ্ডার দেওয়ার মত। এই ট্রিক আপনাদেরকেও জানিয়ে দিলাম কেননা, আমি নিজে এখান থেকে ভালো উপকৃত হয়েছি। যখনই ধৈর্য্য হারানোর উপক্রম হত, তখনই মনে মনে পড়তে শুরু করতাম- ফালা রফাসা… শুধু নিজে পড়াই নয়, রুমমেটদের এবং আশেপাশের মানুষদেরও ঘনঘন স্মরণ করিয়ে দিতাম- ফালা রফাসা… আর একটা ব্যক্তিগত লক্ষ্য হজের দিনগুলোর জন্য ঠিক করেছিলাম- যদি নফল ইবাদাত কিছু কমও হয় হোক- আফসোস নেই। তবু যেন ঐ ৩টা জিনিষের ব্যত্যয় না হয়- ফালা রফাসা… এই ৩টি বিষয় মেনে চলাই কবুল হজের চাবিকাঠি, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক এবং হজের দিনগুলোতে নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখার হাতিয়ার।


শুধু হজের দিনগুলোই নয় বরং পুরো সফরের পদে পদে আপনার ধৈর্যচুতি ঘটানো এবং বিরক্তির উদ্রেক করার জন্য অসংখ্য উপায় ছড়িয়ে আছে। চলুন দেখে নিই কীভাবে পদে পদে হতে পারে আপনার ধৈর্যচুতি-


• যাত্রার সময় ফ্লাইট লেট, ঘণ্টার পর ঘণ্টা এয়ারপোর্টে অপেক্ষা করতে করতে আপনার বিরক্তি চলে আসা খুবই স্বাভাবিক। আবার আপনার এজেন্সি থেকে যদি সকল কাগজপত্র সুন্দরমত গুছিয়ে না দেয় তবে এয়ারপোর্টে গিয়ে আপনি পড়তে পারেন বড়সড় ঝামেলায়। এজন্য পরামর্শ থাকবে- কী কী কাগজপত্র আপনাকে এয়ারপোর্টে অবশ্যই হ্যান্ড লাগেজে রাখতে হবে সেগুলো বারবার নিশ্চিত হয়ে নিবেন এবং এই ব্যাপারে এজেন্সিকে বারবার জিজ্ঞেস করতে মোটেও দ্বিধা করবেন না।

• মক্কা/মদীনা (যেখানে আগে যান) পৌঁছার পর এয়ারপোর্ট থেকে বের হয়ে হয়ত দেখবেন মুয়াল্লিমের বাস আসেনি, ১৫ ঘণ্টা জার্ণি করে (ফ্লাইটের ৮ ঘণ্টা আগে এয়ারপোর্টে যেতে হবে + ৭ ঘণ্টার প্লেন জার্ণি) সেক্ষেত্রে আবার অনির্দিষ্ট সময় এয়ারপোর্টে অপেক্ষা অথবা অন্য মুয়াল্লিমের বাসে উঠিয়ে দেওয়া হতে পারে- সেখানেও আবার আপনাদের এজেন্সির সাথে সৌদী অথোরিটির ছোটখাটো ক্যাচাল হবার প্রবল সম্ভাবনা। আপনাকে মুখ বুজে ফালা রফাসা…যিকির করে যেতে হবে।
তবে হ্যাঁ, এসব ক্ষেত্রে আপনি যদি ভাঙ্গাভাঙ্গা আরবীও পারেন তবে তাদের সাথে নিজ দায়িত্বে কথা বলুন এবং বিষয়টি বোঝার চেষ্টা করুন। কাফেলায় অনেক মুরুব্বি আংকেল-আন্টি থাকেন যারা আরবীও পারেন না আবার মোবাইলে নেট চালু করে গুগল ম্যাপ দিয়ে হোটেল খুঁজে বের করবেন তাও সম্ভব হয় না। তাই আপনি যদি এগুলিতে অভ্যস্ত হয়ে থাকেন তবে চুপচাপ না থেকে এগিয়ে আসুন- কাফেলার বাকিদের দায়িত্ব নিজ কাঁধে নিন।

• যদি আপনাকে ভিন্ন বাসে উঠানো হয় (অথবা অনেক ক্ষেত্রে সঠিক বাসে উঠালেও) হোটেলের সামনে না নামিয়ে অনেক দূরে কোথাও নামিয়ে দিবে এমন সম্ভাবনাই প্রবল। এক্ষেত্রে বাসের লোকজনের সাথে তর্কাতর্কি করে লাভ নেই (আদতে তারা কখনই আপনার কথা শুনবে না, কখনও শুনলে সেটা সৌভাগ্য), আর করবেনই বা কেন? এই সফরে এসেছেনইতো সবরের প্রশিক্ষণ নিতে, সকল বিলম্ব হাসিমুখে সহ্য করতে!

• হোটেলে পৌঁছানোর পর দেখতে পারেন বাথরুমের কল নষ্ট অথবা এসি নষ্ট অথবা রুমের ফ্রীজ নষ্ট অথবা দরজার লক ভাঙ্গা আর সেই সাথে বাঙ্গালীর চিরন্তন অভিযোগ- খাবারের সমস্যা। এই ধরণের প্রতিটা বিষয়েই আপনি আপনার এজেন্সির গাইডদের সহায়তা চাইবেন কিন্তু সৌদীতে পৌঁছে অনেক কিছুই আপনার এজেন্সির হাতে থাকবে না, এক্ষেত্রে সৌদী মুয়াল্লিমের পক্ষ থেকেও কিছু গাফিলতি হতে পারে। এসব ক্ষেত্রে আপনাকে সবরের সাথে অপেক্ষা করতে হবে সমস্যা সমাধানের জন্য। কারণ, এসব ক্ষেত্রে সাধারণত রাগারাগি করে আপনি কিছুই করতে পারবেন না, শুধু শুধু হজের সাওয়াবটা নষ্ট হবে, কবুল হজের সম্ভাবনা কমে যাবে। আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল- যেসকল বিষয়ের সুরাহা আপনার এজেন্সির হাতে নেই বরং সৌদী মু’আল্লিমের হাতে সেসকল বিষয়ে অনর্থক এজেন্সিকে দোষারোপ করবেন না। এই সময়টায় তারাও বেশ প্রেশারে থাকে, তাই তাদের সাথে সহযোগীতামূলক আচরণ করার চেষ্টা করবেন।

• অনেকেই আছেন যারা ৫* প্যাকেজে গিয়ে ভাবেন- “আমি এত টাকা দিয়ে এসেও কেন আমার রুমের এটা ওটা নষ্ট?” ভুলেও এমনটা ভাবতে যাবেন না। এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে বাসা থেকে বের হয়েই আপনি ভুলে যান- কোন প্যাকেজে যাচ্ছেন। বাসা থেকে বের হয়ে আবার হজ শেষে বাসায় ফিরে আসা পর্যন্ত বেমালুম ভুলে থাকুন- প্রয়োজনে শুধুমাত্র বিনয়ের সাথে এজেন্সির সহায়তা চাইবেন, সমাধান হলে শুকরিয়া জ্ঞাপন করবেন, সমাধান না হলে সবর করবেন। জানি, হয়ত আমার কথায় রাগ হচ্ছেন, দ্বিমত করছেন। করতেই পারেন, আপনার সেই অধিকার আছে। তবে দিনশেষ কথা একটাই- আপনি যত সুপার ভিআইপি প্যাকেজেই যান না কেন, আপনার হজকে কবুল করিয়ে নেওয়ার দায়িত্ব আপনারই, এজেন্সির না। এজেন্সি আপনাকে বস্তুগত সহায়তা করতে পারে মাত্র, কিন্তু হজের আধ্যাত্মিক আমল আপনাকেই করতে হবে-এখানে কোনো অজুহাত গ্রহণযোগ্য নয়।

আপনি মনমত খাবার পাননি দেখে এজেন্সির লোককে গালি দিলে আপনার মনের ঝাল মিটবে, হয়ত তৎক্ষণাৎ মনমত খাবারও জুটবে। কিন্তু আপনার মাকসাদ কী? মনমত খাওয়া নাকি হজটাকে কবুল করিয়ে নেওয়া? হজকে ত্রুটিমুক্ত করা? আচ্ছা, আপনি অনেক টাকা দিয়েই গিয়েছেন মানলাম, আপনি সকল গুরুতর অভিযোগ দেশে ফিরে আসার পর করুন, এজেন্সির অফিসে গিয়ে ঝগড়া করতে চাইলেও দেশে ফিরে করুন কিন্তু আল্লাহর ওয়াস্তে সফরের মধ্যে অনাকাংখিত কিছু করে হজের সাওয়াব নষ্ট করবেন না। ৫* এর টাকা দিয়ে পুরো সফরে আপনি ১* এর সেবা পেলেও কিন্তু এতে অটোমেটিক আপনার হজ কবুল হয়ে যাবে না, হজের কবুলিয়াত পুরোই ভিন্ন ইস্যু- ওই যে “ফালা রফাসা…” এটাই হল কবুল হজের মূলমন্ত্র। তাই, এটাই স্মরণ করে নিজেকে ঠাণ্ডা রাখুন, অভিযোগ বাদ দিন, মাকসাদ পুরা করে নেওয়ার চেষ্টা করুন।

• সবচেয়ে বড় সবরের পরীক্ষা শুরু হবে ৮ই জিলহজ্ব মীনায় যাওয়ার পর থেকে। মীনার তাঁবুগুলো যদি কেউ আগে দেখে না থাকেন তবে গুগল করে দেখে নিবেন। মীনা-আরাফা-মুজদালিফায় সবরের চূড়ান্ত নমুনা আপনাকে দেখাতে হবে। কীভাবে? শুনুন-

 মীনার তাঁবুতে বিছানায় শুতে গিয়ে দেখবেন পাশের জনের (বিশেষত যদি তিনি স্থূলকায় কেউ হন) শরীরের অর্ধেক আপনার উপর উঠে গেছে, কিংবা আপনার বিছানার এক অংশে (মীনার তাঁবুতে বিছানার প্রতি ইঞ্চি সোনার মত দামী! কেন? গেলেই বুঝবেন) ব্যাগ ফেলে ব্লক করে রেখেছে, ফলে আপনি সাইন কার্ভের মত বাঁকা হয়ে শুয়ে আছেন! অথবা টয়লেট থেকে এসে ভেজা পা আপনার বেডের উপর দিয়ে মাড়িয়ে চলে গেছে অথবা কাদা পায়ে আপনার বেড পাড়ি দিয়েছে! বিরক্তির কত রকমফের হতে পারে সেখানে না গেলে বুঝবেন না। এসব ক্ষেত্রে আপনি পাশের জনকে চাইলেই হম্বিতম্বি দেখাতে পারেন, তবে “ফালা রফাসা…” মনে থাকলে আর করতে মন চাইবে না। মীনার মূল প্রশিক্ষণ কিন্তু এখানেই।

 এরপর আসি আরাফার ময়দানে। যেহেতু এখানে অবস্থানের সময়টা স্বল্প, তাই খুব বেশি ধৈর্যচুতির স্কোপ না থাকলেও প্রচণ্ড গরমের সাথে অন্যান্য ইস্যু যুক্ত হয়ে আপনার সবরের বারোটা বাজতেই পারে। আরেকটা বিষয় হল- আরাফায় প্রচণ্ড গরমের মধ্যে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও মুয়াল্লিমদের খাবার-জুস-পানীয় বিতরণ করা দেখে প্রতারিত হবেন না। প্রতারিত বলছি এই কারণে যে- অনেকে জুস-পানির পেছনে পড়ে সংক্ষিপ্ত মহামূল্যবান সময়টুকু হারায়। আরাফায় থাকতে হবে মাত্র যোহর থেকে মাগরিব পর্যন্ত। সাধারণত এখন এজেন্সিগুলো সকালেই নিয়ে চলে যায়, তাই বড়জোর সকাল-সন্ধ্যা থাকতে হবে। কিন্তু আল্লাহর কাছে যা চাওয়ার তা চেয়ে নেওয়ার এবং নিজের গুনাহগুলিকে ক্ষমা করিয়ে নেওয়ার উপযুক্ত সময় ও স্থান হল এটি।

অথচ আরাফার ময়দানে খাবার-ফলমূল-জুস-পানীয় নিয়ে ঝগড়া করা নিতান্ত মূর্খামি ও নিচু মানসিকতার পরিচায়ক। এসব করতে করতে কখন যে বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামে, আরাফা থেকে বের হওয়ার সময় হয়ে যায় অথচ একটু মনমত দূয়া করার ফুরসত মেলে না অনেকের! এর চেয়ে বড় বরবাদি আর কী হতে পারে!

আমাদের সময় হল কী! নারী ও পুরুষের আলাদা তাঁবু-চমৎকার ব্যবস্থাপনা। একটু পর আমার আহলিয়া ফোন দিয়ে জানাল, তাদের তাঁবুর কিছু মহিলা (ভিন্ন এজেন্সির হাজী) নাকি খাবার পায়নি এবং দাবী করছে তাদের খাবার অন্য পুরুষেরা নিয়ে তাদের নারীদেরকে দিয়েছে। তাই এর বিহিত করার জন্য ঐ নারীরা তাদের কাফেলার পুরুষদের ডেকে নিয়ে এসেছে এবং তাদের তাঁবুতে পুরুষেরা ঢুকে চিল্লাচিল্লি করছে, সকলের পর্দার কষ্ট হচ্ছে এতে! আমি দ্রুত আমাদের মুনাজ্জিম সাহেবকে জানালে তিনি ব্যবস্থা নেন।
চিন্তা করুন- কত দুর্বল-রুগ্ন ফিকির ও হীন মানসিকতা নিয়ে আমরা অনেকেই আল্লাহর মেহমান হই। আমিঃ খাবার পাইনি বিধায় অন্য নারীদের শাসাতে আমি আমার পুরুষদের ডেকে নিয়ে এলাম নারীদের তাঁবুতে- আফসোস! আফসোস! আফসোস! তবুও ধৈর্য্যহারা হবেন না। মনে রাখবেন- “ফালা~ রফাসা…”

 আরাফা থেকে ৯ই যিলহজ্ব মাগরিবের পর চলে আসবেন মুজদালিফায়। এখানে এসে খোলা আকাশের নিচে রাত্রিযাপন করতে হবে। বোনেরা অনেকেই চিন্তায় থাকেন যে, পর্দা মেইনটেইন করে কীভাবে মুজদালিফার খোলা মাঠে অবস্থান করবেন! অথচ, এটি আল্লাহর বিধান আর তাই সহজতাও আসে আল্লাহরই পক্ষ থেকে। সারাদিন মীনা-আরাফা সফর ও অবস্থান করে হাজী সাহেবরা এতই টায়ার্ড থাকেন যে, মুজদালিফার ময়দানে অন্যের তো দূরের কথা, নিজের দিকেই ভালোমত তাকানোর সুযোগ মেলে না!

বাস থেকে নেমে মাগরিব ও ইশা একত্রে আদায় করে রাতের খাবার হিসেবে কিছু মুখে দিয়েই ঘুমে ঢলে পড়াটাই স্বাভাবিক নিয়ম। আর যদি কোনো কারণে আরাফা থেকে মুজদালিফা আপনাকে হেঁটে আসতে হয় তবেতো কথাই নেই! আমাদের এজেন্সি থেকে সিদ্ধান্ত হল- ৩টি বাস যাবে আরাফা থেকে, দুটি মাগরিবের পরপর আর একটি যাবে রাত ৯টায়। আমি প্রথমে চাইছিলাম রাত ৯টার বাসে যেতে, তবে আমার অত্যন্ত প্রিয় বড় ভাইতুল্য মানুষ রানা শাকুর ভাইয়ের পরামর্শে আমি ও আমার আহলিয়া উঠে পড়লাম মাগরিবের পর ছাড়া প্রথম বাসটায়। আল্লাহর শুকরিয়া- আমরা ৯টার মধ্যেই মুজদালিফায় পৌঁছে যাই এবং সেখানে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে মাগরিব ও ইশা আদায় করি। কিন্তু রাত গড়াতে থাকে- অন্য বাসগুলি আর আসে না। শেষমেষ জানা গেল- তীব্র যানজটের কারণে রাত ৯টায় রওনা দেওয়া বাসটি মুজদালিফায় পৌঁছেছে রাত ৩টার দিকে। ইন্না লিল্লাহ ! আমি শুধু চিন্তা করছিলাম ঐ বাসের ভাইদের সবরের বিষয়টি। আর আরেকটি বাস রাস্তার মাঝে বিকল হয়ে যাওয়ায় মহিলাদের অন্য বাসে তুলে দেওয়া হয় এবং পুরুষেরা বাকি পথ হেঁটে মুজদালিফায় আসেন।

সবরের পর্যায়টা হয়ত আমি বুঝাতে পারছি না। কিন্তু যারা হজের সফরে গিয়েছেন তারা নিশ্চয়ই আঁচ করতে পারবেন পরিস্থিতির ভয়াবহতা। এতটা ক্লান্তির ভেতর যদি দেখেন আপনার পছন্দমত স্থানে কিংবা আপনার কাফেলার অন্যদের সাথে আপনি বেডিং বিছাতে পারলেন না তবে মেজাজ তাৎক্ষণিকভাবে বিগড়ে যাওয়াই স্বাভাবিক! আবার বেডিং রাখা নিয়ে আপনার সাথে কেউ বাক-বিতণ্ডা করতে আসলেও পরিস্থিতি শোচনীয় হয়ে যাওয়ার আশংকা আছে। আর তাই মুজদালিফার প্রতিটি মুহূর্তে স্মরণে রাখতে হবে-
“ফালা~ রফাসা ওয়ালা~ ফুসু~ক্বা ওয়ালা~ জিদা~লা ফীল হাজ্জ”।

শেষমেষ একটি কথাই বলতে চাই- হজের সফরে নফল আমল কিছু কম হলেও আপনার হজের সাওয়াবের বিন্দুমাত্র কমতি হবে না কিন্তু সবর হারিয়ে চেঁচামেচি করলে কিংবা গালাগালি ও তর্কাতর্কি করলে হজের সাওয়াব নষ্ট হয়ে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা আছে। তাই- সবর করুন এবং সবর করুন সকলের সাথে- পরিবারের সাথে, সহযাত্রীদের সাথে, এজেন্সির সাথে ও অন্যান্য হাজীদের সাথে। এজন্যই হজ্জ বিষয়ক পড়াশোনা বা প্রস্তুতিপর্বে প্রত্যেকটা বই, প্রত্যেকটা লেকচার, প্রত্যেকটা ট্রেনিং সেশানে যে একটা মূল মেসেজ দেয়ার চেষ্টা করা হয়, সেটা হলো-

لا رفث ولا فسوق ولا جدال في الحج.
হজ্জের মধ্যে কোন-
১.অশ্লীল কথা/কাজ নেই,
২. গুনাহের কাজ নেই
৩. ঝগড়া/বিবাদ/তর্ক নেই।

কুরআনের আয়াতের এই অংশটুকু অন্তত প্রত্যেকে মুখস্থ করে নেয়া উচিৎ। এটা হচ্ছে হজ্জের মূল কোড অব এথিক্স – হজ্জের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত প্রত্যেকটা ঘাটে ঘাটে আপনার নিজেকে ও অন্যদেরকে এই এথিক্স কোডটা স্মরণ করিয়ে দিতে হবে।
হজ্জ সফরে অশ্লীল কথা ও কাজ এড়িয়ে চলাটা হয়তো তেমন কঠিন না অধিকাংশের জন্যই। তবে জ্ঞানত ও বেখেয়ালবশত টুকটাক গুনাহের কাজ কিন্তু হয়ে যায়, এটা খেয়াল রাখা প্রয়োজন। আর সবচেয়ে বেশি যে ভুলটা হয় সেটাই হলো জিদাল অর্থাৎ তর্ক, ঝগড়া, বিবাদ। শয়তান তো ওৎ পেতে বসে রয়েছে কিভাবে আপনার হজ্জ নষ্ট করবে, কারণ আপনি নিষ্পাপ হয়ে বাড়ি ফিরে গেলে তো শয়তানের পুরোটাই লস। তাই আপনার মেজাজ বারবার খারাপ করে দিবে। একবার মনে হবে খাবার খারাপ, এজেন্সীর মানুষ খারাপ, ব্যবস্থাপনায় সমস্যা, রুম্মেটদের প্রতি অসহিষ্ণুতা…. নানাভাবে শয়তান আপনাকে ঝগড়া বিবাদ ও তর্কের ব্যাপারে উস্কানি দিবে। তাই প্রতি মুহুর্তে এই কোড অব এথিক্স আয়াতটা মাথায় ফিক্স করে রাখা, শয়তান আপনাকে খেপিয়ে তুলতে চাইলেই নিজেকে এই কোডটা মনে করিয়ে দেয়া- লা রফাসা ওয়া লা ফুসূক্বা ওয়া লা জিদালা…..

এই কোডটুকু শুধুই কি হজ্জের জন্যই? উহু, হজ্জের ট্রেইনিংটাই তো বাস্তব জীবনের জন্য। এই যে তর্ক, ঝগড়া, অশ্লীল আলোচনা এসবের মধ্যে পড়ে গেলেও নিজে উঠে আসা বা চুপ করে থাকা- এই গুণগুলো আমরা যদি হজ্জ থেকে ফেরার পর বাস্তবজীবনে ও সোশ্যাল মিডিয়ায়ও ধরে রাখতে পারতাম! কতইনা উত্তম হতো!

এই বিষয়ে শাইখ আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর রহিমাহুল্লাহ এর চমৎকার একটি লেকচার আছে ৩-৪ পর্বের, মোট ৪-৫ ঘণ্টার মত সময় লাগবে। তবে ছোট্ট একটা বইও পাওয়া যায় সেই লেকচারের উপর- হজ্জের আধ্যাত্মিক শিক্ষা নামে, ঐ লেকচারেরই লিখিত রূপ। আরও সংক্ষেপে মূল কথা জানতে চাইলে আব্দুল হাই মুহাম্মদ সাইফুল্লাহ হাফিজাহুল্লাহ এর মাত্র ১৫ মিনিটের একটা লেকচার আছে ইউটিউবে পাওয়া যায় একই নামে “হজ্জের আধ্যাত্মিক শিক্ষা”। আব্দুল হাই শাইখের আরও অনেক ছোট ছোট ক্লিপ পাওয়া যায় ইউটিউবে হজ্জ বিষয়ে, উনি বেশ চমৎকার বাস্তব জীবনের উদাহরণ দিয়ে হজ্জের এসেন্সগুলো ব্যাখ্যা করেছেন, মা শা আল্লাহ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *