~ কথা বললে মিথ্যা না বলা।
~ ওয়াদা/কথা দিলে কথা রাখা, ওয়াদা খেলাফ না করা।
~ আমানত দিলে খেয়ানত না করা।
~ মেজাজ একটু খারাপ হলেই গালি-গালাজ না করা।
এই বৈশিষ্ট্যগুলো একজন মুমিনকে একজন মুনাফিক থেকে পৃথক করে। অথচ দুঃখজনক ব্যাপার হলো, এর প্রায় সবগুলোরই কোন না কোনটা মুমিন সমাজে, সহজ কথায়, প্র্যাক্টিসিং সমাজেই বিদ্যমান। ১ ও ৪ খুব কমন, তাই এটা নিয়ে নতুন করে বলার দরকার মনে করছিনা। তবে ২ ও ৩ আনকমন হওয়ার কথা ছিলো, কিন্তু এই দুটো মুনাফিকি বৈশিষ্ট্যও একেবারে ভালো মানের প্র্যাক্টিসিংদের মধ্যেই আশংকাজনক হারে বিদ্যমান। চিন্তাফিকির বাড়ানো দরকার।
আপনি যখন একজন মুমিন/মুমিনা, একজন লেবাসী, নিজ মহলে দ্বীনি বলে পরিচিত; আপন নিজে না চাইলেও আপনি ইসলামের একজন ব্র্যান্ড এম্বাসাডর। চিন্তা করেন তো, একজন সাধারণ মানুষ যদি আপনার সাথে মু’আমালা করে এই ধারণা পায় যে, লেবাসীরাও আমানত নিয়ে ঘুরপ্যাচ করে, খেয়ানত করে, কিংবা ওয়াদা দিলেই তা ভঙ্গ করে, তাহলে আপনি ইসলামের ব্যাপারে কী মেসেজটা দিলেন? সে কি আপনার মত অন্য লেবাসীদেরও এমনটাও ভেবে নেবে না? কিংবা মনে করুন, আপনি একজন দ্বীনি ভাই/বোনের কাছে টাকা ধার চাইলেন, সে দ্বীনের বিশ্বাসেই আপনাকে দিয়ে দিল, কদিন বাদেই যখন টাকা ফেরৎ দেয়ার সময় হলো, আপনি তাকে চরকির মত ঘুরাতে থাকলেন। সে কি দ্বিতীয়বার বিপদে আর আপনাকে সাহায্য করতে চাইবে?
হ্যা, আমরা মানুষ, আমাদের সীমাবদ্ধতা আছে। হতে পারে, পরিস্থিতিতে পড়ে কাউকে একটা কথা দিয়ে ফেলেছি, যা পূরণ করার ক্ষমতা আমার নেই। কিংবা কাউকে একটা কথা দিয়েছিলাম, কিন্তু ব্যস্ততা কিংবা অসুস্থতার কারণে একদমই ভুলে গেছি। এই ভুলগুলো মানবিক। কিন্তু ভুলের রিপিটিশন কিন্তু মুনাফিকি। কথা দিয়ে ফেলেছেন, রাখতে পারবেন না, আগেভাগেই জানিয়ে দিন- ভাই, স্যরি, আমি আসলে কথাটা রাখতে পারছিনা। ব্যস্ততার কারণে একদম ভুলে গেছেন, মনে পড়ার সাথে সাথে একটা টেক্সট দিয়ে মাফ চেয়ে নিন। আর মোবাইলে কোন নোটস app এ কিংবা ডায়েরীতে আপনার আর্জেন্ট কাজগুলোর লিস্ট করে রাখুন যেন আর কোন গুরুত্বপূর্ণ কাজ মিস না হয়। কিন্তু এই কথা না রাখা কিংবা ভুলে যাওয়ার বিষয়টা এক দু’বার হতে পারে, এটা যদি এতই রেগুলার হয়ে যায় যে, অপরপক্ষের মাথায় এটাই সেট হয়ে যায় যে, আপনি কথা দিলেই সেটা ভঙ্গ করেন; তাহলে অবশ্যই আপন হাদীসের ভাষ্য অনুযায়ী মুনাফিকের বৈশিষ্ট্য ধারণ করেন। আপনার তাওবা করে এই দোষ থেকে যেকোন মূল্যে বের হয়ে আসা অপরিহার্য।
একইভাবে, আপনি হয়তো কারও কাছে টাকা বা অন্য কিছু আমানত হিসেবে নিয়েছেন। যে তারিখে পরিশোধ করার কথা ছিলো, এমন একটা অনিবার্য পরিস্থিতিতে পড়ে গেলেন, কোনভাবেই সেই সময়ে শোধ করতে পারলেন না। কিংবা একদম ভুলেই গেলেন টাইমটা। মনে পড়ার সাথে সাথে আপনার পাওনাদারের কাছে মাফ চেয়ে নিন- ভাই, স্যরি। আমি অমুক কারণে টাকাটা আজ দিতে পারছিনা/ টাকাটা ফেরৎ দিতে ভুলে গিয়েছিলাম, তবে আগামী অমুক দিনের মধ্যেই দিয়ে দেবো। আর নোটস app কিংবা ডায়েরীতে আপনার দেনার পরিমাণ টুকে রাখুন, ফেরৎ দেয়ার ডেডলাইনে এলার্ম দিয়ে রাখুন যেন আর কোনদিন ভুলটা রিপিট না হয়। এই ভুল মানবিক, এক-দু’বার হতেই পারে। কিন্তু আপনি যখন কন্টিনিউয়াস ডেট দিচ্ছেন, ডেট পার হয়ে গেলেও আপনার কোন বিকার নেই, পাওনাদারেরা নিজ তাগিদে আপনাকে খুচিয়ে খুচিয়ে মনে করিয়ে দিচ্ছে, আপনি কথা দিচ্ছেন, আবার ভাঙছেন৷ শেষমেষ তাদের মনে এটাই বদ্ধমূল হয়ে গেলো যে, আপনাকে আমানত দিলেই আপনি খেয়ানত করবেন কিংবা ঘুরাবেন। ঠিক এই বৈশিষ্ট্যটাই হাদীসে বর্ণিত মুনাফিকের চিহ্নিত বৈশিষ্ট্য। সচেতন হওয়া দরকার, তাওবা করে বান্দাহর কাছে এবং আল্লাহর কাছে মাফ চেয়ে উঠে আসুন।
কারণ, স্পষ্ট ঘোষণা আছে-
إن المنافقين في الدرك الأسفل من النار.
“নিশ্চয়ই মুনাফিকদের স্থান হবে জাহান্নামের সর্বনিম্ন স্তরে।”
আস্তাগফিরুল্লাহ! আমাদের লেবাস দেখে সবাই ভেবে নিচ্ছে জান্নাতী, আর আমরা এমন কিছু মুনাফিকি বৈশিষ্ট্য ধারণ করছি, যার পরিণতি জাহান্নামের সর্বনিম্ন স্তর, চিন্তা করা যায়?আস্তাগফিরুল্লাহ! দ্বীনি ব্যবসায়ী ভাইবোনদের জন্য এই বিষয়টা আরও বেশি জরুরী, কারণ মানুষের সাথে সবচেয়ে বেশি মু’আমালাত তাদেরকেই করতে হয়। আর হ্যা, হাদীসে কিন্তু এটাও এসেছে যে, মানুষের প্রকৃত রূপ চেনা যায় সফরে এবং তার সাথে লেনদেনে। তারমানে আপনি যত ভালোমানুষই হন না কেন, আপনি লেনদেনে খারাপ মানে আপনি মানুষটা ভালো নন, বিশ্বাসী/আমানতদার নন- এই মাপকাঠি হাদিসেই বলে দেয়া হয়েছে।
লাস্ট বাট নট দ্য লিস্ট, এবার একটু মানবিক দিক দিয়ে চিন্তা করে বলুন তো, এই বৈশিষ্ট্যগুলোর কেন এত বেশি নিন্দা করা হয়েছে? কারণ, আপনার হয়তো জানাও নেই, আপনি যেদিন টাকা ফেরৎ দেয়ার কথা দিয়েছিলেন, ঐ দিন ঐ টাকা দিয়ে পাওনাদার ব্যক্তির অন্য কোন জরুরী কাজ করার প্ল্যান ছিলো। আপনি যে কথা দিয়েছিলেন, ওটার উপর হয়তো নির্ভর করছিলো খুব জরুরী একটা প্রোগ্রাম/বিষয়, যেটা আপনি আগেই অপারগতা প্রকাশ করলে সে হয়তো অন্য কাউকে দায়িত্বটা দিয়ে দিতো, কিন্তু আপনি এমন সময় এসে বললেন যখন আর তার হাতে মেক-আপ করার সময় নেই। আপনাকে হয়তো একটা ড্রেসের অর্ডার দেয়া হয়েছিলো, যেটা কোন বিশেষ উপলক্ষ্যে তার পরার কিংবা অন্য কাউকে গিফট করার কথা ছিলো, আপন কথা না রাখায় মানুষটার সব প্ল্যান নষ্ট হয়ে গেলো। এটিই হচ্ছে হাক্কুল ইবাদ, মানুষের হক্ব, যা নষ্ট করার অধিকার আপনাকে দেয়া হয়নি, আপনার দায়িত্বহীনতার কারণে কাউকে অনাকাঙ্ক্ষিত বিপদে ফেলার অধিকারও আপনাকে দেয়া হয়নি। এজন্যই ইসলাম এই হাক্কুল ইবাদ রক্ষার ব্যাপারে সবচে বেশি কঠোরতা অবলম্বন করেছে, হাক্কুল্লাহ তাওবার দ্বারা মাফ হলেও হাক্কুল ইবাদ যদি বান্দাহ মাফ না করে, আপনি মাফ পাবেন না, হাশরের ময়দানে তার ক্ষতির মাশুল আপনাকে বুঝে দিতে হবে। কি ভয়ংকর ব্যাপার!
আল্লাহ আমাদের হেফাজত করুন। আমাদেরকে চিন্তাশীলতা, দায়বদ্ধতা ও দায়িত্বশীলতার গুণে গুণান্বিত করুন।