সন্তান, ক্যারিয়ার ও আমার ভাবনা…

– বাচ্চার তো ছ’মাস হয়ে গেলো, একটা কোর্সে ঢুকে পড়ো, মেয়েকে তোমার মা কিংবা শাশুড়ীর কাছে রেখে….
– ও আচ্ছা, আমার মা আমাকে পেলেপুষে বড় করে বিয়ে দিয়েছেন, আমার শাশুড়ি আমার জামাইকে পেলেপুষে বড় করেছেন, এখন আবার আমাদের বাচ্চাকেও তারা পালা শুরু করবেন? তাহলে আমাদের দায়িত্বটা কী? বাচ্চা পেটে রেখে ডেলিভারি দিয়ে এরপর হ্যান্ডওভার দেয়া? আর আমাদের বাবামায়েরা ঠেকা পড়েছেন, আমরা ডেলিভারি দিতে থাকবো, উনারা পালতে থাকবেন, আর দিনশেষে আমাদের পদবী ভারি হতে থাকবে??

আমি বলছিনা মেয়েদের জব করা সর্বাবস্থায় হারাম; আমি বলছি এই দুধের শিশুদের কষ্ট দিয়ে, আমাদের পঞ্চাশ-ষাটোর্ধ মা-বাবাদের কষ্ট দিয়ে তবু আমাদের ‘কিছু’ একটা হতেই হবে, এক্ষণই হতে হবে- এই মেন্টাল সেটাপটা আমাদের মাথায় কে ঢুকিয়েছে? এত আর্জেন্সি কীসের? আমরা সমাজকে এত ভয় পাই কেন? আমার ‘আমি’ বলতে কি কিচ্ছু নেই??

জানি, আপনি বলবেন, সব দায়িত্ব পালন করেও তো কত মা করছে! আমি বলবো: আলবৎ মিথ্যা কথা।ঢের দেখেছি, নিজে চোখে দেখেছি, সকালে ঘুম থেকে উঠে যে বাচ্চাটা মা-কে পায়না, ওর দীর্ঘশ্বাসটুকু কতটা গভীর! ঐ বাচ্চাটা কাদতে কাদতেই ঘুমায়, কাদতে কাদতেই বড় হয়, একসময় বুঝে নেয়: মা-কে চাইলেই কাছে পাওয়া যায়না, কাজের লোকের বকা খেয়ে, মার খেয়েই বড় হতে হয়, এটাই নিয়ম। দিনশেষে মা-কে দেখলে আর ছাড়তে চায়না, একদম আকড়ে ধরে রাখে, সবসময় একটা হারানোর আতঙ্কে ভোগে- এই বুঝি মা ফাকি দিয়ে চলে গেলো! এটা আমার বানানো কথা নয়, সাইকোলজিতে এই টার্মটার নাম ‘Separation Anxiety’, এই এংজাইটিতে ভোগা বাচ্চাদের ফিজিক্যাল, মেন্টাল গ্রোথ আপে বড় রকমের সমস্যা হতে পারে। এরচে বড় নির্যাতন আর কী হতে পারে একটা শিশুর জন্য? আমার এট্টুকুন বাচ্চা, এখনই দেখি অন্য কেউ কোলে নেয়ার পর আমি হাত বাড়ালে ঝাপ দিয়ে পড়ে, কোলে না নিলে অদ্ভূতরকম আকুলিবিকুলি করতে থাকে। আমিতো ভাবতেও পারিনা, এই বাবুটাকে কাজের লোকের হাতে ছেড়ে একটা দিনও বাইরে গিয়ে থাকি!

আর যে বাবা-মায়েরা বৃদ্ধ বয়সে বিছানায় শুয়ে আরাম করবেন, ছেলে-মেয়েদের সেবা-শুশ্রুষা পাবেন, তারা যখন নতুন করে আবার সন্তানের ‘সন্তান’ পালতে শুরু করেন, তাদের দীর্ঘশ্বাসটাও আমি দেখেছি। মনে সইলেই দেহে সয়না, সওয়ার একটা বয়স আছে, কষ্টেরও একটা লিমিট আছে। উনারা মুখে বলেন না, নিরবে চোখের পানি ফেলেন। সবসময় বদদু’আ দিতে হয়না, মন থেকেও চলে আসে…

হ্যা, হ্যা, এজন্যেই আমি এইমুহুর্তে ডিগ্রি চাইনা, আমার মা, মেয়ে দুইজন মানুষকে কাদিয়ে ফাইলে জমে থাকা সার্টিফিকেটের স্তূপের মধ্যে আরেকটা সার্টিফিকেট বাড়ানোর এত তাড়া কীসের? যে কাজের সুযোগ আল্লাহ আমাকে এখন দেননি, তার জন্য তো আল্লাহর কাছে আমার জবাবদিহিতা নেই। জবাবদিহিতা বরং ঐ সন্তানের কাছে, যার অধিকার ছিলো কাজের লোকের বকাঝকা না খেয়ে আমার আদরে বড় হওয়ার, আমার তারবিয়াতটুকু পাওয়ার! মানুষের কাছে জবাবদিহিতা এই জীবনটুকুই, আল্লাহর কাছে জবাবদিহিতা আমার জান্নাত-জাহান্নামের ফয়সালা হওয়া অবধি…..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *